শিরোনাম
বৃহস্পতিবার, ১৬ মে, ২০২৪ ০০:০০ টা

ঠেকানোই যাচ্ছে না বাল্যবিয়ে

১৮-এর আগেই বিয়ে ৪৪ শতাংশ মেয়ের, কৌশলে বয়স বাড়িয়ে দেওয়া হচ্ছে, বাল্যবিয়ে রোধে আন্দোলন জোরদারের দাবি বিশেষজ্ঞদের

জিন্নাতুন নূর

দেশে আইন করে, অভিযুক্তদের শাস্তির আওতায় এনে কোনোভাবেই বাল্যবিয়ে ঠেকানো যাচ্ছে না। উল্টো পরিণত বয়সে পৌঁছার আগেই কন্যাশিশুরা বাল্যবিয়ের বলি হচ্ছে। প্রত্যন্ত গ্রামাঞ্চল, চরাঞ্চল এবং দরিদ্র পরিবারের অভিভাবকরা নিজেদের কন্যাশিশুদের ভবিষ্যতের কথা চিন্তা না করেই বিয়ে দিয়ে দিচ্ছেন। পিছিয়ে নেই সচ্ছল পরিবারের অনেক অভিভাবকও। প্রশাসনকে ফাঁকি দিতে বাল্যবিয়ের ক্ষেত্রে অভিভাবকরা কৌশলে মেয়ের বয়স বাড়িয়ে বিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করছেন। এ ক্ষেত্রে কিছু স্থানীয় কাজি এ অপরাধে অভিভাবকদের সহায়তা করছেন।

বিশেষজ্ঞরা জানান, দরিদ্র পরিবারের উপার্জন কমে যাওয়া, শহর থেকে অনেক পরিবারের গ্রামে স্থানান্তর হওয়া, অসচেতনতা, কন্যাসন্তানের ভরণপোষণ ও নিরাপত্তা দিতে না পারা, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান দীর্ঘদিন বন্ধ থাকা, মহামারিতে কম খরচে এবং যৌতুক ছাড়া কন্যার বিয়ে দেওয়ার প্রবণতা শুরুর পর অভিভাবকরা সন্তানের বাল্যবিয়ে দেওয়ার ক্ষেত্রে আর বিচারবিবেচনা করছেন না।

এ ব্যাপারে নারী নেত্রীরা বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ‘বাল্যবিয়ে রোধে দেশের সব স্কুলে বাধ্যতামূলকভাবে মেয়ে ও নারীদের সম্মান করার জন্য একটি মডেলিং ব্যবস্থা চালু করা উচিত। কমিউনিটি পুলিশিংয়ে মেয়েদের বিষয়টিকে অগ্রাধিকার দিতে হবে। দেশে কমিউনিটি পুলিশিং বিষয়টি থাকলেও কার্যকর নয়। একে কার্যকর করতে হবে। আর কার্যকর করার ক্ষেত্রে মেয়েদের নিরাপত্তার বিষয়টিকে অগ্রাধিকার দিতে হবে।’ ‘নারীপক্ষ’-এর প্রতিষ্ঠাতা আহ্বায়ক শিরিন হক বলেন, ‘বাল্যবিয়ে রোধে নারী নেত্রীদেরও দুর্বলতা আছে। এটি প্রতিরোধে আমাদের যে লড়াই করার কথা ছিল তা করছি না। এটি আমাদের এক ধরনের ব্যর্থতা। নারী সংগঠন ও এ আন্দোলনে সম্পৃক্তদের ব্যাপারটিতে আরও গুরুত্ব দিতে হবে।’

বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএন)-এর ‘বাংলাদেশ স্যাম্পল ভাইটাল স্ট্যাটিসটিক্স ২০২৩’ শিরোনামে জরিপের ফলাফলের তথ্য বলছে, ২০২৩ সালে ১৫ বছর বয়সের আগেই দেশের ৮ শতাংশের বেশি মেয়েশিশুর বিয়ে দিয়ে দেওয়া হয়। আর ১৮ বছরের আগে বিয়ে হয়েছে এমন মেয়েশিশুর হার প্রায় ৪২ শতাংশ। গ্রামের দিকে এ হার ৪৪ দশমিক ৪ শতাংশ। অর্থাৎ গ্রামে বাল্যবিয়ের প্রবণতা বেশি। তবে শহরাঞ্চলেও বাল্যবিয়ে ঠেকানো যাচ্ছে না। গ্রাম ও শহরের বাল্যবিয়ের পরিস্থিতি বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, শহরের ১৫ বছরের কম বয়সী মেয়েশিশুর বিয়ের হার ২০২৩ সালে ছিল ৬ দশমিক ৮ শতাংশ। আর ২০২২ সালে ৫ দশমিক ৩ শতাংশ। অন্যদিকে গ্রামের পরিস্থিতি বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, গ্রামে এ বয়সের মেয়েশিশুর বিয়ের ঘটনা ২০২৩ সালে ছিল ৮ দশমিক ৮ শতাংশ; যা ২০২২ সালে ছিল ৬ দশমিক ৯ শতাংশ। আর ২০২৩ সালে ১৮ বছরের কম বয়সী ৪১ দশমিক ৬ শতাংশ মেয়েশিশুর বিয়ে হয়েছে। ২০২২ সালে এ হার ছিল ৪০ দশমিক ৯ শতাংশ। ওপরের তথ্য অনুযায়ী, বাল্যবিয়ের হার গ্রাম-শহর উভয় স্থানেই বেড়েছে।

