বুধবার, ১৭ এপ্রিল, ২০২৪ ০০:০০ টা

বজ্রপাত বন্ধে শত কোটির প্রকল্প ব্যর্থ

♦ হাজার কোটি টাকার নতুন প্রকল্প ♦ বসানো হবে বজ্রনিরোধক দণ্ড ♦ চলতি মৌসুমে ১৬ জনের মৃত্যু

জিন্নাতুন নূর

বজ্রপাত বন্ধে শত কোটির প্রকল্প ব্যর্থ

বৈশাখ শুরু হলেই ভয় বাড়ে কালবৈশাখী ঝড় আর বজ্রপাতের। বজ্রপাতে প্রতি বছর বিপুলসংখ্যক মানুষের করুণ মৃত্যু হয়। চলতি মৌসুমে এখন পর্যন্ত বজ্রপাতে ১৬ জনের মৃত্যু হয়েছে। বেশির ভাগই কৃষিকাজে জড়িত।

২০২২ সালের এপ্রিল থেকে ২০২৩ সালের মে পর্যন্ত বজ্রপাতে মোট ৩৪০ জনের মৃত্যু হয়। সামনেই শুরু হচ্ছে বোরো ধান কাটার মৌসুম। আর এ সময় কৃষক ফসলের মাঠে ব্যস্ত সময় কাটায়। ফলে বজ্রপাতে ক্ষয়ক্ষতির আশঙ্কাও বেশি। সরকার বজ্রপাতে মানুষের মৃত্যু ঠেকাতে বিভিন্ন সময় বেশ কয়েকটি প্রকল্প নিয়েছিল। এর কিছু মাঝপথেই বাতিল করা হয়েছে। কিছু আলোর মুখ দেখেনি। আবার যেসব প্রকল্প বাস্তবায়নের পথে আছে সেগুলোর কার্যকারিতা নিয়েও সংশ্লিষ্টদের মনে প্রশ্ন আছে।

সেভ দ্য সোসাইটি অ্যান্ড থান্ডারস্টর্ম অ্যাওয়ারনেস ফোরাম এবং দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয় সূত্রে বজ্রপাতে বিশ্বের এক-চতুর্থাংশ মৃত্যুই হয় বাংলাদেশে। আর প্রতি বছর গড়ে বজ্রপাতে ২৫৬ জনের বেশি মানুষের মৃত্যু হয়; যার ৭০ শতাংশই মাঠে কাজ করার সময়, সাড়ে ১৪ শতাংশ বাড়ি ফেরার পথে আর ১৩ শতাংশ গোসল কিংবা মাছ ধরার সময় মারা যায়। ২০১১ থেকে ২০২৩ সাল পর্যন্ত ১৩ বছরে বাংলাদেশে বজ্রপাতে মৃত্যু হয়েছে ৩ হাজার ৪০৭ জনের। সরকার বজ্রপাতকে ২০১৬ সাল থেকে জাতীয় দুর্যোগ হিসেবে ঘোষণা করে। আর বজ্রপাতে সবচেয়ে বেশি মৃত্যু হয় এপ্রিল থেকে জুনে। আবহাওয়াবিদদের মতে বাংলাদেশের উত্তর, উত্তর-পূর্ব ও উত্তর-পশ্চিমাঞ্চল সবচেয়ে বেশি বজ্রপাতপ্রবণ। আর বজ্রপাতে হতাহত বেশি ঘটে হাওরাঞ্চলে। কারণ এসব অঞ্চলে জলীয় বাষ্প বেশি থাকে। সে কারণে নেত্রকোনা, কিশোরগঞ্জ, সুনামগঞ্জ, মৌলভীবাজার, হবিগঞ্জ, সিলেট, টাঙ্গাইল, জামালপুর ও ময়মনসিংহকে বজ্রপাত-ঝুঁকিপূর্ণ হিসেবে আবহাওয়াবিদরা চিহ্নিত করেছেন। বিশেষজ্ঞরা জানান, বাতাসে সিসার পরিমাণ বৃদ্ধি, অতিরিক্ত তাপমাত্রা, মোবাইলের মাত্রাতিরিক্ত ব্যবহার এবং এর র‌্যাডিয়েশন, গ্রামে মোবাইল নেটওয়ার্ক টাওয়ারের সংখ্যা বৃদ্ধি, উঁ”ু গাছের সংখ্যা কমে যাওয়া এবং জলাভূমি ভরাটের কারণে বজ্রপাত বৃদ্ধি পেয়েছে। বজ্রপাত রোধে সরকার বিভিন্ন সময় নানা প্রকল্প নিয়েছে। এজন্য ব্যয় হয়েছে বিপুল অর্থও। কিন্তু বজ্রপাতে মানুষের মৃত্যু ঠেকানো যাচ্ছে না। এরই মধ্যে কাজে না আসায় ‘তাল গাছ লাগানো প্রকল্প’ মাঝপথে থেমে গেছে। অথচ এ প্রকল্পের জন্য গচ্চা গেছে শত কোটি টাকা। এ প্রকল্পের জন্য ২০১৭ সালে দেশব্যাপী ১০ লাখ তাল গাছের চারা এরং ৩৫ লাখ আঁটি রোপণের উদ্যোগ নেওয়া হয়। তাল গাছে বজ্রপাত আটকে দিলে ক্ষয়ক্ষতি কম হবে এ ধারণা থেকেই প্রকল্পটি নেওয়া হয়। কিন্তু যথাযথ পরিচর্যা না থাকায় তাল গাছের চারা ও আঁটিগুলো নষ্ট হয়ে যায়। পরে এ প্রকল্প বাতিল হয়ে যায়। এ ছাড়া বজ্রপাতের পূর্বাভাস জানতে ৬৮ কোটি টাকা ব্যয়ে দেশের আট স্থানে রাডার (লাইটনিং ডিটেকটিভ সেন্সর) বসানো হয়। এর উদ্দেশ্য ছিল বজ্রপাতের ১৫ মিনিট আগে ওই এলাকার মানুষকে এ সম্পর্কিত তথ্য জানিয়ে দেওয়া। কিন্তু এ প্রকল্পও ব্যর্থ হয়। আবার মার্কিন মহাকাশ গবেষণা সংস্থা নাসার সহযোগিতায় বজ্রপাত সম্পর্কে আগাম তথ্য পেতে ‘হাই ইমপ্যাক্ট ওয়েদার অ্যাসেসমেন্ট’ নামে আরেকটি প্রযুক্তি চালু করা হয়। বাংলাদেশ আবহাওয়া অধিদফতর এ প্রকল্পের বাস্তবায়নকারী সংস্থা। এর মাধ্যমে ৫৪ ঘণ্টা আগেই বজ্রপাত সম্পর্কে আগাম তথ্য পাওয়া যাবে। কিন্তু কৃষক ও জেলেদের কাছে এ ধরনের প্রযুক্তি সহজলভ্য না হওয়ায় এটিও খুব একটা কাজে আসেনি। এ ছাড়া হাওরাঞ্চলে কৃষকের জীবন সুরক্ষায় বজ্রনিরোধক ব্যবস্থা স্থাপন নামে একটি প্রকল্প হাতে নেয় কৃষি মন্ত্রণালয়। ২০২২ সালে নেওয়া ২৩১ কোটি টাকার প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করছে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতর। প্রকল্পের আওতায় হাওরাঞ্চলের সাত জেলার ৫৮ উপজেলায় ১০০ থেকে ১২০ বর্গমিটার ব্যাসার্ধের ১৬টি ‘আর্লি স্টিমার