রবিবার, ২৬ মে, ২০২৪ ০০:০০ টা

ভারতে ষষ্ঠ ধাপের ভোটেও সহিংসতা

কলকাতা প্রতিনিধি

ভারতের ১৮তম লোকসভা সংসদের নিম্নকক্ষ নির্বাচনের ষষ্ঠ দফা ভোট নেওয়া হয় গতকাল। সপ্তম ও শেষ দফা ভোট ১ জুন। ভোট গণনা করা হবে ৪ জুন। পশ্চিমবঙ্গের একাধিক জায়গায় বিক্ষিপ্ত অশান্তির ঘটনা ঘটল। গতকাল ভোট নেওয়া হয় দেশটির আটটি রাজ্য ও কেন্দ্রীয়-শাসিত অঞ্চলের ৫৮টি কেন্দ্রে। এগুলো হলো- উত্তর প্রদেশ (১৪), হরিয়ানা (১০), বিহার (৮), পশ্চিমবঙ্গ (৮), দিল্লি (৭), ওড়িশা (৬), ঝাড়খ  (৪), জম্মু-কাশ্মীর (১)। ভোট শুরু হওয়ার কয়েক ঘণ্টা আগে শুক্রবার রাতে পূর্ব মেদিনীপুর জেলার মহিষাদলে এক তৃণমূল নেতাকে খুন করা হয়। স্থানীয় বেতকুণ্ডু গ্রাম পঞ্চায়েতের সাবেক সদস্য শেখ মইবুল যখন রাতে মোটরবাইকে করে বাড়ি ফিরছিলেন সেই সময় আক্রমণের মুখে পড়েন। প্রথমে ধারালো অস্ত্র দিয়ে কোপানো হয় তাকে। এরপর রক্তাক্ত অবস্থায় পুকুরের পানিতে ফেলে দেওয়ার অভিযোগ ওঠে। এলাকায় দাপুটে নেতা হিসেবে পরিচিত মইবুলের মৃত্যুর ঘটনায় চরম উত্তেজনা ছড়ায় এলাকায়। বিরোধী দল বিজেপির বিরুদ্ধে এই খুনের অভিযোগ উঠলেও তারা তা অস্বীকার করেছে।

এ নিয়ে শনিবার সন্ধ্যায় বসিরহাটে এক নির্বাচনি প্রচার সভায় তৃণমূল নেত্রী মমতা ব্যানার্জির হুঁশিয়ারি ‘গতকাল রাতে মহিষাদলে আমার এক কর্মীকে খুন করেছে। আমি এদের ছাড়ব না। এর বিরুদ্ধে আমি রাজনৈতিক বদলা নেবই।’

পুলিশের বিরুদ্ধে সন্ত্রাসের অভিযোগ তুলে সোচ্চার হলেন পশ্চিমবঙ্গের তমলুকের বিজেপি প্রার্থী সাবেক বিচারপতি অভিজিৎ গাঙ্গুলী। ভোট শুরুর পরেই এলাকায় বেরিয়ে বুথে বুথে ঘুরে বেড়ান তিনি। আর প্রতিটি ক্ষেত্রেই বিক্ষোভের মুখে পড়তে দেখা যায়। তার অভিযোগ, রাজ্যের পুলিশ নন্দীগ্রাম এলাকায় বাড়ি বাড়ি গিয়ে বিজেপি কর্মীদের গ্রেফতার করছে। এই আসন এলাকার অন্তর্গত হলদিয়ায় স্থানীয় মানুষের বিক্ষোভের মুখে পড়েন অভিজিৎ গাঙ্গুলী। জাল ভোটের অভিযোগ পেয়ে তিনি যখন স্থানীয় একটি ভোট গ্রহণ কেন্দ্রে যান তখন বিজেপি প্রার্থীর গাড়ি ঘিরে ধরে ‘ফিরে যাও’ স্লোগান দেওয়া হয়। মুহূর্তের মধ্যে উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়ে। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে পুলিশ বাহিনী ও কেন্দ্রীয় বাহিনী এগিয়ে আসে।