বাল্যবিয়ে নিরোধ আইন-২০১৭ অনুযায়ী নারীর বিয়ের ন্যূনতম বয়স ১৮ বছর। কিন্তু বাস্তবে এটি মানা হচ্ছে না। অভিভাবকরা নানা কৌশলে মেয়ের বয়স বাড়িয়ে এবং কখনো গোপনে মেয়ের বিয়ের আয়োজন করছেন। এ কাজে তাদের সহযোগিতা করছেন স্থানীয় অনেক কাজি। কিছু ক্ষেত্রে কন্যাশিশু বাল্যবিয়েতে রাজি না হলে তাকে জোর করে পরিবার বিয়ে দিয়ে দিচ্ছে। অনেক কন্যাশিশু সাহস করে নিজের বাল্যবিয়ে বন্ধে পুলিশ ও প্রশাসনের সাহায্য চাইলেও বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই মেয়েরা এ সাহস দেখাতে পারে না। কেউ কেউ সাহস দেখালেও পরে আবার তাকে বাল্যবিয়ে দেওয়া হয়। বিবিএসের জরিপ বলছে, দেশে নারীপ্রধান খানার সংখ্যা বাড়ছে। আর যে পরিবারে নারী একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তি সেখানে সেই নারী নিজের মেয়েকে নিয়ে নানা রকম দুশ্চিন্তার মধ্যে থাকেন। এজন্য নিজের পরিবার ও মেয়ের নিরাপত্তার কথা ভেবে তাকে আগেই বিয়ে দিয়ে দেন। জরিপে বাল্যবিয়ের কারণ হিসেবে অভিভাবকদের মধ্যে সামাজিক নিরাপত্তার অভাব, দারিদ্র্য, সচেতনতার অভাব এ কারণগুলোই উঠে এসেছে। অনেক ক্ষেত্রে মেয়ের বয়স লুকিয়ে আদালতের মাধ্যমে বিয়ে দেওয়ার ঘটনাও ঘটছে। এতে বিয়ের আনুষ্ঠানিকতার জন্য যে ব্যয় হয় তা এড়ানো যায় বলে অনেক অভিভাবকও বাল্যবিয়েতে সহযোগিতা করেন। কুমিল্লার হোমনা উপজেলায় চলতি মাসের প্রথম সপ্তাহে কনের বয়স বাড়িয়ে ভুয়া এফিডেভিট তৈরি করে বাল্যবিয়ে পড়ানোর অপরাধে কাজি নূরুল ইসলামকে ছয় মাসের জেল ও ৫০ হাজার টাকা জরিমানা করেছেন ভ্রাম্যমাণ আদালত। মানবাধিকারকর্মী অ্যাডভোকেট এলিনা খান বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ‘অনেকেই আছেন যারা জন্মনিবন্ধনে শুধু তারিখ ঠিক রেখে সন্তানের জন্ম সাল পরিবর্তন করে বিয়ে দিয়ে দেন। এটি রোধ করতে আমাদের হাসপাতালগুলোয় কোনো শিশুর জন্ম হলে সঙ্গে সঙ্গে তার নাম নিবন্ধন করা বাধ্যতামূলক করতে হবে। কোনো শিশুর জন্ম যদি বাড়িতে হয় তাহলে বাধ্যতামূলকভাবে সে এলাকার চেয়ারম্যান ও কাউন্সিলর দিয়ে তার জন্মনিবন্ধন করাতে হবে। কেউ যদি তার পরও অবৈধভাবে জাল সার্টিফিকেট দিয়ে কোনো কন্যাশিশুর বিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করে তাহলে সেই শিশুটির বিয়ে যে কাজি পড়াবেন তাকে কঠিন শাস্তির আওতায় আনার ব্যবস্থা করতে হবে।’

সর্বশেষ খবর