শনিবার, ২৭ এপ্রিল, ২০২৪ ০০:০০ টা

গাছ ও জলাশয় নেই ঢাকায়

♦ জলাধার আছে মাত্র ২ দশমিক ৯১ শতাংশ ♦ সবুজায়ন ৯ দশমিক ১২ শতাংশ ♦ কংক্রিট আচ্ছাদিত এলাকা ৮০ শতাংশ

হাসান ইমন

গাছ ও জলাশয় নেই ঢাকায়

তীব্র দাবদাহে একটু স্বস্তি পেতে রাজধানীর বধ্যভূমিতে দুরন্তপনায় মেতেছে শিশুরা -বাংলাদেশ প্রতিদিন

রাজধানীর পান্থকুঞ্জ পার্কটি ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের মালিকানাধীন। ২০১৭ সালে পার্কটির উন্নয়ন কাজ শুরু করে সংস্থাটি। কিছুদিন পর তা আবার বন্ধ হয়ে যায়। বর্তমানে পার্কটিতে এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ের র‌্যাম্প বসানোর কার্যক্রম চলছে। সেজন্য পার্কটির অর্ধেকের বেশি এলাকার গাছ কেটে ফেলা হয়েছে। বাকি অংশের সৌন্দর্যবর্ধনের কাজ করছে সিটি করপোরেশন। একই অবস্থা ওসমানী উদ্যানের। বর্তমানে পার্কটি উন্নয়নের কাজ চলছে। এ পার্কটি উন্নয়নের নামে ১৭৩টি গাছ কেটে ফেলা হয়েছে। একই সঙ্গে জলাধারের একটি অংশ ভরাট করেছে কর্তৃপক্ষ। এ ছাড়া ফার্মগেটে আনোয়ারা পার্ক একসময় পার্ক হিসেবে থাকলেও এখন মেট্রোরেলের অবকাঠামো নির্মাণ করা হয়েছে। পার্কটি এখন অস্তিত্ব সংকটে। একই অবস্থা সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের। ওয়াকওয়ে ও ফুড কোর্ট বানানোর জন্য শতাধিক গাছ কেটে ফেলা হয়েছে।

রাজধানীতে শুধু গাছ কেটে সবুজায়ন কমানো নয়, একই সঙ্গে ভরাট হয়েছে জলাধার। নগরীতে কমেছে জলাধারের পরিমাণ। চলতি বছরের শুরুতে রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (রাজউক) প্রকাশিত প্রতিবেদনে দেখা যায়, রাজউক এলাকার ৬৮টি পুকুর অবৈধভাবে দখল হয়ে গেছে, যার মধ্যে ঢাকায় ৬২টি। ঢাকার পুকুরগুলোর মধ্যে ভেস্টেড প্রপার্টি হিসেবে চিহ্নিত পুকুর রয়েছে সাতটি, বাকি ৫৫টি খাসপুকুর। নারায়ণগঞ্জ ও সাভারে তিনটি করে ছয়টি পুকুর অবৈধ দখলে রয়েছে। পুকুরগুলো ভরাট করে গড়ে উঠেছে ঘরবাড়ি, দোকান, ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান, ফিলিং স্টেশন, স্টিল মিল, মার্কেট, গ্যারেজ, ফলের আড়ত, মসজিদ, মন্দির ইত্যাদি। এসব পুকুর বা জলাধার শুধু ব্যক্তিকেন্দ্রিক দখলে নয়, সরকারিভাবেও ভরাট হয়েছে।

মৎস্য অধিদফতর সূত্রে জানা যায়, ১৯৮৫ সালে ঢাকায় পুকুরের সংখ্যা ছিল প্রায় ২ হাজার। দ্রুত নগরায়ণের ফলে মাত্র চার বছর পর ১৯৮৯ সালের দিকে তা ১ হাজার ২০০-তে নেমে আসে। মৎস্য ভবন থেকে পরিচালিত ২০০৭ সালের জরিপের তথ্য বলছে, সে সময় পর্যন্ত পুকুরের সংখ্যা নেমে এসছে ২০০-তে। বর্তমানে ঢাকা শহরে পুকুরের সঠিক সংখ্যার হিসাব নেই উত্তর ও দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের কাছে। তবে ফায়ার সার্ভিস সূত্র বলছেন, ২০১৮ সালের জরিপে শতাধিক পুকুরের অস্তিত্ব থাকলেও বর্তমানে রাজধানীতে পুকুরের সংখ্যা মাত্র ২৯। এ ছাড়া রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (রাজউক) ডিটেইল এরিয়া প্ল্যান-২০২২ অনুযায়ী, রাজউকের ১ হাজার ৫২৮ বর্গকিলোমিটার এলাকায় ৩ হাজার ৪৬৪টি পুকুর আছে। এর মধ্যে ২০৫টি ঢাকার মধ্যাঞ্চলে। ২০১০ থেকে ২০১৯ সালের মধ্যে ব্যক্তি, ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান ও অন্যান্য সংস্থার কারণে ঢাকার ৯ হাজার ৫৫৬ একর বন্যা প্রবাহ অঞ্চল, জলধারণ এলাকা এবং জলাশয়ের মধ্যে ৩ হাজার ৪৪০ একরই হারিয়ে গেছে।

