সোমবার, ৩ জুন, ২০২৪ ০০:০০ টা

চাকরিতে আস্থা নেই শিক্ষিতদের

♦ পরীক্ষার্থী কমছে বিসিএসে ♦ আগ্রহ বাড়ছে উদ্যোক্তা হওয়ায় ♦ অনেকে ঝুঁকছেন কৃষিতে ♦ কেউ গড়ছেন ফ্রিল্যান্সিং ক্যারিয়ার ♦ ভালো চাকরি ছেড়ে কেউ কেউ পাড়ি জমাচ্ছেন বিদেশে

শামীম আহমেদ

চাকরিতে আস্থা নেই শিক্ষিতদের

চাকরির প্রতি আগ্রহ হারাচ্ছেন দেশের শিক্ষিতরা। প্রথম শ্রেণির সরকারি চাকরির পরীক্ষাতেও (বিসিএস) কমছে পরীক্ষার্থীর সংখ্যা। ঝোঁক বাড়ছে উদ্যোক্তা হওয়ার প্রতি। পড়ালেখা শেষ করে অনেকে গড়ে তুলছেন কৃষি খামার। কেউ ঝুঁকে পড়ছেন ব্যবসার প্রতি। অনেকে চাকরি পেয়েও ছেড়ে দিয়ে হচ্ছেন উদ্যোক্তা। শিক্ষিত তরুণদের বড় একটা অংশ চলে যাচ্ছেন বিদেশে। মধ্য বয়সে উচ্চ বেতনের চাকরি ছেড়েও কেউ কেউ সপরিবারে পাড়ি জমাচ্ছেন দেশের বাইরে। প্রযুক্তিকেন্দ্রিক প্রশিক্ষণ নিয়ে অনেকে ঝুঁকছেন ফ্রিল্যান্সিংয়ে। কেউ আবার ডিজিটাল কন্টেন্ট তৈরি করে ফেসবুক, ইউটিউবকে বানিয়েছেন আয়ের ক্ষেত্র। বিনা পয়সায় ফেসবুকে পেজ খুলে অনেকে শুরু করছেন স্বাধীন ব্যবসা। এর প্রভাব পড়েছে চাকরির বাজারে, সোনার হরিণখ্যাত বিসিএস পরীক্ষাতেও বছর বছর কমছে পরীক্ষার্থীর সংখ্যা। প্রতি বছর শ্রমবাজারে নতুন করে যোগ হচ্ছে ২০ থেকে ২২ লাখ নতুন মুখ। এই বিপুল সংখ্যক মানুষকে চাকরি দিতে হিমশিম খাচ্ছে সরকারি ও বেসরকারি খাত। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর হিসাবে গত ডিসেম্বর শেষে দেশে মোট বেকারের সংখ্যা ছিল ২৩ লাখ ৫০ হাজার। সঙ্গতকারণে, চাকরির পরীক্ষাগুলোয় প্রতিযোগিতা বাড়ার কথা। অথচ গত চারটি বিসিএসে ধারাবাহিকভাবে কমেছে পরীক্ষার্থীর সংখ্যা। ৪৩তম বিসিএসের প্রিলিমিনারিতে অংশ নেন ৩ লাখ ২১ হাজার ৬৫০ প্রার্থী। ৪৪তম বিসিএসের প্রিলিমিনারিতে অংশ নেন ২ লাখ ৭৬ হাজার ৭৬০ জন প্রার্থী। ৪৫তম বিসিএসের প্রিলিমিনারিতে অংশ নেন ২ লাখ ৬৮ হাজার পরীক্ষার্থী। সবশেষ ৪৬তম বিসিএসের প্রিলিমিনারিতে অংশ নেন ২ লাখ ৫৪ হাজার ৫৬১ জন প্রার্থী। যদিও ২৮তম বিসিএস থেকে ৪১তম বিসিএস পর্যন্ত আবেদনকারীর সংখ্যা বেড়েছিল দ্রুতগতিতে।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, সরকারি চাকরি পেতে ঘুষ দিতে হচ্ছে। ব্যাংকড্রাফট করতে করতে পকেট খালি হয়ে যাচ্ছে। ২৪-২৫ বছর পার করে ¯œাতকোত্তর শেষে অনেক কাঠখড় পুড়িয়ে মিলছে ২০, ২৫ বা ৩০ হাজার টাকা বেতনের চাকরি। দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতির সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে না বেতন। অথচ কাজের চাপ অনেক বেশি। ফলে অনেকেই চাকরির পেছনে না ছুটে নিজে কিছু করার চেষ্টা করছেন। যাদের চাকরি আছে তারাও টিকে থাকতে চাকরির পাশাপাশি বিকল্প কিছু করার চেষ্টা করছেন। অনেকে চাকরি ছেড়েও উদ্যোক্তার খাতায় নাম লেখাচ্ছেন। ইন্টারনেটের বিকাশে ঘরে বসেই অনেক ধরনের ব্যবসা বা কাজ করার সুযোগ তৈরি হওয়াতেও চাকরির প্রতি আগ্রহ কমছে। অনলাইনে ফ্রিল্যান্সিং করছেন ১০ লক্ষাধিক মানুষ। নারীরা ঘরে বসে কেউ কাপড় বিক্রি করছেন, কেউ খাবার রান্না করে অনলাইনে বিক্রি করছেন। এসব কারণে চাকরির প্রতি আগ্রহ কমছে। ঢাকায় একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের মধ্যম সারির কর্মকর্তা