শুক্রবার, ৩১ মে, ২০২৪ ০০:০০ টা
রিমালের তাণ্ডব

ক্ষয়ক্ষতি কাটানোর লড়াই

আঘাত ও অতিবৃষ্টিতে ক্ষতি ১ লাখ ৭১ হাজার ১০৯ হেক্টর জমির ফসল বিদ্যুতের অপেক্ষায় ৯ লাখ মানুষ

নিজস্ব প্রতিবেদক

ক্ষয়ক্ষতি কাটানোর লড়াই

ঘূর্ণিঝড় রিমালের ক্ষয়ক্ষতি কাটিয়ে তুলতে উপকূলজুড়ে নতুন লড়াইয়ের প্রেক্ষাপট তৈরি হয়েছে। এ জন্য সরকার এবং বেসরকারি নানা মহল থেকে নানা উদ্যোগ হাতে নেওয়া হয়েছে। প্রাপ্ত খবর অনুযায়ী, রিমালের আঘাতে ব্যাপক ধ্বংসযজ্ঞের চিত্র প্রতিদিনই উঠে আসছে। এমনকি এখন পর্যন্ত সংযোগ ঠিক না হওয়ায় বিদ্যুতের অপেক্ষায় রয়েছেন প্রায় ৯ লাখ মানুষ।

কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের করা ক্ষয়ক্ষতির প্রাথমিক প্রতিবেদনের তথ্য বলছে, আঘাত ও অতিবৃষ্টিতে ক্ষতি হয়েছে ১ লাখ ৭১ হাজার ১০৯ হেক্টর ফসলি জমির। এ ঝড়ে ক্ষতিগ্রস্ত কৃষক প্রায় ১ লাখ ৭৩ হাজার ৪৯১ জন।  ৪৮টি জেলার কৃষিতে রিমালের প্রভাব পড়েছে। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে বরিশাল, খুলনা ও চট্টগ্রাম অঞ্চলের ১৩টি জেলা। সূত্র জানায়, আরও সাত-আট দিন পর ক্ষতির প্রকৃত মাত্রাটি বোঝা যাবে। এ প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে, ঘূর্ণিঝড় রিমালের প্রভাবে ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। জলোচ্ছ্বাসে উপকূলের অনেক এলাকা প্লাবিত হয়। প্রাথমিকভাবে ৪৮টি জেলার কৃষিতে ঘূর্ণিঝড় রিমালের প্রভাব পড়েছে। উল্লেখযোগ্যহারে আক্রান্ত হয়েছে উপকূলীয় বরিশাল অঞ্চলের ৬ জেলা (বরিশাল, পিরোজপুর, ঝালকাঠি, পটুয়াখালী, বরগুনা, ভোলা) এবং খুলনা অঞ্চলের ৪ জেলা (খুলনা, বাগেরহাট, সাতক্ষীরা, নড়াইল), চট্টগ্রাম অঞ্চলের নোয়াখালী, লক্ষ্মীপুর, কক্সবাজার। বর্তমানে মাঠে দন্ডায়মান ফসলি জমির পরিমাণ প্রায় ১৪ লাখ ৩০ হাজার ৬৫ হেক্টর এবং আক্রান্ত ফসলি জমির পরিমাণ প্রায় ১ লাখ ৭১ হাজার ১০৯ হেক্টর। আউশ বীজতলা ১০ হাজার ৮৪৩ হেক্টর, ২১ হাজার ৪৩৪ হেক্টর আউশের জমি, বোরো ৭ হাজার ৭৩০ হেক্টর জমির ধান, বোনা আমন ৪ হাজার ৮২৬ হেক্টর, গ্রীষ্মকালীন সবজি ৫২ হাজার ১৯০ হেক্টর, পাট ২৯ হাজার ৭৪৯ হেক্টর, তিল ৭ হাজার ৫৩৬ হেক্টর, মুগ ৩ হাজার ৫০৭ হেক্টর, মরিচ ২ হাজার ৪৪৪ হেক্টর দুর্যোগ কবলিত হয়েছে। ৭ হাজার ৫৮ হেক্টর জমির পান দুর্যোগ কবলিত হয়েছে। ফলের মধ্যে আম ৪ হাজার ৭০৮ হেক্টর, লিচু ১ হাজার ৫৭৫ হেক্টর, কলা ৭ হাজার ৬১৩ হেক্টরসহ মোট ১৭ হাজার ৫৪৩ হেক্টর জমির বিভিন্ন ফল দুর্যোগ কবলিত হয়েছে। প্রাথমিকভাবে বরিশাল অঞ্চলের আউশ বীজতলা ৯ হাজার ১০১ হেক্টর, আউশ ১৭ হাজার ৯০ হেক্টর, মুগ ২ হাজার ৪১৯ হেক্টর, শাকসবজি ১৭ হাজার ২৪৭ হেক্টর, পান ৩ হাজার ৪৭৩ হেক্টরসহ মোট ৫৪ হাজার ৫৬৪ হেক্টর জমির বিভিন্ন ফসলের জমি আক্রান্ত হয়েছে। যার প্রাথমিক আনুমানিক ক্ষতির মূল্য ৫০ হাজার ৮৯৭ লাখ টাকা এবং ক্ষতিগ্রস্ত কৃষক প্রায় ১ লাখ ৭৩ হাজার ৪৯১ জন। বরিশাল অঞ্চলের ন্যায় অন্যান্য অঞ্চলের ক্ষয়ক্ষতি নিরূপণের কাজ চলমান রয়েছে। প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়, মাঠে কিছু ভুট্টা, চিনাবাদাম ছাড়া অন্য রবিশস্য না থাকায় কৃষি বিরাট ক্ষতির হাত থেকে কিছুটা হলেও রক্ষা পেয়েছে। আসন্ন আমনের জন্যও এ বৃষ্টি সুফল বয়ে আনবে। জমির চাষাবাদ উপযোগী অবস্থা বিশেষ করে খরাপ্রবণ এলাকার জন্য বিশেষ কার্যকরী ভূমিকা পালন করবে। যা বিভিন্ন সবজি ও ফলফলাদির জন্য ভূমিকা পালন করবে। বৃষ্টি বন্ধ হলে এবং সাত-আট দিন পর ক্ষতির মাত্রাটা প্রকৃতপক্ষে জানা যাবে।

