বুধবার, ২২ মে, ২০২৪ ০০:০০ টা

সবুজ হারাচ্ছে ঢাকার পার্ক

প্রকল্পে গাছ কাটা ও মরে যাচ্ছে পার্কে নির্মাণ হচ্ছে অবকাঠামো

হাসান ইমন

সবুজ হারাচ্ছে ঢাকার পার্ক

গাছ কাটা পড়ছে রাজধানীর ওসমানী উদ্যানের (বামে), পান্থকুঞ্জ এখন ফাঁকা মাঠ -জয়ীতা রায়

শহীদ আনোয়ারা পার্ক। রাজধানীর ব্যস্ততম ফার্মগেট এলাকার মানুষের কাছে পার্কটি ছিল আশীর্বাদস্বরূপ।  কয়েক বছর আগেও হাজারো মানুষ পার্কটিতে হাঁটাচলা করত, শিশুরা খেলত, কম আয়ের মানুষ ক্লান্তি দূর করতে জিরিয়ে নিত। সবুজ গাছ-গাছালিতে ভরা ছিল পার্কটি। সময়ের ব্যবধানে সেই জায়গায় সবুজের ছিটেফোঁটাও নেই। গড়ে তোলা হয়েছে দোতলা মেট্রোরেলের অফিস। রাখা হয়েছে নির্মাণসামগ্রী।

একই অবস্থা হোটেল সোনারগাঁওয়ের মোড়ের পান্থকুঞ্জ পার্কটির। ঢাকা এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ের একটি অংশ হাতিরঝিল হয়ে পান্থকুঞ্জ পার্ক থেকে পলাশী যাবে। সেই কাজের বলি পার্কের প্রায় দুই তৃতীয়াংশ। কাটা পড়েছে অধিকাংশ গাছ। নেই সবুজ প্রাণ। জীর্ণশীর্ণ অবস্থায় টিকে আছে কোনো রকম। পার্কের ভিতরে এক্সপ্রেসওয়ের কয়েকটি পিলার গাড়ার কাজ চলমান। গাছ কেটে পিলার বসানোয় অনেকটা কমেছে সবুজের উপস্থিতি। পার্কের পরিবেশ আর আগের জায়গায় ফেরানোর কোনো উপায় নেই। অথচ কয়েক বছর আগেও সেখানে ছিল সারি সারি গাছপালা। সকালে শরীরচর্চা-প্রাতঃভ্রমণ, বিকালে আড্ডায় জমজমাট থাকত পার্কটি। পথচারীরাও নিত বিশ্রাম। পাখিরা কিচিরমিচির করত ডালে ডালে। কিন্তু সেই অতীত হারিয়ে গেছে।

ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের প্রধান কার্যালয় নগর ভবনের নাকের ডগায় অবস্থিত ওসমানী উদ্যান। এ উদ্যানটি জলসবুজে ঢাকা প্রকল্পের অধীনে গত সাত বছর বন্ধ রেখে উন্নয়ন কার্যক্রম চলছে। নির্মাণ করা হচ্ছে বিভিন্ন অবকাঠামো। এ উন্নয়ন কার্যক্রমে ২ শতাধিক গাছ কেটে ফেলা হয়েছে। একই সঙ্গে উন্নয়ন কর্মকান্ডে অনেক গাছ মরে গেছে। উদ্যানের জলাশয়ের একাংশ ভরাট করে অবকাঠামো নির্মাণ করা হয়েছে। ফলে পার্কে কমেছে সবুজায়নের উপস্থিতি।

জানা যায়, ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনে পার্ক আছে ১৯টি ও ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনে ১৮টি। এর মধ্যে আনোয়ারা উদ্যান, পান্থকুঞ্জ পার্ক ও ওসমানী উদ্যান অন্যতম। এ ছাড়া বাণিজ্যিকীকরণে ঐতিহ্য হারাচ্ছে পুরান ঢাকার ভিক্টোরিয়া পার্কও। ‘ফুড ভ্যান’ প্রকল্পের নামে ২০২২ সালের অক্টোবরে পার্কটিকে বছরে ৩ লাখ ৬১ হাজার টাকায় ইজারা দেওয়া হয় ডিএআর হোল্ডিং লিমিটেড নামে একটি কোম্পানিকে। ইজারাদার সেখানে স্থায়ী অবকাঠামো (দোকান ও গুদাম) তৈরি করেছেন। এখানেও গাছ কেটে ফুড ভ্যানগুলো বসানো হয়। এভাবে ৮৪ দশমিক ৩ কাঠা আয়তনের ছোট এ পার্কের তিন ভাগের এক ভাগ জায়গা চলে গেছে ইজারাদারের দখলে। একই সঙ্গে রমনা পার্ক, শহীদ মতিউর রহমান পার্ক, সোহরাওয়ার্দী উদ্যানসহ বিভিন্ন পার্কে উন্নয়ন প্রকল্পের কারণে নির্বিচারে গাছ কাটা হয়েছে। পাশাপাশি সিটি করপোরেশনের পার্ক সংস্কার ও পার্কের ভিতর দোকান ইজারার কারণে বেড়েছে কংক্রিটের জঞ্জাল। ফলে সবুজ হারিয়ে চরিত্র পরিবর্তন হয়েছে পার্কগুলোর।

