সোমবার, ২২ এপ্রিল, ২০২৪ ০০:০০ টা

সাংবাদিকের ওপর হামলায় আওয়ামী লীগ নেতা গ্রেফতার

কক্সবাজার প্রতিনিধি

সাংবাদিকের ওপর হামলায় আওয়ামী লীগ নেতা গ্রেফতার

গ্রেফতারকৃত আওরঙ্গজেব মাতবর ও তার ভাই মোজাহিদুল ইসলাম

কুতুবদিয়া কৈয়ারবিল ইউনিয়নের মলমচর এলাকায় একটি অসহায় পরিবারের সদস্যদের ওপর হামলাসহ তাদের লাশের মাংস খুঁজে না পাওয়ার প্রকাশ্যে হুমকির একটি ভিডিও প্রচার করায় বাংলাদেশ প্রতিদিন-এর কুতুবদিয়া প্রতিনিধি মো. মিজানুর রহমানকে দিনদুপুরে পিটিয়ে হত্যাচেষ্টার ঘটনায় করা মামলার প্রধান আসামি কুতুবদিয়া উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি আওরঙ্গজেব মাতবর  ও তার ভাই মোজাহিদুল ইসলাম সেলিমকে গ্রেফতার করেছে পুলিশ। ঘটনার এক দিন পর গতকাল ভোরে পুলিশের একাধিক টিম নজর আলী মাতবরপাড়া এলাকায় অভিযান চালিয়ে তাদের গ্রেফতার করে। পুলিশ জানায়, গোপন সংবাদের ভিত্তিতে নজর আলী মাতবরপাড়া এলাকায় অভিযান চালিয়ে তাদের আটক করা হয়েছে। শুক্রবার (১৯ এপ্রিল) বিকালে কুতুবদিয়া উপজেলা আওয়ামী লীগের ঈদ পুনর্মিলনী অনুষ্ঠানের সংবাদ সংগ্রহ করতে গিয়ে উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি আওরঙ্গজেব মাতবরের নেতৃত্বে হামলার শিকার হন সাংবাদিক মিজানুর রহমান। মিজানুর রহমান জানান, উপজেলার কৈয়ারবিল ইউনিয়নের নজর আলী মাতবরপাড়ার মৃত আবুল কাশেম মাতবরের তিন ছেলে কুতুবদিয়া উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি আওরঙ্গজেব মাতবর, তার দুই ভাই আজমগীর মাতবর ও মোজাহিদুল ইসলাম সেলিম এবং তাদের ছেলে আরিফ বিন রিনাস, সানজো রাকিব, মো. মোজাহিদ, মো. নিহাল উদ্দিন, মুহিদুল হাসান হান্নানসহ অজ্ঞাত আরও ১০-১৫ জন পেশাগত দায়িত্ব পালনের সময় হামলা চালায়। এরপর তিনি আর কিছু বলতে পারেননি। কুতুবদিয়া থানার অফিসার ইনচার্জ মোহাম্মদ গোলাম কবির জানান, সাংবাদিক হত্যাচেষ্টা মামলায় কুতুবদিয়া উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি আওরঙ্গজেব এবং তার ভাই মোজাহিদুল ইসলাম সেলিমকে গ্রেফতার করে আদালতে পাঠানো হয়েছে। সকাল ১০টায় তাদের আদালতে হাজির করা হলে বিকাল ৩টায় তাদের কারাগারে পাঠানো হয়।

