শনিবার, ১ জুন, ২০২৪ ০০:০০ টা

কমবে ভর্তুকি, বাড়বে সামাজিক নিরাপত্তা

মানিক মুনতাসির

কমবে ভর্তুকি, বাড়বে সামাজিক নিরাপত্তা

উচ্চ মূল্যস্ফীতির অভিঘাত থেকে সাধারণ মানুষকে মুক্তি দিতে সামাজিক নিরাপত্তা বেষ্টনীর আওতা বাড়ানোর পরিকল্পনা করছে সরকার। যদিও এবারের বাজেটে সামগ্রিকভাবে ভর্তুকি কমিয়ে আনা হচ্ছে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) চাপে। আসছে ২০২৪-২৫ অর্থবছরের বাজেটে আগের বছরের তুলনায় অন্তত ২৭ হাজার কোটি টাকা ভর্তুকি কমানো হতে পারে। তবে সামাজিক নিরাপত্তা বেষ্টনীর আওতা বাড়াতে অন্তত ৭-১০ হাজার কোটি টাকা বরাদ্দ বাড়ানো হতে পারে। অবশ্য অর্থনীতিবিদরা বলছেন, মানুষকে খাদ্যসহায়তা দেওয়ার চেয়ে কর্মসংস্থান ও আয়বর্ধক কর্মসূচি বাড়ালে বাজেট বেশি কার্যকর হবে।

টানা চতুর্থবার ক্ষমতা গ্রহণের পর এটাই নতুন সরকারের প্রথম বাজেট। গত তিন বছরেরও বেশি সময় ধরে দেশের অর্থনীতিতে নানামুখী সংকট চলছে। এসব সংকট সত্ত্বেও স্মার্ট বাংলাদেশ বিনির্মাণের স্বপ্ন দেখছে সরকার। এর আগে ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়ার প্রত্যয়ে অনেকটাই সফল হয়েছে আওয়ালী লীগ সরকার। এজন্য এবারের বাজেটের প্রধান শিরোনাম করা হয়েছে ‘সুখী, সমৃদ্ধ, উন্নত ও স্মার্ট বাংলাদেশ বিনির্মাণে অঙ্গীকার’। দেশের বিপর্যস্ত অর্থনীতি পুনরুদ্ধারের পরিকল্পনা নিয়ে আগামী ৬ জুন বৃহস্পতিবার জাতীয় সংসদে ২০২৪-২৫ বাজেট প্রস্তাবনা পেশ করবেন অর্থমন্ত্রী।

বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) তথ্যমতে, টানা ১৪ মাস ধরে সার্বিক মূল্যস্ফীতি দুই অঙ্কের ঘর ছুঁইছুঁই করছে। সর্বশেষ গত এপ্রিলে মূল্যস্ফীতি ছিল ৯ দশমিক ৭৪ শতাংশ। অর্থাৎ ১৪ মাস ধরে আপনি যত পণ্য ও সেবা কিনছেন, তার জন্য আপনাকে আগের বছরের একই সময়ের চেয়ে গড়ে ৯ শতাংশ বেশি দাম দিতে হচ্ছে। তবে বাস্তবে মূল্যস্ফীতির এই চাপ আরও অনেক বেশি বলে মনে করেন বিশ্লেষকরা। এরই মধ্যে ঢাকা ওয়াসা পানির দাম ১০ শতাংশ বৃদ্ধির ঘোষণা দিয়েছে। ধারাবাহিকভাবে বাড়বে বিদ্যুৎ-জালানির দামও। অতি সাধারণ সবজি আলুর কেজিও এখন ৬০ টাকা। যা গত বছর একই সময়ে ছিল ২০-২৫ টাকা। এক ডজন ডিমের দাম ১৫০ টাকার বেশি। এতে নতুন অর্থবছরের শুরুতে মূল্যস্ফীতির চাপ আরও বাড়বে। অথচ সামাজিক নিরাপত্তা খাতে মাত্র ৭ হাজার কোটি টাকা বরাদ্দ বাড়িয়েই ১৭ কোটি মানুষকে মূল্যস্ফীতির চাপ থেকে স্বস্তি দিতে চায় সরকার। এটাকে অবাস্তব পরিকল্পনা হিসেবে আখ্যা দিয়েছেন অর্থনীতিবিদরা। সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা ড. হোসেন জিল্লুর রহমান এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, মানুষকে কাজ দিতে হবে। মজুরি বাড়াতে হবে। কর্মজীবী মানুষের আয় না বাড়লে বাড়তি ব্যয় সামাল দেবে কোথা থেকে। দেশের এই বিপুলসংখ্যক জনগোষ্ঠীকে মূল্যস্ফীতির অভিঘাত থেকে বাঁচাতে সামাজিক নিরাপত্তা খাতকে ঢেলে সাজাতে হবে। ৭ হাজার কোটি টাকা বরাদ্দ বাড়ানোর বিষয়ে তিনি বলেন, এটা বাস্তবতাবিবর্জিত। অর্থ মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, আগামী অর্থবছরে বিভিন্ন খাত থেকে ভর্তুকি কমানো হবে। ফলে আগামীতে সমাজের নিম্ন ও নিম্ন মধ্যবিত্তদের কষ্ট আরও বাড়বে। সাধারণত খাবারের দাম বাড়লে মানুষের কষ্ট বাড়ে। কারণ, খাবার কিনতেই আয়ের অর্ধেকের বেশি খরচ করেন গড়পড়তা মানুষ। সরকারি-বেসরকারি বিভিন্ন সংস্থার হিসাবে, গরিব মানুষকে খাবার কিনতে আয়ের দুই-তৃতীয়াংশ পর্যন্ত খরচ করতে হয়। বিশ্বব্যাংকের সাম্প্রতিক এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বাংলাদেশের ৭১ শতাংশ মানুষই খাবারের দাম নিয়ে উদ্বিগ্ন। এমন পরিস্থিতিতে আগামী ২০২৪-২৫ অর্থবছরের বাজেটে ভর্তুকি ও প্রণোদনা খাতে বরাদ্দ কমানো হচ্ছে। যা খুবই উদ্বেগজনক এবং বাস্তবতাবিবর্জিত বলে মনে করেন অর্থনীতিবিদ ড. এম এম আকাশ। বাংলাদেশ প্রতিদিনকে তিনি বলেন, নিম্ন আয়ের মানুষকে স্বস্তি দিতে হলে মূল্যস্ফীতি কমাতে হবে। আর এটাই আগামী বাজেটের প্রধান চ্যালেঞ্জ।