৯ লাখ গ্রাহক বিদ্যুৎ বিচ্ছিন্ন : ঘূর্ণিঝড় রিমালের প্রভাবে এখনো ৯ লাখ ২২ হাজার ৪৯৫ জন গ্রাহকের বিদ্যুৎ বিচ্ছিন্ন রয়েছে। বিদ্যুৎ বিভাগ গতকাল সন্ধ্যা পর্যন্ত বিদ্যুৎ বিচ্ছিন্ন গ্রাহকের ৯৯ শতাংশের বিদ্যুৎ সরবরাহের চেষ্টা করবে বলে জানায়। গতকাল বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয়ের পাঠানো এক বিজ্ঞপ্তিতে এ তথ্য জানানো হয়। উপকূলের সর্বশেষ পরিস্থিতি সম্পর্কে আমাদের নিজস্ব প্রতিবেদক ও প্রতিনিধিদের পাঠানো খবর- পিরোজপুর : ঘূর্ণিঝড় রিমালের প্রভাবে পিরোজপুরে কয়েক হাজার ঘরবাড়ি বিধ্বস্ত হওয়ার পাশাপাশি কৃষি ও মৎস্য খাতে ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে। ঘূর্ণিঝড়ের প্রভাবে সৃষ্ট বন্যায় পিরোজপুরের ৭টি উপজেলার সবই প্লাবিত হয়েছে। আর এতেই বেড়েছে ক্ষতির পরিমাণ। এ বিষয়ে পিরোজপুরের অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক মাধবী রায় জানান, জেলায় ক্ষয়ক্ষতির পুরো চিত্র উল্লেখ করে মন্ত্রণালয়ে প্রতিবেদন পাঠানো হয়েছে। জেলা প্রশাসক মোহম্মদ জাহেদুর রহমান জানান, দুর্যোগ মোকাবিলায় প্রশাসনের পক্ষ থেকে সর্বাত্মক চেষ্টা করা হচ্ছে এবং ক্ষয়ক্ষতি নিরূপণে বিভিন্ন বিভাগের মাধ্যমে  দ্রুত ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে।

