বৃহস্পতিবার, ৯ মে, ২০২৪ ০০:০০ টা

কেমন আছেন আশ্রিতরা

সরেজমিনে মিল্টনের চাইল্ড অ্যান্ড ওল্ড এজ কেয়ার

মাহবুব মমতাজী, সাভার থেকে ফিরে

কেমন আছেন আশ্রিতরা

ঢাকার অদূরে সাভারের বিরুলিয়া ইউনিয়নের কমলাপুর বাহেরটেক গ্রাম। আশপাশের প্রায়  দুই কিলোমিটারের মধ্যে দোকানপাট কিংবা হাটবাজার বলতে কিছু নেই। সবুজ গাছগাছালিতে ঘেরা এই গ্রামে প্রায় ৬৫ শতাংশ জমির ওপর গড়ে তোলা হয়েছে ছয় তলা ভবন। পাশে আরও বেশ কয়েকটি টিনশেড ঘর। এটিই মিল্টন সমাদ্দারের চাইল্ড অ্যান্ড ওল্ড এজ কেয়ার। এর ঠিক পশ্চিমে সাভারের রাজাসন গ্রাম।

চাইল্ড অ্যান্ড ওল্ড এজ কেয়ারের চেয়ারম্যান মিল্টন সমাদ্দার মামলায় গ্রেফতার হওয়ার পর এখন পুলিশ রিমান্ডে। পুলিশ বলছে, মিল্টন সমাদ্দারের কর্মকান্ড ভয়ানক। তদন্তে নানা অপরাধের কাহিনি বেরিয়ে আসছে। তবে চাইল্ড অ্যান্ড ওল্ড এজ কেয়ারের আশ্রিতরা বলছেন ভিন্ন কথা। তারা বলছেন, মিল্টন সমাদ্দারের জন্য তারা অপেক্ষায় আছেন।

চাইল্ড অ্যান্ড ওল্ড এজ কেয়ারে এখন স্টাফ মিলে ১৭১ জন রয়েছেন। গতকাল এই আশ্রমে গেলে কথা হয় আশ্রিতদের সঙ্গে। তারা মিল্টনকে ঘিরে দিয়েছেন আবেগঘন বর্ণনা। তারা যেন অপেক্ষার প্রহর গুনছেন মিল্টন সমাদ্দারের জন্য।

আশ্রমটির দ্বিতীয় তলায় থাকেন বয়স্ক মহিলারা। তৃতীয় তলায় বয়স্ক পুরুষরা। চতুর্থ তলায় সুস্থ ও প্রতিবন্ধী শিশুরা। পঞ্চম ও ষষ্ঠ তলায় প্রতিবন্ধী এবং অসুস্থ নারীরা। ভবনটির নিচতলার উত্তরে বিভিন্ন মালামালের স্টোর এবং দক্ষিণে ইমার্জেন্সি রুম, ড্রেসিং রুম। এ ছাড়া আছে অফিস ও অভ্যর্থনা কক্ষ।

সোমবার থেকে এই আশ্রমটির দেখভালের দায়িত্ব পেয়েছে আলহাজ শামসুল হক ফাউন্ডেশন। এই ফাউন্ডেশনের প্রকল্প কর্মকর্তা লোকমান হাকিম এ প্রতিবেদককে জানান, এখানে তারা বয়স্ক পুরুষ পেয়েছেন ৫১ জন, মহিলা ৫৩ জন, শিশু ২৮ জন এবং স্টাফ ৩৯ জন। তবে শিশুদের মধ্যে ৮ জন সুস্থ, অন্যরা প্রতিবন্ধী। এই আশ্রম থেকেই সাতজন শিশু শমরিতা শিশু পল্লী নামের একটি স্কুলে লেখাপড়া করছে।

সরেজমিনে দেখা যায়, প্রতিবন্ধী ও অসুস্থদের খাইয়ে দিতে, তাদের গোসল, ড্রেসিং এবং প্রস্রাব-পায়খানা পরিষ্কার করার জন্য আলাদা আলাদা স্টাফ রাখা হয়েছে। প্রতিটি ওয়ার্ডে সার্বক্ষণিক দেখভালের জন্য একজন নারী এবং পুরুষ ওয়ার্ডের জন্য একজন পুরুষ দায়িত্ব পালন করছেন। ছয় তলা ভবনটির দক্ষিণে টিনশেডে অন্তত ১০টি স্টাফ ঘর এবং একটি নামাজের ঘর আছে। পশ্চিম পাশে প্রায় ১৫ শতাংশ জমিতে কবরস্থান। সামনে ফাঁকা মাঠ। মাঠের উত্তরে গাড়ির গ্যারেজ, ক্যান্টিন ও রান্নাঘর।

দোতলায় চারটি মহিলা ওয়ার্ড। ৪ নম্বর মহিলা ওয়ার্ডে আছেন ১২ জন বয়স্ক নারী। দরজার পাশেই শামসুন নাহার নামে এক নারীর বিছানা। তার বয়স আনুমানিক ৬০ বছর। তিনি দুপুরের খাবার খেয়ে বসে হাতে তসবিহ গুনছিলেন। তিনি বললেন, ‘আমি আমার বাবাকে (মিল্টন) ছাড়া ভালো নাই, তাকে ছাড়া ভালো থাকি কি করে। আমার বাবা যখনই আসতো মা বলে একটা ডাক দিতো, এতে মনটা জুড়ায় যাইতো।’

