রবিবার, ১৯ মে, ২০২৪ ০০:০০ টা

বাঘের অঙ্গ যায় কোথায়

জিন্নাতুন নূর

বাঘের অঙ্গ যায় কোথায়

বাঘ শিকারিরা এক সময় বাংলাদেশ থেকে বিদেশে পাচার করতেন বিপন্ন রয়েল বেঙ্গল টাইগার ও এর দেহের বিভিন্ন অঙ্গপ্রত্যঙ্গ। কিন্তু এখন ঘটছে উল্টোটা। বিদেশে চোরাচালান হচ্ছে, পাশাপাশি অন্য দেশ থেকে চোরাপথে বাংলাদেশে আসছে হলুদ-কালো ডোরাকাটা এই প্রাণীর নানা অঙ্গপ্রত্যঙ্গ। উল্টো পাচারের এ ঘটনা খুব বেশি দিনের নয়। আন্তর্জাতিক জার্নাল সোসাইটি ফর দ্য কনজারভেশন বায়োলজিতে প্রকাশিত ‘টাইগারস অ্যাট এ ক্রসরোডস : শেডিং লাইট অন দ্য রোল অব বাংলাদেশ ইন দ্য ইলিগ্যাল ট্রেড অব দিস আইকনিক বিগ ক্যাট’ শীর্ষক গবেষণায় এমনটি উল্লেখ করা হয়েছে। এতে আরও বলা হয়েছে, এই বিপন্ন প্রাণীটির দেহের বিভিন্ন অঙ্গপ্রত্যঙ্গ দেশ থেকে বিদেশে চোরাচালানের জন্য পাঠানোর পাশাপাশি দেশেও এর অবৈধ বাজার গড়ে উঠেছে। দেশে অবস্থানরত বিদেশি নাগরিকরা ছাড়াও স্থানীয় ধনী ব্যক্তিদের এই বাজারে ক্রেতা হিসেবে অংশগ্রহণ বাড়ছে। যার অর্থ বাংলাদেশ এখন শুধু বাঘের অঙ্গপ্রত্যঙ্গ রপ্তানিই করছে না, আমদানিও করছে। বাংলাদেশের চাহিদা মেটানোর জন্য ভারত ও মিয়ানমারে বাঘ শিকার পর্যন্ত হচ্ছে।

পৃথিবীর যেসব দেশে রয়েল বেঙ্গল টাইগারের অস্তিত্ব হুমকির মুখে রয়েছে বাংলাদেশ তার অন্যতম। গবেষণায় আরও জানানো হয়, ঐতিহাসিকভাবেই বাংলাদেশ জীবিত বাঘ এবং এর শরীরের অঙ্গপ্রত্যঙ্গের একটি প্রধান সরবরাহকারী দেশ হিসেবে কাজ করে। এ গবেষণার প্রধান লেখক নাসির উদ্দিন বলেন, কিন্তু সম্প্রতি একটি উদ্বেগজনক প্রবণতা দেখা দিয়েছে। বাংলাদেশে বসবাসকারী ধনী এবং বিদেশি ধনী নাগরিক উভয়ের মধ্যেই বাঘের অঙ্গপ্রত্যঙ্গের অভ্যন্তরীণ ব্যবহার বৃদ্ধি পেয়েছে। তিনি বলেন, মূলত বাংলাদেশ এবং তার পার্শ্ববর্তী দেশের মধ্যে ঘনিষ্ঠ সামাজিক ও সাংস্কৃতিক বন্ধনের জন্য দুই দেশের বাঘ এবং এর অঙ্গপ্রত্যঙ্গ পাচার হচ্ছে।   গবেষণাটি থেকে আরও জানা যায়, বাংলাদেশ একদিকে যেমন বাঘের বিভিন্ন অঙ্গপ্রত্যঙ্গ ক্রয় করছে তেমনি অবৈধভাবে বাঘের বিভিন্ন অঙ্গপ্রত্যঙ্গ বিক্রির জন্য বিশ্বব্যাপী একটি ‘ট্রানজিট হাব’-এও পরিণত হয়েছে। দেশের অভিজাত শ্রেণির স্থানীয় চাহিদা মেটানো, বৈশ্বিক সংযোগ এবং বাঘের বিভিন্ন পণ্যের প্রতি সাংস্কৃতিক মুগ্ধতা আর উন্নত পরিবহন অবকাঠামোর কারণে বাঘ পাচারের মতো অবৈধ কার্যক্রম থামানো যাচ্ছে না। এ ছাড়া বিমানবন্দর, সমুদ্রবন্দর এবং স্থল সীমান্ত ক্রসিংয়ের মাধ্যমে বাংলাদেশ থেকে বাঘের বিভিন্ন অংশ পাচার হচ্ছে। আবার আন্তর্জাতিক পরিবহন সংযোগ দ্রুত সম্প্রসারণ হওয়ায় এ চোরাচালান আরও সহজ হয়ে উঠেছে। স্থানীয় চোরাকারবারিরাও বিশ্বব্যাপী একটি নেটওয়ার্কের মাধ্যমে ক্রেতা ও বিক্রেতাদের সঙ্গে যুক্ত আছে। এর ফলে অবৈধ এ কার্যক্রমের মাত্রা বৃদ্ধি পেয়েছে।

গত দুই দশকে বাঘ শিকার ও চোরাচালান রোধে কিছু অগ্রগতি হলেও আইনের দুর্বলতায় এখনো চোরাচালান অব্যাহত রয়েছে। বিশেষ করে সুন্দরবনে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বন্যপ্রাণী পাচার রোধে রাষ্ট্রীয় সংস্থা, আন্তর্জাতিক সংস্থা এবং অন্যান্য দেশের মধ্যে সহযোগিতা বৃদ্ধি প্রয়োজন।

