সোমবার, ২৯ এপ্রিল, ২০২৪ ০০:০০ টা

মাঠের ফসল নিয়ে মহাদুশ্চিন্তা

ওয়াজেদ হীরা

মাঠের ফসল নিয়ে মহাদুশ্চিন্তা

দেশজুড়ে বয়ে যাচ্ছে মৃদু থেকে তীব্র তাপপ্রবাহ। তীব্র তাপে হিটশকের ঝুঁকিতে পড়েছে বোরো ধান আর দুশ্চিন্তা বেড়েছে কৃষকদের। প্রচ  দাবদাহে গাছ থেকে ঝরে পড়ছে আম ও লিচুর গুটি। প্রচ- গরমে ধানসহ অন্যান্য ফল-ফসলে বড় ক্ষতির আশঙ্কা করছেন কৃষি সংশ্লিষ্টরা।

কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের (ডিএই) তথ্য অনুসারে, ২০২৩-২৪ অর্থবছরে সারা দেশে বোরো ধানের আবাদ হয়েছে ৫০ লাখ ৫৮ হাজার হেক্টর জমিতে। যেখানে উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা ২ কোটি ২২ লাখ ৫৬৪ টন। তবে অতি তাপে উৎপাদন নিয়ে শঙ্কা রয়েছে এবার। কেননা, ২০২১ সালে কয়েক ঘণ্টার হিটশকে ৩ লাখ কৃষকের ২১ হাজার হেক্টর জমির ধান নষ্ট হয়েছিল।

কৃষি সংশ্লিষ্টদের মতে, ধানের জন্য ক্রিটিক্যাল টেম্পারেচার ৩৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস। কিন্তু বেশ কিছুদিন ধরে বিভিন্ন অঞ্চলে তাপমাত্রা ৪০ ডিগ্রিও ছাড়িয়ে গেছে; যা ধানের জন্য সহনীয় মাত্রার বেশি। এখন যদি দু-তিন ঘণ্টা ৮০ থেকে ৯০ কিলোমিটার বেগে গরম বাতাস বয়ে যায় তবে হিটশক হবে। ফলে ধান নষ্ট হয়ে চিটা হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। যদিও কৃষি মন্ত্রণালয় ও অধিদফতর থেকে নানা পরামর্শ দেওয়া হচ্ছে।

কৃষি মন্ত্রণালয়ের সচিব ওয়াহিদা আক্তার বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, আমরা কৃষকদের সার্বিক পরামর্শ দিতে কৃষকদের পাশে থাকতে সব কর্মকর্তাকে নির্দেশনা দিয়েছি। যেহেতু গরম বেশি, তাপমাত্রা বেশি, এতে দুশ্চিন্তা থাকলেও আমরা আশা করছি কৃষিতে সমস্যা হবে না।

কৃষি বিভাগ জানিয়েছে, বোরো ধানের ফুল ফোটার সময় (ফ্লাওয়ারিং স্টেজ) তাপমাত্রা ৩৫ ডিগ্রি সেলসিয়াসের ওপরে উঠলে ধানের জন্য ক্ষতি হয়। বতর্মানে উত্তর ও মধ্যাঞ্চলে বোরো ধানের ফ্লাওয়ারিং স্টেজ চলছে। যে কারণে হিটশকের বড় ঝুঁকি দেখছেন বিশেষজ্ঞরা।

বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউটের (ব্রি) মহাপরিচালক মো. শাজাহান কবীর বলেন, হিটশক নিয়ে মধ্যাঞ্চল আর উত্তরাঞ্চল নিয়ে দুশ্চিন্তা আছে। এখানে দুধ পর্যায়ে আছে অর্থাৎ  ফ্লাওয়ারিং পর্যায়ে ক্ষতি হয় বেশি। তবে ফ্লাওয়ারিং টাইম এগিয়ে এসেছে এটা ভালো বিষয়। ধানের ফুল ফোটা শুরু হয় সাড়ে ৯টা থেকে সাড়ে ১১টার মধ্যে যা বর্তমান তাপমাত্রা এবং আকাশ পরিষ্কার হওয়ার কারণে এগিয়ে ৮টা থেকে সাড়ে ৮টার হচ্ছে। এতে ফুল ফোটার টাইমে তামপাত্রা বেশি হচ্ছে না, যা ধানের জন্য ভালো। ফুল ফোটার পর্যায়ে ৩৫ ডিগ্রি না হওয়াতে ধান শুকিয়ে যাচ্ছে না। তবে ভয় পাচ্ছি যদি এমন তামপাত্রায় হঠাৎ কোনো শিলা বৃষ্টি, টর্নেডো বা প্রচ- ঝড় হলে ধানের ক্ষতি হবে। অতি তাপমাত্রার কারণে আবহাওয়া অধিদফতরের কয়েক দফায় ‘হিট অ্যালার্ট’ জারি করেছে।

