শনিবার, ২৭ এপ্রিল, ২০২৪ ০০:০০ টা

হুমকিতে বৈশ্বিক খাদ্য নিরাপত্তা

বিবিএস বলছে, বাংলাদেশের ২২ শতাংশ মানুষ খাদ্য নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছে

মানিক মুনতাসির

সম্প্রতি প্রকাশিত বিশ্বব্যাংকের বৈশ্বিক খাদ্যনিরাপত্তা শীর্ষক এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বর্তমানে বিশ্বের ৬০ শতাংশ নিম্নআয়ের দেশে খাদ্য মূল্যস্ফীতি ৫ শতাংশের ওপরে অবস্থান করছে। নিম্নআয়ের দেশের চেয়েও করুণ দশা নিম্নমধ্যম আয়ের দেশগুলোতে। নিম্নমধ্যম আয়ের দেশগুলোর মধ্যে ফেব্রুয়ারি মাসের হিসাব অনুযায়ী, ৬৩ দশমিক ৮ শতাংশ দেশে খাদ্য মূল্যস্ফীতি ৫ শতাংশের ওপরে অবস্থান করছে। রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের ফলে বিশ্বের খাদ্য উৎপাদন, বিপণন, সরবরাহ প্রক্রিয়া চরমভাবে ব্যাহত হয়েছে। এরই মধ্যে নতুন মোড় নিয়েছে ইসরায়েল-ফিলিস্তিনের যুদ্ধ। যা তেলসমৃদ্ধ পুরো মধ্যপ্রাচ্যকে টালমাটাল করে দিয়েছে। এতে মূল্যস্ফীতির পারদ শুধু ওপরের দিকেই উঠছে। এদিকে বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) তথ্যমতে, মার্চ শেষে খাদ্যে মূল্যস্ফীতি ৯ শতাংশের ওপরে। সার্বিক মূল্যস্ফীতি দুই অঙ্কের ঘর ছুঁইছুঁই করছে টানা প্রায় তিন বছর ধরে। এ অবস্থায় অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি অর্জনের চেয়ে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণকে অধিক গুরুত্ব দেওয়ার কথা জানিয়েছেন খোদ অর্থমন্ত্রী আবুল হাসান মাহমুদ আলী। এ ছাড়া জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে ঝুঁকিতে থাকা দেশগুলোকে কৃষি উৎপাদন কমছে। একই সঙ্গে বাড়ছে কৃষিজ ও শিল্প উৎপাদন। ফলে বৈশ্বিক অর্থনীতি বর্তমানে স্মরণকালের ভয়াবহ সংকট অতিক্রম করছে বলে মনে করে জাতিসংঘ। জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থা (এফএও) এবং বিশ্ব খাদ্য কর্মসূচি (ডব্লিউএফপি) ২০২২ সালের প্রথম দিক থেকেই সতর্ক করে বলে আসছিল, ২০২৩ সালে বিশ্বের ৪৫টি দেশে তীব্র খাদ্যঘাটতি দেখা দিতে পারে, যা বিশ্বের অন্তত ২৭৬ মিলিয়ন মানুষকে মারাত্মক খাদ্যসংকটের মধ্যে ঠেলে দেবে। জাতিসংঘের মহাসচিব অ্যান্তোনিও গুতেরেসসহ কৃষিবিষয়ক আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলো বারবার বৈশ্বিক ক্ষুধা পরিস্থিতির অবনতির হুঁশিয়ারি দিয়ে আসছে। চলতি বছরেও এই সংকট অব্যাহত থাকবে বলে জানিয়েছে জাতিসংঘ। শুধু তাই নয়, ইসরায়েল ও ইরানের সংঘাত যদি দীর্ঘায়িত হয় তবে সেটা তৃতীয় বিশ্ব যুদ্ধেও রূপ নিতে পারে বলে শঙ্কা প্রকাশ করেছেন বিশ্লেষকরা। অন্যদিকে গত মার্চে প্রকাশিত বিবিএসের জরিপ প্রতিবেদন খাদ্য নিরাপত্তা পরিসংখ্যান-২০২৩ এ বলা হয়েছে, বাংলাদেশের ২২ শতাংশ মানুষ খাদ্য নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছে। অথচ তিন বছর আগেও এই সংখ্যক মানুষের খাদ্যনিরাপত্তা নিয়ে কোনো দুশ্চিন্তা ছিল না। এর মধ্যে শহরাঞ্চলের ২০ দশমিক ৭৭ শতাংশ, গ্রামাঞ্চলের ২৪ দশমিক ১২ শতাংশ এবং সিটি করপোরেশন এলাকায় ১১ দশমিক ৪৫ শতাংশ মানুষ মাঝারি খাদ্য নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছেন। এদিকে অতি নিরাপত্তাহীনতায় আছে শূন্য দশমিক ৮৩ শতাংশ মানুষ। খাদ্য মন্ত্রণালয়ের সূত্রগুলো বলছে, দেশে দ্রুত কমছে খাদ্যমজুদ। চলতি বছরের ১৭ এপ্রিল পর্যন্ত চালের মজুদ নেমেছে ৮ লাখ টনে। যা চলতি অর্থবছরের (জুলাই) শুরুতে ছিল ১৭ লাখ টন। ধান, চাল, গম মিলিয়ে খাদ্যমজুদ দাঁড়িয়েছে ১১ লাখ ৯১ হাজার টনে। যা গত জুলাই-২০২৩ এ ছিল ১৬৯ লাখ টনেরও বেশি। সে হিসেবে নয় মাসে খাদ্যমজুদ কমেছে প্রায় ৮ লাখ টন। তথ্য অনুযায়ী, ১৭ এপ্রিল দেশের সরকারি গুদামগুলোয় চালের মোট মজুদ ছিল ৮ লাখ ৭৭ হাজার টন। আর জুলাইয়ে ২০২৩-২৪ অর্থবছরের শুরুতে তা ছিল ১৭ লাখ ৬০ হাজার টন। এরপর সেপ্টেম্বরে তা কমে দাঁড়ায় ১৬ লাখ ২০ হাজার টনে। গত ১১ জানুয়ারিতে তা নেমে আসে ১৪ লাখ ২৮ হাজার টনে। এরপর থেকে ধারাবাহিকভাবে কমছে সরকারি খাদ্যমজুদ। এর আগে গত অর্থবছরের (২০২২-২৩) ৬ এপ্রিল দেশে চালের সরকারি মজুদ ছিল ১৩ লাখ ৮৫ হাজার টন। সে হিসাবে সরকারি গুদামগুলোয় এক বছরের ব্যবধানে চালের মজুদ কমেছে ৫ লাখ ৮ হাজার টন বা প্রায় ৩৭ শতাংশ।