ঢাকায় পার্ক কিংবা উদ্যান ছাড়া সেই অর্থে কোনো সবুজ প্রান্তর নেই। যা আছে তা বিক্ষিপ্ত। সেই পার্কগুলোতেও পড়ছে উন্নয়ন প্রকল্পের থাবা। বাণিজ্যিক কার্যক্রমও একটি বড় বাধা। অনেক পার্ক আবার সংস্কার করে সৌন্দর্যবর্ধনের পাশাপাশি বাণিজ্যিকীকরণ হচ্ছে।

খেলার মাঠ, উন্মুক্ত স্থান, উদ্যান এবং প্রাকৃতিক জলাধার সংরক্ষণ আইন, ২০০০’-এর ৫ ধারা অনুসারে, খেলার মাঠ, উন্মুক্ত স্থান, উদ্যান ও প্রাকৃতিক জলাধার হিসেবে চিহ্নিত জায়গার শ্রেণি পরিবর্তন করা বা ওই জায়গা অন্য কোনোভাবে ব্যবহার করা বা ব্যবহারের জন্য ভাড়া বা ইজারা দেওয়া নিষেধ। অথচ সরকারের বিভিন্ন সংস্থা ও সিটি করপোরেশন পার্ক বা লেকের পাড়ে রেস্তোরাঁ বসিয়ে এ আইন ভঙ্গ করে চলেছে।

এ বিষয়ে বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব প্ল্যানার্সের (বিআইপি) সভাপতি ড. আদিল মোহাম্মদ খান বলেন, একটি নগরে ২৫ শতাংশ সবুজায়ন দরকার। প্রতিটি ওয়ার্ডে একটি পার্ক দরকার। কিন্তু প্রতিটি ওয়ার্ডে নেই, নগরীতে যে কয়টি পার্ক রয়েছে সেগুলো ধ্বংসের কার্যক্রম চলছে। উন্নয়ন প্রকল্পের নামে পার্কের গাছ কেটে ফেলা হচ্ছে। সর্বশেষ আনোয়ারা উদ্যানে মেট্রোরেল কর্তৃপক্ষ মার্কেট নির্মাণ করতে চাচ্ছে। তা ঠিক নয়। নগর কর্তৃপক্ষকে পার্ক ও মাঠ রক্ষায় আরও জোরালো ভূমিকা রাখতে হবে।

এ বিষয়ে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের মেয়র ব্যারিস্টার শেখ ফজলে নূর তাপস বলেন, ডিএসসিসির আওতাধীন পার্কগুলো আধুনিকায়ন করা হচ্ছে। ইতোমধ্যে অনেক পার্ক ও মাঠ আধুনিকায়ন করে উন্মুক্ত করে দেওয়া হয়েছে। এর মধ্যে কিছু পার্কে মানুষের বিনোদনের জন্য কিছু রাইডস বসানো হয়েছে। কিন্তু স্থায়ী অবকাঠামো নির্মাণ করা হয়নি। ইজারাদার কোনো অবকাঠামো নির্মাণ করলে ভেঙে ফেলা হবে। একই সঙ্গে পার্ক-মাঠসহ অন্যান্য এলাকায় নতুন করে গাছ লাগানো হবে।

ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের মেয়র আতিকুল ইসলাম বলেন, ডিএনসিসি প্রকল্পের মাধ্যমে ইতোমধ্যে ২৪ পার্ক ও খেলার মাঠ সংস্কার করে মানুষের জন্য উন্মুক্ত করা হয়েছে। আনোয়ারা পার্ক সম্পর্কে তিনি বলেন, এ পার্কে কোনো স্থাপনা নির্মাণ করা যাবে না। এটা সিটি করপোরেশনকে বুঝিয়ে দিতে মন্ত্রণালয়ে চিঠি দিয়েছি।

সর্বশেষ খবর