ব্রি ও ডিএই একাধিক কর্মকর্তারা বলছেন, যখন তাপপ্রবাহ হয় এবং বৃষ্টি না থাকে, তখন ধানের জন্য ‘হিট শক’ হয়। বৃষ্টিহীন তাপপ্রবাহের সময় ধানের ফুল এলে তা শুকিয়ে যায়, চিটা হয়। হিটশক এড়াতে ব্রি’র আগাম সতর্কবার্তায় বলা হয়েছে, কাইচ থোর থেকে শক্ত দানা অবস্থায় জমিতে পর্যাপ্ত পানি ধরে রাখতে হবে। কোনোভাবেই যেন পানির ঘাটতি না হয়।

এদিকে দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে অন্যান্য ফল ও ফসল নিয়ে দুশ্চিন্তায় আছেন চাষিরা। আম, লিচুর মতো রসালো ফলের পাশাপাশি মরিচ, কচু, ভুট্টা, কলা, করলা, পাট ও বিভিন্ন সবজির ফলন নিয়ে নানা শঙ্কায় আছেন। আম উৎপাদনের জেলায় খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, অধিকাংশ আমচাষি পর্যাপ্ত অর্থের কারণে গাছে সেচ দিতে পারছেন না। বৃষ্টির অপেক্ষায় আছেন। অনেকে সেচ দিলেও আমের গুটি পড়ে যাওয়ায় চিন্তায় আছেন। রোদের তীব্রতায় ঝরে পড়ছে আমের গুটি। পাশাপাশি লিচু শুকিয়ে ঝরে পড়ছে। অতিরিক্ত খরায় পাট-মরিচসহ মাঠের ফসল নিয়ে দুশ্চিন্তায় পড়েছেন চাষিরা। ভূ-গর্ভস্থ পানির স্তর নিচে নেমে যাওয়ায় সেচ নিয়ে বিপাকে পড়েছেন অনেকে। একাধিক চাষি জানান, এই সময়ে মাঠে পানি প্রয়োজন। টানা রোদে ফসলের মাঠ ফেটে গেছে অনেক স্থানেই। পানি দিলে মুহূর্তেই শুকিয়ে যাচ্ছে। এতে সেচ দিয়েও অনেক জমির ফসল ভালো রাখা যাচ্ছে না, সেচের খরচ পড়ে যাচ্ছে বেশি। ফলন নিয়ে আশঙ্কা প্রকাশ করে একাধিক কৃষি কর্মকর্তা বলেছেন, এবারের অতিরিক্ত গরমের কারণে আম ও লিচুর ফলন কম হবে। অন্যান্য সবজিতেও এর প্রভাব পড়বে। অনেক স্থানে মাঠেই ফসল নষ্ট হয়ে গেছে। সাধারণ কৃষক এতে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন। কদিন পর সবজি বা ফসল নষ্ট হওয়ার প্রভাব বাজারে পড়বে বলেও জানান।

উত্তরাঞ্চলে খোঁজ নিয়ে জানা যায়, দাবদাহ ও খরতাপে কৃষকের ফসল পুড়ে নষ্ট হচ্ছে। ক’দিন পরেই চরাঞ্চলের কৃষকদের ঘরে উঠত বাদাম। প্রখর রোদে খেতেই শুকিয়ে যাচ্ছে। সেচ দিয়েও কাজে আসছে না। লালমনিরহাটের কৃষক ওয়াহাব উদ্দিন জানান, ভুট্টা নিয়ে কষ্টে আছি। মুচি পরিপক্ব হওয়ার সময় থেকে প্রচ- তাপ। পানি দিতে পারছি না যতটুকু দরকার। ভুট্টার গাছসহ মুচি মরে যাচ্ছে।

কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের মহাপরিচালক বাদল চন্দ্র বিশ্বাস বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, আমরা নিয়মিত পরামর্শ দিচ্ছি। আমাদের কর্মকর্তারা বিভিন্ন বাগান নিয়মিত দেখছেন। আম লিচু গাছের গোরায় পানি দিতে বলছি, গাছের পাতায় পানি দিতে বলেছি। এতে ঝরে পড়ার প্রবণতা কমবে। যারা বাণিজ্যিক চাষ করেছে তারা উদ্যোগ নিচ্ছে তবে অনেক স্থানে সেচ দিলেও ঝরে যাচ্ছে। তামপাত্রার ক্ষতি নিয়ে ডিএই মহাপরিচালক আরও বলেন, আমাদের সবজিতেও একটা প্রভাব পড়বে কেননা সবজি সবগুলোই তো পানির ফসল। ধানেও আমরা পরামর্শ দিচ্ছি, সেচ দিতে বলেছি, এতে খরচও একটু বাড়বে। তাপমাত্রার ক্ষতির ফলাফলটা পেতে একটু সময় লাগবে। মরিচ-পাট এসব ফসলের বৃদ্ধিটা পানির কারণে কম হচ্ছে তবে দ্রুত আবহাওয়ার পরিবর্তন হলে অন্যান্য ফসলগুলো ক্ষতি একটু কম হবে।

সর্বশেষ খবর