ভোটের সকালে উত্তপ্ত হয় পশ্চিম মেদিনীপুর জেলার কেশপুর। ঘাটাল কেন্দ্রের বিজেপি প্রার্থী অভিনেতা হিরণ চ্যাটার্জির গাড়ির সামনে তুমুল বিক্ষোভ দেখায় তৃণমূলের কর্মী-সমর্থকরা। রাস্তার ওপরে অগ্নিসংযোগ করে চন্দ্রকোনা মেদিনীপুর সড়কে হিরণকে আটকানোর চেষ্টা করে বিক্ষোভকারীরা। নেতৃত্ব দেন কেশপুর ব্লকের ৫ নম্বর অঞ্চলের তৃণমূল সভাপতি শেখ হাসানুর জামান। এর আগে কেশপুরে তার গাড়িবহরকে আটকে দেওয়ার অভিযোগ উঠেছে রাজ্য পুলিশের বিরুদ্ধে। এরপর পুলিশের বিরুদ্ধে একরাশ অভিযোগ তোলেন হিরণ। কেশপুরেই ফের একবার বিক্ষোভের মুখে পড়তে হয় হিরণকে। লাঠি, বাঁশ নিয়ে তার ওপর চড়াও হওয়ার পাশাপাশি তার গাড়িবহর আটকে বিক্ষোভ দেখানো হয়।

তবে ওই কেন্দ্রেরই তৃণমূল প্রার্থী দীপক অধিকারী (দেব)-কে দেখা গেল খোশ মেজাজে। বাইক নিয়ে বিভিন্ন বুথে পরিদর্শন করতে দেখা যায় দেবকে।

ঝাড়গ্রামের বিজেপি প্রার্থী প্রণত টুডুর ওপর গড়বেতার ফুলকুশমায় হামলার অভিযোগ ওঠে তৃণমূলের বিরুদ্ধে। প্রার্থীকে মারধর করার পাশাপাশি ভাঙচুর করা হয় তার গাড়িবহর। প্রার্থীকে লক্ষ্য করে ছোড়া হয় পাথর। প্রার্থীর ব্যক্তিগত নিরাপত্তারক্ষীকে মেরে মাথা ফাটিয়ে দেওয়া হয়। প্রার্থী বলেন, ‘প্রায় ১০০ থেকে ২০০ জন ঘিরে ধরে হামলা চালায়, হামলাকারীদের মধ্যে রোহিঙ্গারা রয়েছে। নিরাপত্তারক্ষী না থাকলে বেঁচে ফিরতাম না।’ 

তৃণমূলের লোগো বুকে লাগিয়ে বুথে বুথে ঘুরে ভোটারদের প্রভাবিত করার অভিযোগ উঠেছে বিষ্ণুপুর লোকসভা আসনের তৃণমূল প্রার্থী সুজাতা ম লের বিরুদ্ধে। এ নিয়ে প্রতিবাদ জানায় বিজেপি। তবে সুজাতার দাবি কোনো বিধিভঙ্গ হয়নি।

মেদিনীপুরের কেশিয়াড়িতে বুথের মধ্যে কলকাতা পুলিশের সদস্যকে দেখে নিজের ক্ষোভ উগরে দেন বিজেপি প্রার্থী অগ্নিমিত্র পাল। এদিন কান্দামারি আংশিক বুনিয়াদি বিদ্যালয়ের একটি বুথে বিজেপির পোলিং এজেন্টকে ভয় দেখিয়ে উঠিয়ে দেওয়ার অভিযোগের খবর পেয়ে সেখানে আসেন অগ্নিমিত্রা। কথা বলেন প্রিসাইডিং অফিসারের সঙ্গে। তার অভিযোগ, দরজার পাশে দাঁড়িয়ে রাজ্যের পুলিশ ভোট করাচ্ছে, আর কেন্দ্রীয় বাহিনী দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখছে। পরে তাকে বুথ থেকে বাইরে বের করে দেন।

আবার অ্যাকশন মুডে দেখা যায় মেদিনীপুর আসনের তৃণমূল প্রার্থী অভিনেত্রী জুন মালিয়াকে। একটি বুথের ভিতর গিয়ে বিজেপির বুথ সভাপতির বিরুদ্ধে অভব্য আচরণ করার অভিযোগ তুলেছেন জুন। ওই বুথের ভিতরে বিজেপির পোলিং এজেন্টের সঙ্গে তুমুল বচসায় জড়িয়ে পড়েন জুন মালিয়া।

এ ছাড়া কয়েকটি ভোট গ্রহণ কেন্দ্রে ইভিএম খারাপ হওয়ার খবর এসেছে। আবার কোথাও ভোটারদের ভয়ভীতি প্রদর্শন, বুথে আসতে বাধা দেওয়াসহ বিক্ষিপ্ত কিছু ঘটনার খবরও পাওয়া গেছে।

জম্মু-কাশ্মীরের অনন্তনাগ-রাজৌরি কেন্দ্রের ‘পিপলস ডেমোক্রেটিক ফ্রন্ট’-এর পোলিং এজেন্ট ও দলের কর্মীদের এ কারণে আটকের অভিযোগ তুলে বিক্ষোভে বসেন দলের নেত্রী সাবেক মুখ্যমন্ত্রী মেহেবুবা মুফতি। তার মোবাইল ফোনের আউটগোয়িং কল সাসপেন্ড করা হয়েছে বলেও অভিযোগ তোলেন মুফতি।