বন্যপ্রাণী অপরাধ দমন ইউনিটের পরিচালক মো. ছানাউল্যা পাটওয়ারী বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, বাংলাদেশ থেকে প্রতিবছর অনেক বন্যপ্রাণী বৈধভাবে রপ্তানি করা হয়। আর বৈধভাবে পাঠানো এসব প্রাণীর সঙ্গে অবৈধভাবে কোনো প্রাণী পাচার হয়ে যাচ্ছে কি না সেটি একটি বড়ো প্রশ্ন। সাধারণত গভীর রাতে বিমানবন্দরে এসব প্রাণীর ওঠা-নামার সুযোগ কাজে লাগায় প্রাণী বেচাকেনার সঙ্গে যুক্ত সিন্ডিকেট।

গবেষণায় বলা হয়, বাংলাদেশ থেকে ১৫টি দেশে বাঘের অঙ্গপ্রত্যঙ্গ সরবরাহ করা হয়। এর মধ্যে একটি বিশাল অংশ প্রবাসী বাংলাদেশি। সরবরাহকারী দেশগুলোর তালিকার শীর্ষে আছে ভারত, চীন এবং মালয়েশিয়া, যুক্তরাজ্য, জার্মানি, অস্ট্রেলিয়া এবং জাপানের মতো দেশ। দেখা যায়, বাঘের চামড়া, হাড়, দাঁত এবং শুকনো মাংস সবচেয়ে বেশি চাহিদাসম্পন্ন পণ্য, যা প্রায়ই বাংলাদেশের বিমানবন্দর, সমুদ্রবন্দর এবং স্থল সীমান্ত দিয়ে পাচার করা হয়। 

ওয়াইল্ডলাইফ জাস্টিস কমিশনের সাম্প্রতিক প্রতিবেদন অনুসারে জীবিত বাঘের শাবকও বাংলাদেশ থেকে পাচার হচ্ছে, এমন প্রমাণ আছে। আর এই শাবকগুলোর দাম প্রাপ্তবয়স্ক বাঘের চেয়ে বেশি। গড়ে ডেলিভারি চার্জ বাদে ৭ হাজার ৬৪৮ ইউএস ডলার থেকে ১৭ হাজার ৫০০ ডলারে এক-একটি বাঘের শাবক বিক্রি হয়।  

বণ্যপ্রাণী বাণিজ্য মনিটর ট্রাফিকেবর ২০২২ সালের প্রতিবেদন বলছে,  বাঘের নিষিদ্ধ পাচারের ক্ষেত্রে বাংলাদেশ হটস্পটগুলোর একটি। ২০০০ সালের জানুয়ারি থেকে ২০২২ সালের জুন পর্যন্ত বাংলাদেশে বাঘ ধরার ৩৬টি ঘটনা ঘটেছে। যার মধ্যে ৫০টি বাঘ বাজেয়াপ্ত হয়েছে। এ সময় পাচারের সঙ্গে জড়িত থাকার জন্য মাত্র ছয়জনকে জেল এবং চারজনকে জরিমানা করা হয়। বিশ্বের বৃহত্তম ম্যানগ্রোভ বন সুন্দরবন। এর এক অংশ বাংলাদেশে আরেক অংশ ভারতে। রয়েল বেঙ্গল টাইগারের আবাসস্থল হচ্ছে সুন্দরবন। ২০১৭ সাল পর্যন্ত জলদস্যুরা বাঘ শিকারে আধিপত্য বিস্তার করে। এরপর বাংলাদেশ সরকার জলদসু্যুদের বিরুদ্ধে অভিযান পরিচালনা করে দলগুলো ভেঙে দেয়। কিন্তু এরপর এই বাঘগুলো আবার সুন্দরবনের বাঘশিকারীদের অভিজ্ঞ দলের শিকারের কারণে হুমকিতে পড়ে। মূলত জলদস্যুদের কাছ থেকে চাঁদাবাজি ও ডাকাতির ঝুঁকি চলে যাওয়ায় এই বাঘশিকারিদের তৎপরতা বেড়ে যায়। 

জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণীবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক এম এ আজিজ বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, বাঘ ও বাঘের অঙ্গপ্রত্যঙ্গ পাচার রোধ করতে হলে মানুষের মধ্যে সচেতনতা বৃদ্ধি একটি অংশ হিসেবে কাজ করতে পারে। তবে তা পুরোপুরিভাবে বাঘ পাচার নির্মূল করতে পারবে না। এটি নির্মূল করতে হলে বন বিভাগের বাইরে যে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারি বাহিনী আছে তাদের এ ক্ষেত্রে ভূমিকা পালন করতে হবে। আমাদের যে বন্যপ্রাণী আইন আছে সে আইনের যথাযথ প্রয়োগ প্রয়োজন। আর যারা সুন্দরবনের উত্তর অংশে বসবাস করেন সেই স্থানীয় জনগণকে বাঘ সংরক্ষণে সম্পৃক্ত করতে হবে। এতে এই বন সংরক্ষণের যে উপকার তারাও পাবেন। এতে স্থানীয়রা বুঝতে পারবেন যে, তাদের জীবণে সুন্দরবনের গুরুত্ব আছে। এতে তারা বন  ও বন্যপ্রাণী সংরক্ষণে ওতপ্রোতভাবে জড়িত হবেন। আর এমন হলে আমরা দুই জায়গা থেকেই লাভবান হব।

সর্বশেষ খবর