অনুমোদন পায়নি আওয়ামী লীগের কুতুবদিয়া উপজেলা কমিটি : বিতর্কিত কুতুবদিয়া উপজেলা কমিটির সভাপতি আওরঙ্গজেব জেলা সভাপতির সহযোগিতায় ছয় ইউনিয়নের মধ্যে দুই ইউনিয়নে কোনো সম্মেলন না করে, উপজেলার জামায়াত-বিএনপির চিহ্নিত তার লোক দিয়ে পকেট কমিটি ঘোষণা করেন। ত্যাগী নেতাদের বাদ দিয়ে তার  নিকটাত্মীয়, সিন্ডিকেট ও নিজস্ব কর্মচারীদের উপজেলা কাউন্সিল করে একতরফা সম্মেলন করে সভাপতি নির্বাচিত হলে, বিভিন্ন কারণে  এখনো কুতুবদিয়া উপজেলা আওয়ামী লীগের কমিটি অনুমোদন হয়নি। কুতুবদিয়া উপজেলার একতরফা সম্মেলন সম্পর্কে সাংগঠনিক সম্পাদক স্বপন সবকিছু জেনেও জেলা সভাপতির কারণে নীরব ভূমিকা পালন করেন। বিধায় কুতুবদিয়া উপজেলা সম্মেলন অবৈধ ও অগঠনতান্ত্রিক।

আওরঙ্গজেব মাতাব্বর ও তার ভাইদের কর্মকান্ড : ১. গত ১৭ এপ্রিল সকাল সাড়ে ১০টার দিকে জমিজমার বিষয় কেন্দ্র করে কুতুবদিয়া উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি আওরঙ্গজেব মাতাব্বর (৫২) তার অপর দুই ভাই আলমগীর মাতাব্বর (৪৮), মোজাহিদুল ইসলাম সেলিম (৪২) অজ্ঞাতনামা ২০-২৫ জন লোক নিয়ে কুতুবদিয়া থানার মলমচরের বাসিন্দা মফিজুল আলমের (৭০) ৯ শতক জমির ওপর নির্মিত গ্যারেজ, মুদি ও চায়ের দোকান ভাঙচুর শুরু করেন। এ সময় মফিজুল আলমসহ তার স্ত্রী-সন্তানরা বাধা দিতে গেলে আওরঙ্গজেব মাতাব্বরসহ তার সহযোগী লোকজন তাদের এলোপাতাড়ি মারপিট শুরু করেন। স্বয়ং আওরঙ্গজেব মাতাব্বরও দেশি অস্ত্র নিয়ে মারমুখী অবস্থান নেন। এ সময় অজ্ঞাতনামা ব্যক্তির ধারালো অস্ত্রের আঘাতে মফিজুল আলমের ছেলে মো. হানিফ আহত হন। ঘটনাস্থল থেকে আওরঙ্গজেব মাতাব্বরের নির্দেশে তার লোকজন একটি জেনারেটর মেশিন, দুটি ড্রাম ভাঙচুর করে দোকানের বেড়া ও অন্যান্য মালামাল নিয়ে যান। কুতুবদিয়ার পুলিশ সংবাদ পেয়ে দ্রুত ঘটনাস্থলে পৌঁছে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনে। ভিকটিমের বাবা মফিজুল বাদী হয়ে থানায় এজাহার দায়ের করেন।

এলাকাবাসী সূত্রে জানা যায়, কুতুবদিয়া উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি আওরঙ্গজেব মাতাব্বর, কৈয়ারবিল ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান আজমগীর মাতাব্বর, মোজাহিদুল সেলিম মাতাব্বর ও আলমগীর মাতাব্বর এলাকায় তাদের আধিপত্য ধরে রাখতে জমি জবরদখল ও মারামারি করে থাকেন। ভুক্তভোগীরা তাদের ভয়ে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কাছে অভিযোগ করেন না বলে বিভিন্ন সূত্র জানায়। ২. গত ১০ মার্চ সন্ধ্যা ৭টার দিকে পূর্বশত্রুতার জেরে কুতুবদিয়া উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি আওরঙ্গজেব মাতাব্বরের ভাই মোজাহিদুল ইসলাম সেলিম মাতাব্বর ও আলমগীর মাতাব্বরের নেতৃত্বে উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের মূল রাস্তার প্রবেশমুখে জনৈক জাহেদুল ইসলাম চৌধুরীর (পিতা-জাবেদ আহাম্মদ চৌধুরী, সাং- পরান সিকদার পাড়া) দোকানে অনধিকার প্রবেশ করে মারধর করে গুরুতর আহত করে। এ বিষয়ে ভিকটিমের ভাই মনোয়ারুল ইসলাম চৌধুরী মুকুল বাদী হয়ে কুতুবদিয়া থানায় মামলা করেন। (নম্বর-০৮(৪)২৪)