দেশজুড়ে এ দফায় ৮৮৯ জন প্রার্থীর ভাগ্য নির্ধারণ হয়েছে গতকাল। এদের মধ্যে ছিলেন বিজেপি প্রার্থী কেন্দ্রীয় মন্ত্রী মানেকা গান্ধী (সুলতানপুর), বিজেপি নেতা ও কেন্দ্রীয় মন্ত্রী ধর্মেন্দ্র প্রধান (সম্বলপুর), জম্মু-কাশ্মীরের সাবেক মুখ্যমন্ত্রী ও পিপল ডেমোক্রেটিক ফ্রন্ট প্রধান মেহেবুবা মুফতি (অনন্তনাগ-রাজৌরি), বিজেপি প্রার্থী কেন্দ্রীয় শিক্ষা প্রতিমন্ত্রী ডা. সুভাষ সরকার (বাঁকুড়া),

কংগ্রেস নেতা ও টলিউড অভিনেতা রাজ বাব্বর (গুরগাঁও), বিজেপি প্রার্থী ভোজপুরি অভিনেতা গায়ক মনোজ তিওয়ারি (নর্থ-ইস্ট দিল্লি), কংগ্রেস প্রার্থী কানাইয়া কুমার (নর্থ-ইস্ট দিল্লি), তৃণমূল প্রার্থী দীপক অধিকারী, দেব (ঘাটাল), বিজেপি প্রার্থী কলকাতা হাই কোর্টের সাবেক বিচারপতি অভিজিৎ গাঙ্গুলী (তমলুক), বিজেপি প্রার্থী বিশিষ্ট শিল্পপতি নবীন জিন্দাল (কুরুক্ষেত্র) প্রমুখ।

এদিকে নিজের ভোট দিয়ে একনায়কতন্ত্রের বিরুদ্ধে দেশের মানুষকে ভোট দেওয়ার আহ্বান জানান কেজরিওয়াল। তিনি বলেন, আমি, আমার বাবা, স্ত্রী এবং সন্তানরা ভোট দিয়েছি। শরীর অসুস্থ থাকায় মা ভোট দিতে পারেননি। আমি ভোট দিয়েছি একনায়কতন্ত্র, মুদ্রাস্ফীতি ও বেকারত্বের বিরুদ্ধে। সাধারণ মানুষ, ভোটারদেরও বলব তারা যেন ঘরে না থেকে ভোট গ্রহণ কেন্দ্রে এসে একনায়কতন্ত্রের বিরুদ্ধ ভোট দেন।

এদিকে ভারতের চলমান নির্বাচনে ফের একবার উঠে এলো প্রতিবেশী বাংলাদেশের প্রসঙ্গ। ষষ্ঠ দফার ভোটের কয়েক ঘণ্টা আগেই শুক্রবার সর্বভারতীয় গণমাধ্যম ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেসকে সাক্ষাৎকার দিতে গিয়ে দিল্লির মুখ্যমন্ত্রী ও আম আদমি পার্টির প্রধান অরবিন্দ কেজরিওয়াল বাংলাদেশ প্রসঙ্গটি উত্থাপন করেন। নরেন্দ্র মোদি যদি তৃতীয়বারের জন্য প্রধানমন্ত্রী হন সে ক্ষেত্রে আপ প্রধানের মতামত জানতে চাইলে কেজরি বলেন, ‘তারা (বিজেপি) সংবিধান পরিবর্তন করবে এবং দেশ স্বৈরাচারের দিকে যাবে। সে ক্ষেত্রে হয় কোনো নির্বাচন হবে না, অথবা নির্বাচন হবে রাশিয়ার মতো, যেখানে দেশটির প্রেসিডেন্ট ভøাদিমির পুতিন হয় পুরো বিরোধীদের কারাগারে পুরে রেখেছেন বা তাদের হত্যা করেছেন। এরপর সেখানে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয় এবং পুতিন ৮৭ শতাংশ ভোট পান। প্রতিবেশী বাংলাদেশেও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সবাইকে কারাগারে প্রেরণ করে সর্বাধিক ব্যবধানে ভোটে জিতেছেন। পাকিস্তানের দিকে তাকালে সেখানেও দেখা যাবে সরকারপক্ষ সাবেক প্রধানমন্ত্রী ইমরান খানকে কারাগারে পাঠিয়েছে, ইমরানের দল, তার প্রতীক কেড়ে নিয়ে তারা জয়ী হয়েছে। আমাদের দেশেও ঠিক এ ধরনের নির্বাচন হবে। পুরো বিরোধীরা কারাগারে থাকবে এবং তারা ভোট পেতে থাকবে।

সর্বশেষ খবর