এ প্রসঙ্গে খাদ্য অধিদফতরের সাবেক মহাপরিচালক সারোয়ার মাহমুদ বলেন, খাদ্যমজুদ পরিস্থিতি সন্তোষজনক না থাকলে কিছুটা অস্বস্তি কাজ করে। তবে আমাদের দেশের বেশির ভাগ মানুষ কৃষক। তারা নিজেরা নিজেদের খাদ্যমজুদ করেন। এটা বিশ্বের অন্য দেশের সঙ্গে তুলনা করা যায় না। আর সরকারি খাদ্যমজুদ রাখা হয় শুধুমাত্র আপৎকালীন সময়কে মোকাবিলা করার জন্য। তবে এই মজুদ পরিস্থিতিও শক্তিশালী হওয়া বাঞ্চনীয় বলে তিনি মনে করেন।

দ্য ওয়ার্ল্ড কাউন্টসের সর্বশেষ প্রতিবেদন অনুযায়ী, বিশ্বে প্রতি বছর এইডস, ম্যালেরিয়া ও যক্ষ্মায় সম্মিলিতভাবে যত মানুষ মারা যায়, তার চেয়ে বেশি মারা যায় ক্ষুধায়। প্রতি বছর ৯০ লাখ মানুষ ক্ষুধা কিংবা ক্ষুধাজনিত কারণে সৃষ্ট রোগে মৃত্যুবরণ করে। বিশ্বে বছরে ৩১ লাখ শিশু, যাদের বয়স পাঁচ বছরের নিচে তারা ক্ষুধার যন্ত্রণায় মৃত্যুবরণ করে। সে হিসাবে শুধু ক্ষুধার কারণে বিশ্বে প্রতি ১০ সেকেন্ডে একজন করে শিশু মারা যায়। প্রতি নয়জনে একজন পেটে ক্ষুধা নিয়ে ঘুমাতে যায়। বিশ্বে প্রায় সাড়ে ৮০০ মিলিয়ন মানুষ প্রয়োজনীয় খাদ্যের অভাবে পুষ্টিহীনতায় ভোগে, যাদের মধ্যে ১২০ মিলিয়ন মানুষের অবস্থা মারাত্মক বলে প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে। বিশ্ব খাদ্য সংস্থার (এফএও) প্রতিবেদন অনুযায়ী, বিশ্বে খাদ্য উৎপাদনে আপাতত ঘাটতি না থাকলেও বণ্টনজনিত সমস্যার কারণে অনেক দেশ খাদ্য নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছে। বিশেষ করে জলবায়ু সংকট, দেশে দেশে যুদ্ধ, নিষেধাজ্ঞার তোপের কারণে আগামী এক দশক বিশ্ব খাদ্যনিরাপত্তা প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে অন্যতম চ্যালেঞ্জিং দশক হিসেবে গণ্য করা হচ্ছে।

 

 

এই বিভাগের আরও খবর

সর্বশেষ খবর