জাকারিয়া বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, আর দুই বছর চাকরি করব। এই সময়ে বাড়ির জমিগুলো ঠিকঠাক করে খামার প্রস্তুত করব। এরপর পরিবারসহ চলে যাব গ্রামে। বর্তমান বেতনে কোনো রকমে বেঁচে থাকা গেলেও ভবিষ্যৎ অন্ধকার। এদিকে ব্যাংকের চাকরি ছেড়ে উদ্যোক্তার খাতায় নাম লেখানো এক আত্মপ্রত্যয়ী নারী মার্জিয়া হাসান খান। অর্থনীতিতে করেছেন মাস্টার্স। পড়ালেখা করেছেন আইন নিয়েও। চাকরি পেয়েছিলেন একটি বেসরকারি ব্যাংকে। তবে সেই চাকরি তাকে আটকে রাখতে পারেনি। ঢাকা থেকে প্রশিক্ষণ নিয়ে ২০১৮ সালের ১ ফেব্রুয়ারি রংপুর বিভাগের প্রথম অনলাইন কেক শপ ‘কেকমি’ (Cake me) চালু করেন। ঢাকায় রিয়েল স্টেট কোম্পানির চাকরি ছেড়ে স্ত্রী মার্জিয়ার ব্যবসায় সহযোগী হন ম্যানেজমেন্টে মাস্টার্স করা স্বামী রাজু আহম্মেদ। অল্প সময়েই জনপ্রিয়তা পায় ‘কেকমি’। মার্জিয়া বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, স্টুডেন্ট লাইফ থেকেই ঢাকায় চাকরি করেছি। বিয়ের পর ব্যাংকে চাকরি হয়। তবে চেয়েছি নিজেই কিছু করতে। স্বামীর সঙ্গে পরামর্শ করে রংপুরে প্রথম অনলাইন কেক শপ হিসেবে ‘কেকমি’ চালু করি। এখন ৫০টার বেশি অনলাইন কেক শপ হয়েছে রংপুরে। এই পর্যন্ত ১৫ হাজারের বেশি কেক সরবরাহ করেছি। বেশ কয়েকজনের কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করতে পেরেছি। সব মিলে ভালো আছি। শুধু মার্জিয়া নয়, মোহাম্মপুরের দ্য ক্লথিং কোম্পানির স্বত্বাধিকারী শায়লা, ‘প্রাকৃতিক কৃষি’ নামের একটি কৃষি আন্দোলন ও খামারের স্বপ্নদ্রষ্টা দেলোয়ার জাহান, কারু বুটিকের স্বত্বাধিকারী জান্নাতুল ফেরদৌস, ফেসবুকে ‘বাকল’ নামে ই-কমার্স পেজের স্বত্বাধিকারী পাবনার সাইফুল ইসলাম, মধুমতি এগ্রো নামে কৃষি খামারের স্বত্বাধিকারী ফয়সাল আহম্মেদ, টাঙ্গাইলের খান এগ্রোর প্রতিষ্ঠাতা হাবিব খান, টাইলো নামের পোশাক ব্র্যান্ডের স্বত্বাধিকারী রাসেল শেখসহ অসংখ্য শিক্ষিত তরুণ চাকরি ছেড়ে হয়েছেন সফল উদ্যোক্তা। কেউ হয়েছেন কৃষিজীবী। লাখ লাখ টাকা আয় করছেন, তাদের মাধ্যমে কর্মসংস্থানও হয়েছে অনেকের। এ ছাড়া সম্প্রতি একটি ফুড কোর্টে আড্ডারত দুটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের ২০ জনের সঙ্গে আলাপ করে দেখা গেছে, তাদের ১৬ জনই বিদেশ যাওয়ার জন্য আইইএলটিএস করছেন। বাকিরা দেশেই নিজে কিছু করতে চান। দেশে চাকরির পিছনে না ঘুরে বা ভালো চাকরি ছেড়ে বিদেশ যাওয়া মানুষের সংখ্যাও কম নয়। ইউনেস্কোর তথ্যানুযায়ী, প্রতি বছরই দেশ থেকে প্রায় ৫০ হাজার শিক্ষার্থী উচ্চশিক্ষার জন্য বিদেশে পাড়ি জমাচ্ছেন। একটি আন্তর্জাতিক এনজিওর উচ্চ বেতনের চাকরি ছেড়ে উচ্চশিক্ষার জন্য গত এপ্রিলে সপরিবারে কানাডায় চলে গেছেন মোহতামীম নাঈম। এক বছর আগে উচ্চশিক্ষায় যুক্তরাষ্ট্রে পাড়ি দিয়েছেন টিভি সাংবাদিক রাকিব হাসান। এখন স্ত্রীকে নেওয়ার চেষ্টা করছেন। গত বছর ‘ইয়ুথ ম্যাটার্স সার্ভে ২০২৩’- শীর্ষক সমীক্ষায় দেখা গেছে, দেশের তরুণ-তরুণীদের মধ্যে ৪২ শতাংশই বিদেশে পাড়ি দিতে চান। সমীক্ষায় বলা হয়, তারা জীবিকা, জলবায়ু পরিবর্তন, ন্যায়বিচার, গণতন্ত্র ও সুশাসন, তথ্য ও দৃষ্টিভঙ্গি এসব কারণে বিদেশে যেতে চান।

সর্বশেষ খবর