সাতক্ষীরা : রিমালের আঘাতে সাতক্ষীরার উপকূলীয় জনপদে ১৫০০ কিলোমিটার বেড়িবাঁধ ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। পানি উন্নয়ন বোর্ড সাতক্ষীরা-১ ও ২ এর অধীনে ২০টি পয়েন্টে এসব বাঁধ বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। সাতক্ষীরা পানি উন্নয়ন বোর্ড-১ এর নির্বাহী প্রকৌশলী মো. সালাউদ্দিন জানান, ক্ষতিগ্রস্ত এলাকায় জিওব্যাগ ও অন্যান্য নির্মাণসামগ্রী দিয়ে বাঁধ সংস্কারের কাজ চলমান রয়েছে। ঝড়ের মধ্যে সার্বক্ষণিক এলাকাবাসীকে নিয়ে বাঁধ মেরামত করা হচ্ছে। পাথরঘাটা (বরগুনা) : ঘূর্ণিঝড় রিমালে উপকূলের ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে। কৃষি, মৎস্য, গাছপালার ক্ষতির পাশাপাশি মাছ ধরা ট্রলারের ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে। এ পর্যন্ত ২ শতাধিক ট্রলার বিধ্বস্ত হয়। এতে ক্ষতি হয়েছে ২ শতাধিক জেলে পরিবার। জেলা মৎস্যজীবী ট্রলার মালিক সমিতির সভাপতি গোলাম মোস্তফা চৌধুরী বলেন, বিষখালী ও বলেশ্বর নদে থাকা প্রায় ২ শতাধিক ছোট মাছ ধরা ট্রলার দুমড়ে-মুচড়ে যায়। প্রতি জেলে পরিবার একমাত্র উপার্জনক্ষম ট্রলারটি বিধ্বস্ত হওয়ায় নিঃসঙ্গ হয়ে পড়েছেন। তবে এখন ক্ষতিগ্রস্তরা ঘুড়ে দাঁড়াতে চেষ্টা করছেন। মোরেলগঞ্জ (বাগেরহাট) : রিমালের জলোচ্ছ্বাসে বাগেরহাটের মোরেলগঞ্জ উপজেলার ৩০০ কিলোমিটার জনগুরুত্বপূর্ণ সড়ক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এতে সড়ক বিভাগের প্রায় ১৪০ কোটি টাকার ক্ষতি হয়েছে। উপজেলা প্রকৌশলী আরিফুল ইসলাম বলেন, ক্ষয়ক্ষতির বিষয়ে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে অবগত করা হয়েছে। জনগুরুত্ব বিবেচনা করে মেরামতের কাজ শুরু করা হয়েছে। এ ক্ষতি কাটিয়ে উঠতে ১৫ দিন থেকে এক বছর সময় লাগতে পারে।

গলাচিপা (পটুয়াখালী) : ঘূর্ণিঝড় রিমালের তান্ডবে পটুয়াখালীর গলাচিপায় ১৫০ কোটি টাকার ক্ষতি হয়েছে বলে জানিয়েছে উপজেলা প্রশাসন। উপজেলা নির্বাহী অফিসার মহিউদ্দিন আল হেলাল জানান, ক্ষয়ক্ষতির প্রতিবেদন যথাযথ কর্তৃপক্ষের নিকট পাঠানো হয়েছে এবং সরকারি সাহায্যের চাহিদা প্রেরণ করা হয়েছে।

পটুয়াখালী : ঘূর্ণিঝড় রিমালের প্রভাবে জলাবদ্ধতায় ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে কয়েক হাজার হেক্টর জমির বোরো, আউশ, মুগ ডাল, চিনাবাদাম, মরিচ, শাকসবজিসহ ফসলি জমি। উপড়ে ও ভেঙে পড়েছে পেঁপে, আম ও কলা গাছ, বনজ ও ফলদ গাছ। সব মিলিয়ে পটুয়াখালীতে কৃষিতে মোট ২৬ কোটি ২১ লাখ টাকার আর্থিক ক্ষতি হয়েছে। এর ফলে মোট ৫৮ হাজার ৩০৪ জন কৃষক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। পটুয়াখালী কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতর খামারবাড়ীর উপ-পরিচালক কৃষিবিদ নজরুল ইসলাম বলেন, জেলায় ৫৮ হাজার ৩০৪ জন কৃষক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন। ক্ষতি কাটিয়ে উঠতে এই আমন মৌসুমে ১৮ হাজার ২০০ জন কৃষককে বিনামূল্যে সার ও বীজ প্রণোদনা হিসেবে দেওয়া হবে। পাশাপাশি অন্যান্য ক্ষতিগ্রস্ত কৃষকদের অগ্রাধিকার-ভিত্তিতে প্রণোদনা সহায়তা দেওয়া হবে।

সর্বশেষ খবর