তৃতীয় তলায় ৩ নম্বর পুরুষ ওয়ার্ডে ঢুকতেই হাতের বামে বিছানায় শুয়ে ছিলেন দেলোয়ার হোসেন নামে এক ব্যক্তি। তার বয়স আনুমানিক ৬৫ বছর। এ প্রতিবেদককে দেখেই হামাগুড়ি দিয়ে উঠে বসলেন। হাঁটাচলায় অক্ষম তিনি। প্রস্রাবের জন্য ক্যাথেটার লাগানো আছে, পায়খানা বিছানাতেই করেন তিনি। আবেগ আপ্লুত হয়ে দেলোয়ার হোসেন বলেন, আমার বাড়ি শেরপুরের নকলা উপজেলার ৬ নম্বর ইউনিয়নে। আমি রিকশা চালাইতাম। আমার একটা ছেলে, সে সিএনজি চালায়। আমরা থাকতাম তেজগাঁও নাখালপাড়ায়। আমার নিতম্বে বড় একটা ঘা হয়, এই ঘায়ে পচন ধরে দুর্গন্ধ হলে আমার ছেলে ও ছেলের বউ আমাকে বাইরে রেখে আসে। এরপর আমার ছেলের বন্ধু আমার দুর্দশা দেখে মিল্টনের সেন্টারে ফোন দেয়। পরে মিল্টন গাড়ি নিয়ে গিয়ে আমাকে নিয়ে আসে। আমি হাঁটতে পারি না, গোসল করতে পারি না, নিজ হাতে খাইতে পারি না। মিল্টন তার এখানে আমাকে এনে নিজ হাতে আমার ঘায়ে ড্রেসিং করানো, আমার পায়খানা পরিষ্কার করানো, গোসল, খাওয়া সব করছে। আমার নিজের ছেলেও এসব করেনি। আমরা আমার বাবাকে ফেরত চাই।

দেলোয়ার হোসেন কাঁদতে কাঁদতে যখন এসব বলছিলেন তখন তার পাশের তিনটি বেডের ব্যক্তিরাও কাঁদছিলেন। এদের মধ্যে আবদুর রশিদ নামে এক ব্যক্তি বলেন, আমি রাজশাহীর একটি স্কুলে শিক্ষকতা করতাম। আমার ছেলের কাছে আমার আশ্রয় হয়নি। মিল্টন আমাকে আশ্রয় দিয়েছে।

চতুর্থ তলায় ১ ও ২ নম্বর ওয়ার্ডের শিশুরা যে যার বিছানায় শুয়ে ছিল, কেউ খেলছিল। লোকজন দেখে কাছে ছুটে আসে তারা। পাশে বিছানায় উপুড় হয়ে কাঁদছিল আঁখি নামের এক মেয়ে। ‘আমার বাবাকে চাই, বাবাকে চাই, বাবা কখন আসব।’ কোন বাবাকে চাচ্ছে জানতে চাইলে অন্যরা সবাই বলে উঠে মিল্টন সমাদ্দার আমাদের বাবা। পাশের ৩ ও ৪ নম্বর ওয়ার্ডটিতে নিরাপত্তা বেষ্টনী লাখানো বিছানায় শোয়া ২০ জন প্রতিবন্ধী শিশু। এরা সবাই প্রস্রাব ও পায়খানা বিছানাতেই করে। সঙ্গে সঙ্গে স্টাফদের একজন পরিষ্কার করছেন। ওয়ার্ডের ফ্লোরও সঙ্গে সঙ্গে মুছে ফেলা হয়।

মিল্টনের এই চাইল্ড অ্যান্ড ওল্ড এজ কেয়ারে প্রায় দুই বছর ধরে সুপারভাইজারের দায়িত্বে আছেন আলমগীর হোসেন। তিনি বলেন, এখানে থাকা মানুষের সবার খাওয়ার পর আমরা খাই। যারা সুস্থ তারা ক্যান্টিনে খান, আর অন্যদের ওয়ার্ডে গিয়ে খাইয়ে দিতে হয়। তবে বেশির ভাগই নিজ হাতে খেতে পারে না।

প্রতিষ্ঠানটির স্টাফদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, আশ্রিতদের জন্য প্রতিদিন সকালে সবজি খিচুড়ি, দুপুরে কখনো মাছ, মুরগি ও মাংস থাকে। বিকালে নাশতা এবং রাতে সবজি দিয়ে ভাত। যারা রাস্তায় পড়ে থাকে, অভিভাবক নাই, যাদের দেখার মতো কেউ নাই, একেবারেই অচল, রাস্তায় পড়ে থেকে শরীরের বিভিন্ন অংশে পচে গেছে শুধু তাদেরই এখানে আশ্রয়, খাদ্য ও চিকিৎসা দেওয়া হয়। যারা বিভিন্নভাবে আঘাত পেয়ে চিকিৎসা সুবিধা পাননি, ফলে দীর্ঘদিনের ক্ষত অংশ পচে গিয়ে পোকায় ধরেছে। তাদের শরীরের পচা অংশে প্রতিদিন পরিষ্কার করে ওষুধ দেওয়া হয়। ফলে তাদের অনেকেই সুস্থ হয়ে উঠছেন। আশ্রমের শিশু, বৃদ্ধ নারী-পুরুষ সবাই মিল্টনকে ‘বাবা’ বলে সম্বোধন করেন।

নানা অভিযোগে ১ মে গ্রেফতার হন আলোচিত ‘চাইল্ড অ্যান্ড ওল্ড এজ কেয়ারের’ চেয়ারম্যান মিল্টন সমাদ্দার। তার বিরুদ্ধে হওয়া তিনটি মামলায় দ্বিতীয় দফায় তাকে রিমান্ডে নিয়ে বিভিন্ন অভিযোগ সম্পর্কে জানার চেষ্টা করেন ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের (ডিবি) কর্মকর্তারা। এরই মধ্যে মিল্টন সমাদ্দারের স্ত্রী মিতু হালদারকেও জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়েছে।

সর্বশেষ খবর