শনিবার, ১১ মে, ২০২৪ ০০:০০ টা

চট্টগ্রাম শিক্ষা বোর্ডে তুঘলকি কাণ্ড

ফল জালিয়াতি করে শাস্তি পাওয়া সিস্টেম অ্যানালিস্টকে ফের একই কাজে নিয়োগ তদন্ত চলছে সচিবের বিরুদ্ধেও

আকতারুজ্জামান

কারিগরি শিক্ষা বোর্ডে সার্টিফিকেট জালিয়াতির ঘটনা জানাজানি হওয়ার পর মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক শিক্ষা বোর্ড, চট্টগ্রামে তুঘলকি কান্ড ঘটেছে। পাবলিক পরীক্ষার ফল জালিয়াতির দায়ে যে সিস্টেম অ্যানালিস্টকে শাস্তির আওতায় এনেছিল সরকার, চাকরি জীবন শেষ করার পর পিআরএলে যাওয়া সেই জালিয়াত সিস্টেম অ্যানালিস্ট কিবরিয়া মাসুদ খানকে ফের চুক্তিতে নিয়োগ দিয়েছেন চট্টগ্রাম শিক্ষা বোর্ডের সচিব অধ্যাপক নারায়ণ চন্দ্র নাথ। আর এ সচিব নারায়ণ চন্দ্র নাথের বিরুদ্ধেও রয়েছে পাবলিক পরীক্ষার ফল জালিয়াতির অভিযোগ। মন্ত্রিপরিষদ সচিব বরাবর বীর মুক্তিযোদ্ধা ডা. মাহফুজুর রহমান এ সংক্রান্ত একটি অভিযোগ করলে মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা অধিদফতরকে (মাউশি) দ্রুত অভিযোগ তদন্তের নির্দেশ দিয়েছে শিক্ষা মন্ত্রণালয়। এ তদন্ত কমিটির প্রধান করা হয়েছে মাউশির মনিটরিং অ্যান্ড ইভালুয়েশন উইংয়ের পরিচালক অধ্যাপক আমির হোসেনকে। তথ্যমতে, চট্টগ্রাম শিক্ষা বোর্ডে ২০২১ সালে এইচএসসি পরীক্ষার ফলাফলে অসংগতি ও জালিয়াতির অভিযোগ ওঠে। এ অভিযোগ তদন্তে কমিটি করেছিল সরকার। তদন্ত কমিটির প্রতিবেদনে বলা হয়, চট্টগ্রাম বোর্ডের সব শিক্ষার্থী ওই বছর ১৩ ফেব্রুয়ারি দুপুর ১২টায় ফলাফল পেলেও বিকালে অনেকের ফলাফলে ভিন্নতা দেখা যায়।

জালিয়াতি করে তখন ফল পরিবর্তন করা হয় কিছু শিক্ষার্থীর। একজন শিক্ষার্থীকে পদার্থবিজ্ঞানে ২০০ নম্বরের মধ্যে দেওয়া হয় ২১৮ নম্বর। এ ছাড়াও তিনজন শিক্ষার্থী পরীক্ষার মোট নম্বরের চেয়ে বেশি নম্বর পান। অনেক শিক্ষার্থী তৎকালীন চেয়ারম্যানের বিরুদ্ধে অভিযোগ করেন তাদের ফল পরিবর্তনের বিষয়ে। এ অনিয়মের ঘটনায় তখন চট্টগ্রাম শিক্ষা বোর্ডের ৯৭ হাজার ৪৩৬ জন পরীক্ষার্থীর ফল পরিবর্তন হয়ে যায়। অভিযোগ ছিল, অভিযুক্ত সিস্টেম অ্যানালিস্টের সন্তান এসএসসি পরীক্ষার্থী হওয়ার পরও বিধি ভঙ্গ করে বিজি প্রেসে গমনসহ গোপনীয় কাজ করেছিলেন সিস্টেম অ্যানালিস্ট কিবরিয়া মাসুদ খান।

তখন শিক্ষা সচিব বরাবর লেখা চিঠিতে তৎকালীন শিক্ষা বোর্ডের সচিব অধ্যাপক আবদুল আলিম জানান, পরীক্ষার বিধি লঙ্ঘন করে বিশাল অঙ্কের আর্থিক ক্ষতি করেছেন সিস্টেম অ্যানালিস্ট কিবরিয়া মাসুদ খান। ফলাফলে ব্যাপক পরিবর্তন হওয়ার পরও তিনি ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে অবগত করেননি। আর তৎকালীন পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক নারায়ণ চন্দ্র নাথ প্রতিটি ক্ষেত্রে নন টেকনিক্যাল পার্সন বলে দায় এড়ানোর চেষ্টা করেছেন। তার অদক্ষতার কারণে অন্য পাবলিক পরীক্ষা নিয়েও শঙ্কা তৈরি হয় বলে জানিয়েছিলেন বোর্ডের তখনকার সচিব।