৩) উল্লিখিত ঘটনাসমূহ স্থানীয় টিভি চ্যানেলে সম্প্রচারিত হলে ১৯ এপ্রিল বিকাল ৫টার দিকে কুতুবদিয়া উপজেলা পরিষদের সামনে চ্যানেলটির স্বত্বাধিকারী, বাংলাদেশ প্রতিদিন ও এশিয়ান টেলিভিশনের কুতুবদিয়া উপজেলা প্রতিনিধি মিজানুর রহমানকে (৩০) মারধর করে গুরুতর আহত করে উপজেলা আওয়ামী লীগ সভাপতি আওরঙ্গজেবের লোকজন। অনুসন্ধানে জানা যায়, আওরঙ্গজেব মাতাব্বরের ভাই আজমগীর মাতাব্বর ২০১৪ সালের পূর্ববর্তী সময়ে বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর সাবেক এমপি বর্তমানে কেন্দ্রীয় জামায়াতের সেক্রেটারি জেনারেল হামিদুর রহমান আযাদের ঘনিষ্ঠ সহচর ও কৈয়ারবিল ইউনিয়ন জামায়াতের আমির ছিলেন। পরবর্তীতে তার ভাই আওরঙ্গজেব মাতাব্বর কৈয়ারবিল ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের আহ্বায়ক কমিটিতে স্থান দেন। এরপর আজমগীর মাতাব্বর কৈয়ারবিল ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সভাপতি নির্বাচিত হয়ে সভাপতির দায়িত্বসহ বর্তমানে চেয়ারম্যানের দায়িত্ব পালন করছেন।

 

অনুসন্ধানে জানা যায়, আওরঙ্গজেব মাতাব্বরের অপর ভাই মোজাহিদুল ইসলাম সেলিম ১৯৯৬ সালে চট্টগ্রাম কলেজে ছাত্রশিবিরের ক্যাডার থাকাকালীন প্রকাশ্যে ব্রাশফায়ার করে ৮ ছাত্রলীগ নেতা-কর্মীকে হত্যা মামলায় যাবজ্জীবন সাজাপ্রাপ্ত হন। ৩ বছর সাজা ভোগের পর আপিলে বের হয়ে বর্তমানে এলাকায় জমি দখল ও মারামারিতে সক্রিয় ভূমিকা রাখছেন। অপর ভাই রাইসুল ইসলাম রুবেল জামায়াতে ইসলামীর পক্ষে Raisul Islam Rubel নামীয় ফেসবুক আইডি থেকে লেখালেখি করেন মর্মে প্রাথমিকভাবে জানা যায়। অনুসন্ধানকালে আরও জানা যায়, কুতুবদিয়া উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি আওরঙ্গজেব মাতাব্বর ১৯৮৮-১৯৯০ সাল পর্যন্ত কুতুবদিয়া উপজেলার ফ্রিডম পার্টির সভাপতি ছিলেন। তিনি ১৯৯১ সালে ছাত্রলীগে যোগদান করেন এবং ১৯৯৪ সালে কুতুবদিয়া উপজেলা ছাত্রলীগের সেক্রেটারি নির্বাচিত হন। এরপর থেকে যুবলীগ ও আওয়ামী লীগের সদস্য, সভাপতি পদে নির্বাচিত হন। তিনি তার অন্য ভাইদের সহযোগিতায় এলাকায় জমি দখলসহ বিভিন্ন অপকর্মে জড়ান। তিনি উপজেলা আওয়ামী লীগের পদ-পদবি ব্যবহার করে এ ধরনের কর্মকান্ডে জড়িয়ে এলাকায় প্রভাব বিস্তার করছেন বলে জানা যায়। কুতুবদিয়া উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি আওরঙ্গজেব মাতাব্বরের বিরুদ্ধে কুতুবদিয়া থানার ৩টি মামলা বর্তমানে আদালতে বিচারাধীন।

সর্বশেষ খবর