ইমিটার’ নামে বজ্রনিরোধক যন্ত্র বসানো হবে। এর সঙ্গে ‘আর্থ নেটওয়ার্কস লাইটিং অ্যান্ড সিভিয়ার ওয়েদার আর্লি ওয়ার্নিং সল্যুশন’ সিস্টেমের মাধ্যমে মোবাইল অ্যাপ, ভয়েস ও খুদে বার্তায় স্থানীয়দের সতর্কবার্তা দেওয়া হবে। ২০২৩ সালের মার্চে স্থানীয় সরকার বিভাগ ‘রেজিলিয়েন্ট ইনফ্রাস্ট্রাকচার ফর অ্যাডাপশন অ্যান্ড ভালনারেবিলিটি রিডাকশন (রিভার)’ নামক প্রকল্প হাতে নেয়। এর অধীন দেশের ১ হাজার ৪০০ স্থানে বজ্রনিরোধক যন্ত্র স্থাপন করার কথা। এতে ৪০০ কোটি টাকা ব্যয় ধরা হয়েছে। এ ছাড়া বজ্রপাত কমাতে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা অধিদফতর ১ হাজার ৩২১ কোটি টাকার প্রকল্প নিয়েছে। এর আওতায় বসানো হবে বজ্রনিরোধক দণ্ড (লাইটনিং অ্যারেস্টার), বানানো হবে আশ্রয় কেন্দ্র। এ প্রকল্পে দেশের ১৫ জেলায় ৬ হাজার ৭৯৩টি বজ্রনিরোধক দণ্ড বসানো ও ৩ হাজার ৩৯৮টি আশ্রয় কেন্দ্র নির্মাণের প্রস্তাব করা হয়েছে। দণ্ড বসাতে ব্যয় হবে ৭৩২ কোটি টাকা। আর আশ্রয় কেন্দ্র নির্মাণে ৪০৫ কোটি টাকা। বাকি টাকা প্রকল্পের অন্য কাজের জন্য। প্রথমবার এ প্রকল্পটি পরিকল্পনা কমিশনে পাঠানো হলেও টাকার অভাব ও আশ্রয় কেন্দ্র নির্মাণের যৌক্তিকতা খুঁজে না পেয়ে প্রকল্পটি ফেরত পাঠানো হয়। পরে এটি আবার পরিকল্পনা কমিশনে পাঠায় দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়। দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের সচিব মো. কামরুল হাসান এনডিসি গতকাল বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ‘বজ্রপাত যেহেতু একটি প্রাকৃতিক দুর্যোগ। এটি কমানো আমাদের হাতে নেই। বজ্রপাত যখন মেঘ থেকে নিচে নেমে আসবে তখন তা যাতে কোনো প্রাণী বা মানুষের ওপর না পড়ে সেজন্য বজ্রনিরোধক দণ্ড স্থাপনের উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে। এতে দণ্ডটি বজ্রপাত নিজের মধ্যে টেনে নেবে যা পরে মাটিতে চলে যাবে।’ তিনি আরও বলেন, ‘বজ্রনিরোধক দণ্ড বসানো এবং আশ্রয় কেন্দ্র নির্মাণ ছাড়া দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা মন্ত্রণালয় বজ্রপাত রোধে বর্তমানে আর কোনো প্রকল্প বাস্তবায়নের পথে নেই। যদি এ প্রকল্পটি বাস্তবায়নের নির্দেশনা পাওয়া যায় তখন মন্ত্রণালয় এর বাস্তবায়নে যাবে।’ বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) পানি ও বন্যা ব্যবস্থাপনা ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক ও জলবায়ু বিশেষজ্ঞ ড. এ কে এম সাইফুল ইসলাম বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ‘মানুষ এখন খোলা মাঠে অনেক বেশি কৃষিকাজে জড়িত। আবার আগের তুলনায় মাছ চাষও বেশি হচ্ছে। এ দুই পেশায় জড়িতরা খোলা স্থানে থাকেন। এজন্য বজ্রপাতে এদের ক্ষতি হওয়ার ঝুঁকিও বেশি। ক্ষয়ক্ষতি কমাতে এপ্রিলের শুরু থেকেই এ বিষয়ে ব্যাপক প্রচার চালানো দরকার। হাওর এলাকাগুলোয় বজ্রপাত থেকে রক্ষার জন্য আশ্রয় কেন্দ্র তৈরি করা যেতে পারে। একই সঙ্গে বজ্রপাতে চিকিৎসাব্যবস্থা সম্পর্কে সাধারণ মানুষ ততটা জানে না। এ বিষয়গুলো নিয়ে কাজ করতে হবে। বজ্রপাতের শিকার ব্যক্তিদের সরকারি অর্থসহায়তার পরিমাণ খুব কম। এটি বৃদ্ধি করা উচিত।’

সর্বশেষ খবর