সোমবার, ২২ এপ্রিল, ২০২৪ ০০:০০ টা

গ্যাস সংকটে ধুঁকছে সর্ববৃহৎ পাওয়ার হাব

সরেজমিনে আশুগঞ্জ পাওয়ার স্টেশন কোম্পানি লিমিটেড

জিন্নাতুন নূর, আশুগঞ্জ থেকে ফিরে

গ্যাস সংকটে ধুঁকছে সর্ববৃহৎ পাওয়ার হাব

আশুগঞ্জ পাওয়ার স্টেশন কোম্পানি লিমিটেড (এপিএসসিএল) দেশের সর্ববৃহৎ একটি পাওয়ার হাব। এর ৬টি ইউনিটের বর্তমানে মোট বিদ্যুৎ উৎপাদন ক্ষমতা ১ হাজার ৬৪৭ মেগাওয়াট। দেশের কোনো বিদ্যুৎ কেন্দ্রে একসঙ্গে এতগুলো বিদ্যুৎ ইউনিট সাধারণত দেখা যায় না। গুরুত্বপূর্ণ এই কেন্দ্রটি অন্য বিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলো থেকে তুলনামূলক সাশ্রয়ী দামে বিদ্যুৎ উৎপাদন করছে। কিন্তু গ্যাসের অভাবে এই কেন্দ্রটি থেকে এখন গড়ে ৯৫০ থেকে সর্বোচ্চ ১ হাজার ২০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন করে জাতীয় গ্রিডে দেওয়া যাচ্ছে। অর্থাৎ উৎপাদনের সুযোগ থাকলেও গড়ে ৪৫০ থেকে ৭০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ এই        পাওয়ার হাব থেকে কম উৎপাদিত হচ্ছে। আবার বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড বা পিডিবি-এর কাছে এই পাওয়ার হাবের বিদ্যুৎ বিল বাবদ পাওনা দাঁড়িয়েছে সাড়ে ৪ হাজার কোটি টাকা। বিল না পেয়ে এপিএসসিএল কর্তৃপক্ষকে বিভিন্ন ব্যাংক থেকে ঋণ করে বিদ্যুৎ কেন্দ্রটি পরিচালনা করতে হচ্ছে। সরেজমিনে ২০ এপ্রিল এই পাওয়ার হাবটি পরিদর্শন করে জানা যায়, প্রাথমিকভাবে ১২৮ মেগাওয়াট ক্ষমতা সম্পন্ন দুটি বিদ্যুৎ কেন্দ্র দিয়ে ১৯৭০ সালের জুলাই মাসে যাত্রা শুরু করে এপিএসসিএল। ২০১০ সালে এপিএসসিএল নিজস্ব অর্থায়নে ৫০ মেগাওয়াটের একটি বিদ্যুৎ কেন্দ্র স্থাপন করে। পরের বছর ৩০ এপ্রিল এটি বাণিজ্যিক উৎপাদন শুরু করে। ২০১৩ সালের ২০ জুলাই আরও চারটি জ্বালানি সাশ্রয়ী বৃহৎ বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণ প্রকল্প বাস্তবায়ন শুরু হয়। যেগুলো যথাক্রমে ২০১৫ এর ৮ মে ও ৯ ডিসেম্বর, ২০১৬, ২০১৭ সালে বাণিজ্যিক উৎপাদন শুরু করে। এগুলো হলো- ২২৫ মেগাওয়াট সিসিপিপি, ৪৫০ মেগাওয়াট সিসিপিপি (সাউথ), ৪৫০ মেগাওয়াট সিসিপিপি (নর্থ) ও ২০০ মেগাওয়াট মডিউলার। আশুগঞ্জ ৪০০ মেগাওয়াট সিসিপিপি (ইস্ট) প্রকল্পটি ২০২৩ সালের নভেম্বর মাসে শেষ হয় এবং এটি জাতীয় গ্রিডে বাণিজ্যিকভাবে বিদ্যুৎ সরবরাহ করছে। এর মধ্যে ৫ নম্বর ইউনিটটি গত বছর অবসরে যায়। জানা যায়, এপিএসসিএল-এর মাধ্যমে উৎপাদিত বিদ্যুৎ জাতীয় গ্রিডে দেশে মোট চাহিদার ৭ শতাংশেরও বেশি বিদ্যুৎ উৎপাদন করে। এই বিদ্যুৎ কেন্দ্রের প্রধান জ্বালানি বাখরাবাদ গ্যাস ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানি লিমিটেড সরবরাহ করে। এপিএসসিএল-এর চলমান ৫টি ইউনিটের প্রতি ইউনিট গড় উৎপাদন ব্যয় ৫ দশমিক শূন্য ৬ এবং প্রতি ইউনিট গড় জ্বালানি খরচ হয় ৩ দশমিক ০৯৭৭ টাকা। এপিএসসিএল-এর ব্যবস্থাপনা পরিচালক সাইদ একরাম উল্লা বলেন, চাহিদা মোতাবেক গ্যাস পাওয়া না যাওয়ায় আমরা কাক্সিক্ষত বিদ্যুৎ উৎপাদন করতে পারছি না। কিন্তু গ্যাস পেলে এখন আমরা যে পরিমাণ বিদ্যুৎ উৎপাদন করছি তার চেয়ে আরও ২০০ মেগাওয়াট বেশি বিদ্যুৎ জাতীয় গ্রিডে দিতে পারব। আমরা আরও ১০ এমএমসিএফডি গ্যাস দেওয়ার জন্য সংশ্লিষ্ট মহলে অনুরোধ করেছি। বর্তমানে ১৬০ থেকে ১৭০ এমএমসিএফডি গ্যাস পাচ্ছি। ১ হাজার ৬০০ মেগাওয়াটের বিদ্যুৎ উৎপাদনের সক্ষমতা থাকা সত্ত্বেও গ্যাসের অভাবে বিদ্যুৎ উৎপাদন করতে পারছি না। পিডিবির কাছে আমাদের বিদ্যুৎ বিল বকেয়া পড়ে আছে। বিভিন্ন ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়ে আমরা চালিয়ে নিচ্ছি। যেহেতু আমাদের এভাকিউশন তিনটি ভিন্ন ভোল্টেজ লেভেলে হয়, এ জন্য কোনো ভোল্টেজে যদি ডিমান্ড কম থাকে তখন হয়তো ফুল লোড নিতে পারে না তখন কোনো কোনো সময় বিদ্যুৎ সঞ্চালনে ত্রুটি দেখা হয়। এপিএসসিএল-এর প্রকৌশলী মোহা. আবদুল মজিদ নির্বাহী পরিচালক (অপারেশন অ্যান্ড মেইন্টেনেন্স) বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, এখানে ৬টি ইউনিটের মধ্যে ৪টি হচ্ছে কম্বাইন্ড সাইকেল। একটি হচ্ছে ইঞ্জিন বেইজড। আরেকটি মডিউলার। গ্যাস-ইঞ্জিন চালিত ৫০ মেগাওয়াটের বিদ্যুৎ কেন্দ্রটি থেকে এখন ৪৮ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদিত হচ্ছে। ৪৫০ মেগাওয়াটের কম্বাইন্ড সাইকেল (সাউথ) থেকে উৎপাদিত হচ্ছে ৩৫৭ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ। ৪৫০ মেগাওয়াট (নর্থ) থেকে পাওয়া যাচ্ছে ৩৫৪ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ। ১ হাজার ৬৪৭ মেগাওয়াটের সক্ষমতা থাকলেও গ্যাসের জন্য আমরা পর্যাপ্ত বিদ্যুৎ উৎপাদন করতে পারছি না। ২৩০ এমএমসিএফডি গ্যাস এপিএসসিএল-এর জন্য বরাদ্দ করা হয়েছে। কিন্তু আমরা এখন পাচ্ছি ১৬০ থেকে ১৭০ এমএমসিএফডি গ্যাস। তিনি আরও জানান, শনিবার এই বিদ্যুৎ কেন্দ্র থেকে ১ হাজার ২০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদিত হয়। এদিন ১৬০ এমএমসিএফডি গ্যাস সরবরাহ করা হয়। ৭০ এমএমসিএফডি গ্যাসের ঘাটতি ছিল। গ্যাস ঘাটতির কারণে এই বিদ্যুৎ উৎপাদন আরও কমে গড়ে ৯০০ থেকে ৯৫০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদিত হয়। যদি চাহিদা অনুযায়ী বরাদ্দকৃত গ্যাস পাওয়া যায় তাহলে এখান থেকে দেড় হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন করা যাবে। যেহেতু এটি একটি বড় পাওয়ার হাব জাতীয় গ্রিডে বিদ্যুৎ দিয়ে দেওয়ার পর তা চলে যায় কুমিল্লা, শাহজিবাজার, সিরাজগঞ্জ ও ভোলায়। এ জন্য ২৩০ কেভি, ৪০০ কেভি এবং ১৩০ কেভি সঞ্চালন লাইনের মাধ্যমে জাতীয় গ্রিডে বিদ্যুৎ ছড়িয়ে দেওয়া হয়। বিদ্যুৎ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ বিদ্যুৎ কেন্দ্রটি পরিদর্শন শেষে সাংবাদিকদের বলেন, আমাদের এখানে সক্ষমতা ১ হাজার ৬০০ মেগাওয়াট। তবে অবশ্যই গ্যাস প্রাপ্তির ওপর এর বিদ্যুৎ উৎপাদনের বিষয়টি নির্ভর করে। এখানে গ্যাস কম পাচ্ছি। আবার সঞ্চালনেও কিছু সমস্যা আছে, এটি পুরো লোড নিতে পারবে না। এখানে যেভাবেই হোক গ্যাসের প্রাপ্তি যাতে বাড়ে তা নিশ্চিত করতে হবে। একই সঙ্গে বিদ্যুৎ সঞ্চালনের ক্যাপাসিটিও বৃদ্ধি করতে হবে। তবে পাওয়ার গ্রিড কোম্পানি অব বাংলাদেশ লিমিটেডের (পিজিসিবি) ব্যবস্থাপনা পরিচালক এ কে এম গাউছ মহীউদ্দিন আহমেদ বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, আশুগঞ্জে বিদ্যুৎ সঞ্চালন নিয়ে যে সমস্যা আছে এই ধারণা নিয়ে ভুল বোঝাবুঝির সৃষ্টি হয়েছে। বর্তমানে বিদ্যুৎ সঞ্চালন নিয়ে কোনো সমস্যা নেই।

সর্বশেষ খবর