গত দুই দশকের পরিস্থিতি নিয়ে বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব প্ল্যানার্স (বিআইপি) পরিচালিত গবেষণায় দেখা গেছে, গত ২০ বছরে ঢাকায় জলাশয় ও খোলা জায়গার পরিমাণ দুই-তৃতীয়াংশ কমেছে। নগর পরিকল্পনাবিদরা বলছেন, একটি ‘আদর্শ শহর’ গড়ে ওঠে কংক্রিট, সবুজ ও পানির সমন্বয়ে। অন্তত ২৫ শতাংশ সবুজ, ১৫ শতাংশ জলাধার থাকবে। বাকি ৬০ ভাগের মধ্যে ৪০ থেকে ৫০ ভাগ কংক্রিট এলাকা করতে পারে, বাকিটা ভবনের মাঝখানে খালি জায়গা হিসেবে থাকবে। বিআইপির গবেষণায় উঠে এসেছে, ১৯৯৫ সালে দুই সিটি করপোরেশনের আওতাধীন এলাকায় জলাধার ও জলাভূমি ছিল ২০ দশমিক ৫৭ শতাংশ। ২০০৫ সালে তা ৮ দশমিক শূন্য ৪ শতাংশ হয়। ২০১৫ সালে তা আরও কমে ৩ দশমিক ২১ শতাংশে নামে। ২০২৩ সালে ২ দশমিক ৯১ শতাংশে এসে দাঁড়ায়। একইভাবে ১৯৯৫ সালে সবুজ এলাকা ছিল ২০ দশমিক শূন্য ২ শতাংশ। ২০০৫ সালে হয় ১৫ দশমিক ৮৭ শতাংশ। ২০১৫ সালে হয় ১৪ দশমিক ১৮ শতাংশ। ২০২৩ সালে হয়েছে ৯ দশমিক ১২ শতাংশ। ১৯৯৫ সালে ফাঁকা জায়গা ছিল ১৩ দশমিক ৪৯ শতাংশ। তা ২০২৩ সালে হয়েছে ১০ দশমিক ৯৯ শতাংশ। ১৯৯৫ সালে নির্মিত এলাকা ছিল ৪৩ দশমিক ৭২ শতাংশ। ২০২৩ সালে তা হয়েছে ৭৬ দশমিক ৭৮ শতাংশ।

জলাধার ও সবুজের সমারোহ বিলীন হয়ে ক্রমেই ধূসর হচ্ছে রাজধানী ঢাকা। সবুজ ভূমি ও জলাধারের ঢাকা সময়ের বিবর্তনে হয়ে গেছে কংক্রিটের শহর। ফলে এ শহরের তাপমাত্রাও দিন দিন মরুভূমির মতোই উত্তপ্ত হয়ে উঠছে। গত সাত বছরে ঢাকার গড় তাপমাত্রা অন্তত ৩-৪ ডিগ্রি সেলসিয়াসের বেশি বৃদ্ধি পেয়েছে বলে এক গবেষণা প্রতিবেদনে উঠে এসেছে। গাছ ও জলাশয়হীন এলাকায় তাপমাত্রা সবচেয়ে বেশি পেয়েছেন গবেষকরা। এর মধ্যে মহাখালী, গুলিস্তান ও ধানমন্ডিতে সবচেয়ে বেশি তাপমাত্রা পাওয়া গেছে। ২০১৭ ও ২০২৪ সালের ঢাকা শহরের তাপমাত্রা নিয়ে গবেষণা করে একটি প্রতিবেদন তৈরি করেছে বায়ুমণ্ডলীয় দূষণ অধ্যয়ন কেন্দ্র (ক্যাপস)। গবেষণায় দেখানো হয়েছে, ঢাকা দক্ষিণ সিটি এলাকায় ২০১৭ থেকে ২০২৪ সাল পর্যন্ত গড়ে ৪ ডিগ্রি তাপমাত্রা বেড়েছে। আর উত্তর সিটি করপোরেশনে ৩ ডিগ্রি তাপমাত্রা বেড়েছে। কারণ হিসেবে পরিবেশবিদরা বলছেন, বৈশ্বিক জলবায়ু পরিবর্তনের পাশাপাশি আমাদের অপরিকল্পিত নগরায়ণ, বাতাস সঞ্চালন না হওয়া, সবুজ নিধনসহ নানা কারণে প্রতি বছর ক্রমান্বয়ে ঢাকার তাপমাত্রা বেড়ে যাচ্ছে।

এই রকম আরও টপিক

এই বিভাগের আরও খবর

সর্বশেষ খবর