মূল্যস্ফীতির চাপ প্রসঙ্গে অর্থ প্রতিমন্ত্রী ওয়াসিকা আয়শা খান বলেন, আগামী ২০২৪-২৫ অর্থবছরের বাজেটে মূল্যস্ফীতির চাপ মোকাবিলায় সামাজিক সুরক্ষা কার্যক্রম বাড়ানো হচ্ছে। করোনা মহামারি-পরবর্তী রুশ-ইউক্রেন যুদ্ধের সময় থেকে মূল্যস্ফীতির শুরু উল্লেখ করে তিনি বলেন, তখন জ্বালানি তেলের দাম বেড়েছে। এরপর থেকে বিশ্বজুড়ে মূল্যস্ফীতির ঊর্ধ্বগতি চলছে। অনেক দেশে ৬০ শতাংশের বেশি মূল্যস্ফীতি আছে। মানুষকে মূল্যস্ফীতি সংক্রান্ত অভিঘাত থেকে কীভাবে বের করে নিয়ে আসব, সেজন্য সামাজিক সুরক্ষা কার্যক্রম বাড়ানো হচ্ছে। এবারের বাজেটে মূল্যস্ফীতির বিষয়টি যেমন গুরুত্ব পাচ্ছে, তেমনি সামাজিক সুরক্ষা কার্যক্রমের সম্প্রসারণ হচ্ছে। নিম্ন ও স্বল্পআয়ের মানুষের মধ্যে বিনামূল্যে খাদ্য বিতরণ অব্যাহত থাকবে বলে জানান প্রতিমন্ত্রী। জানা গেছে, চলতি অর্থবছরে ভর্তুকি ও প্রণোদনা খাতে বরাদ্দ ছিল ১ লাখ ১০ হাজার ৬৭২ কোটি টাকা। সেখান থেকে আগামী অর্থবছরে কমিয়ে ৮৩ হাজার ৫০০ কোটি টাকা করা হচ্ছে। ফলে ভর্তুকি কমবে ২৭ হাজার কোটি টাকা। আর চলতি অর্থবছরে ভর্তুকি ও প্রণোদনা বাবদ সংশোধিত বাজেট বরাদ্দ ৯৮ হাজার কোটি টাকাকে ভিত্তি ধরলে ভর্তুকি কমিয়ে আনার পরিমাণ হতে পারে অন্তত ১৪ হাজার ৫০০ কোটি টাকা। আইএমএফের কাছ থেকে ৪৭০ কোটি মার্কিন ডলার ঋণের প্রথম, দ্বিতীয় কিস্তি পেয়েছে বাংলাদেশ। জুনের মধ্যে তৃতীয় কিস্তির টাকা পাবে বলে আশা করা হচ্ছে। মূলত এই ঋণের শর্ত পূরণ করতেই বাজেটে বিভিন্ন খাতে ভর্তুকি কমাতে বাধ্য হচ্ছে সরকার। এমন সিদ্ধান্ত নিম্ন ও নিম্ন মধ্যবিত্তদের ওপর চাপ বাড়বে বলে জানান ড. এম এম আকাশ। এদিকে ১৭ কোটি মানুষকে মূল্যস্ফীতির চাপ থেকে স্বস্তি দিতে বরাদ্দ বাড়বে মাত্র ৭-১০ হাজার কোটি টাকা! বরাদ্দ বাড়ানো হলেও এবারের বাজেটে শেষ পর্যন্ত উপকারভোগীদের ভাতার হার বাড়ানোর সিদ্ধান্ত থেকে সরে এসেছে সরকার। এর পরিবর্তে সামাজিক নিরাপত্তাবেষ্টনীর বিদ্যমান কর্মসূচির আওতায় বেশি করে উপকারভোগী বাড়ানো হচ্ছে। আসছে বাজেটে সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচির আওতায় প্রায় ৫ কোটি মানুষকে বছরব্যাপী নগদ ভাতা, খাদ্যবান্ধব কর্মসূচি অব্যাহত রাখা এবং সুলভমূল্যে খাদ্য সরবরাহ নিশ্চিতে ১ লাখ ৩৩ হাজার ২৭২ কোটি টাকা ব্যয়ের প্রস্তাব করবেন বলে জানা গেছে। চলতি ২০২৩-২৪ অর্থবছরে সামাজিক নিরাপত্তা বলয়ের ১৩০টি কর্মসূচির আওতায় বাজেটে ১ লাখ ২৬ হাজার ২৭২ কোটি টাকা বরাদ্দ রাখা হয়েছে। সেই হিসাবে আগামী ২০২৪-২৫ অর্থবছরের বাজেটে এ ব্যয় ৭ হাজার কোটি টাকা বাড়ছে। গত ২০২২-২৩ অর্থবছরে সামাজিক নিরাপত্তায় বরাদ্দ দেওয়া হয়েছিল ১ লাখ ১৩ হাজার ৫৭৬ কোটি টাকা। তারও আগে ২০২১-২২ অর্থবছরে সামাজিক নিরাপত্তায় ব্যয় ধরা হয় ৯৫ হাজার কোটি টাকার বেশি।

সর্বশেষ খবর