ফল জালিয়াতির অভিযোগ আসার পর গঠিত তদন্ত কমিটির প্রতিবেদনে বলা হয়, ফলাফল প্রস্তুতের সঙ্গে জড়িতরা যথাযথ প্রক্রিয়া অনুসরণ না করে ফলাফল তৈরি করেন। দুপুর ১২টায় ফল প্রকাশের পর দুপুর ২টায় ফল অসংগতির অজুহাতে পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক (বর্তমান সচিব) ও আইটি টিমের সদস্যরা ফলাফল প্রসেসিং রুমে প্রবেশ করেছিলেন। পরে তারা আবার রাতে এই রুমে ঢোকেন। বোর্ডের নীতিমালার ব্যত্যয় ঘটিয়ে তারা নিজেরাই ফলাফলের সংশোধনের কাজ করেন। এ তদন্ত প্রক্রিয়া তৎকালীন পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক (বর্তমান সচিব) নারায়ণ চন্দ্র নাথ বাধাগ্রস্ত করেছিলেন বলে অভিযোগ আনা হয়।

 

পাবলিক পরীক্ষার ফল জালিয়াতির ঘটনায় সে সময় তদন্ত প্রতিবেদনে সিস্টেম অ্যানালিস্ট কিবরিয়া মাসুদ খানের বিরুদ্ধে দায়িত্ব পালনে অবহেলা প্রমাণিত হওয়ায় তাকে শাস্তির আওতায় আনা হয়।

২০২২ সালের জুলাইয়ে চট্টগ্রাম শিক্ষা বোর্ডের তৎকালীন চেয়ারম্যান অধ্যাপক মুস্তফা কামরুল আখতার স্বাক্ষরিত চিঠিতে এইচএসসি পরীক্ষার ফলাফল অসংগতি করার দায়ে সিস্টেম অ্যানালিস্ট কিবরিয়া মাসুদ খানের বিরুদ্ধে বিভাগীয় ব্যবস্থা নেওয়ার কথা জানানো হয়। আর ফলাফল প্রকাশে অসংগতির জন্য দায়ী করা হয় পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক নারায়ণ চন্দ্র নাথকে। অভিযুক্ত নারায়ণ চন্দ্র নাথ এখন চট্টগ্রাম শিক্ষা বোর্ডের সচিবের দায়িত্বে রয়েছেন।

জালিয়াতি করে শাস্তি পাওয়া ব্যক্তিকে ফের ফলাফল প্রস্তুতকরণ কাজের জন্য শিক্ষা বোর্ডে নিয়োগ দেওয়ায় শিক্ষা সংশ্লিষ্টরা চট্টগ্রাম বোর্ডের নির্ভুল ফল প্রকাশে সংশয় প্রকাশ করেছেন। চট্টগ্রাম শিক্ষা বোর্ডের সচিব নারায়ণ চন্দ্র নাথ এ জালিয়াতকে দৈনিক ২ হাজার টাকা হারে সম্মানি প্রদানের শর্তে নিয়োগ দিয়েছেন।

এদিকে চট্টগ্রাম শিক্ষা বোর্ডের সচিব ও সাবেক পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক অধ্যাপক নারায়ণ চন্দ্র নাথের বিরুদ্ধেও পরীক্ষার ফল জালিয়াতির অভিযোগে তদন্ত কমিটি করেছে সরকার। অভিযোগ রয়েছে, গত বছরের নভেম্বরে এইচএসসি পরীক্ষার ফল প্রকাশিত হয়। বর্তমান সচিবের ছেলে এইচএসসি পরীক্ষার্থী থাকলেও তিনি পরীক্ষার ফলাফল তৈরিসহ বিভিন্ন গোপনীয় কাজে যুক্ত ছিলেন। এ তদন্ত কমিটির আহ্বায়ক হিসেবে রয়েছেন মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা অধিদফতরের পরিচালক অধ্যাপক মো. আমির হোসেন। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক সূত্র জানায়, খুব শিগগিরই তদন্তকাজ পরিচালনা করতে চট্টগ্রাম শিক্ষা বোর্ডে যাবে দলটি। ফল জালিয়াতির দায়ে শাস্তি পাওয়া সিস্টেম অ্যানালিস্ট কিবরিয়া মাসুদ খানকে ফলাফল তৈরির কাজে নিয়োগ দেওয়া প্রসঙ্গে চট্টগ্রাম শিক্ষা বোর্ডের সচিব নারায়ণ চন্দ্র নাথ বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, শাস্তি পাওয়ার পরও চারবার বোর্ডের ফল প্রস্তুতির কাজে নিয়োজিত ছিলেন তিনি। চট্টগ্রাম শিক্ষা বোর্ডে বর্তমানে লোকবল সংকট রয়েছে। শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের নির্দেশনা নিয়েই আমরা তাকে ফল প্রস্তুত কাজে নিয়োজিত করেছি। তার বিরুদ্ধে পাবলিক পরীক্ষার ফল জালিয়াতির অভিযোগ প্রসঙ্গে সচিব নারায়ণ চন্দ্র নাথ বলেন, আমার সন্তান পরীক্ষার্থী থাকায় আমি পরীক্ষা বা ফল প্রস্তুতকরণ সংক্রান্ত গোপনীয় কাজে জড়িত ছিলাম না। ফলপ্রকাশের এক মাস আগে আমি শিক্ষা বোর্ডের সচিবের দায়িত্ব পেয়েছি। আর সচিবের পরীক্ষা সংক্রান্ত কাজে কোনো সংশ্লিষ্টতা থাকে না। তার বিরুদ্ধে করা অভিযোগ, ধারাবাহিক ষড়যন্ত্রের একটি অংশ বলেও দাবি করেন তিনি।

সর্বশেষ খবর