মঙ্গলবার, ৪ জুন, ২০২৪ ০০:০০ টা

কীভাবে বাঁচবে সুন্দরবন

♦ রক্ষায় হচ্ছে গাইডলাইন ♦ স্টেকহোল্ডার, বন কর্মকর্তা ♦ পর্যটকদের জন্য সহায়ক হবে বলছেন সংশ্লিষ্টরা

জিন্নাতুন নূর

কীভাবে বাঁচবে সুন্দরবন

বাংলাদেশ সরকার সুন্দরবন রক্ষায় বিশেষ করে অগ্নিদুর্ঘটনা কমাতে গাইডলাইন তৈরি করতে যাচ্ছে। মানবসৃষ্ট কারণে সম্প্রতি পৃথিবীর সবচেয়ে বড় ম্যানগ্রোভ বনে অগ্নিদুর্ঘটনার ঝুঁকি বৃদ্ধি পেয়েছে। এর আগেও বিভিন্ন সময় সুন্দরবন রক্ষায় বিভিন্ন পরিকল্পনা গ্রহণ করা হয়। কিন্তু এর বাস্তবায়ন করাই মূল চ্যালেঞ্জ বলে বিশেষজ্ঞরা মনে করেন। সর্বশেষ গত ৩০ মে সুন্দরবনের গাইডলাইন তৈরির জন্য পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির একটি বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়েছে। বৈঠকে এ কমিটির সুপারিশের ভিত্তিতে এ সংক্রান্ত কর্মপরিকল্পনা তৈরি হবে বলে সিদ্ধান্ত হয়েছে। বিশেষজ্ঞরা বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, যেহেতু এখন প্রতি বছরই সুন্দরবনে অগ্নিদুর্ঘটনায় ক্ষয়ক্ষতি হচ্ছে এজন্য এ সম্পর্কিত একটি পরিষ্কার কর্মপরিকল্পনা থাকা প্রয়োজন। সুন্দরবন রক্ষায় যখন সরকার মনোযোগী ঠিক সে সময় আগামীকাল ৫ জুন সারা বিশ্বের সঙ্গে বাংলাদেশেও বিশ্ব পরিবেশ দিবস পালিত হবে। এবার দিবসটির প্রতিপাদ্য ‘করব ভূমি পুনরুদ্ধার, রুখব মরুময়তা অর্জন করতে হবে মোদের খরা সহনশীলতা’। পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রী সাবের হোসেন চৌধুরী বলেন, আমরা এরই মধ্যে একটি স্ট্যান্ডার্ড অপারেটিং পদ্ধতি (এসওপি) তৈরির সিদ্ধান্ত নিয়েছি। এটি স্টেকহোল্ডার, বন কর্মকর্তা এবং বন বিভাগের কমিটি এবং পর্যটকদের জন্য গাইডলাইন হিসেবে কাজ করবে। তিনি আরও জানান, বনের কোনো ক্ষতি না করে কীভাবে সুন্দরবনের ওপর নির্ভরশীল লাখ লাখ মানুষ এই বনের সম্পদ সংগ্রহ করতে পারে এ ব্যাপারে একটি সচেতনতামূলক প্রোগ্রাম তৈরির জন্য এরই মধ্যে আমাদের কর্মকর্তাদের বলেছি। খুলনা অঞ্চলের বন সংরক্ষক মিহির কুমার দো বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, সুন্দরবনের গাইডলাইন তৈরির জন্য পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির একটি বৈঠক গত ৩০ মে অনুষ্ঠিত হয়েছে। সার্বিকভাবে জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণের ব্যাপারে এ বৈঠকে আলোচনা হয়। এ কমিটির সুপারিশের ভিত্তিতে এ সংক্রান্ত কর্মপরিকল্পনা তৈরি হবে এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত হয়েছে। এ লক্ষ্যে যে কমিটি গঠন করা হবে তারা সরেজমিনে বন পরিদর্শন করে স্টেকহোল্ডারদের সঙ্গে কথা বলবেন। কমিটি সুন্দরবনে যে সমস্যা আছে তা কীভাবে সমাধান করা যায় তার সুপারিশমূলক প্রস্তাব সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ে জমা দেবে। গত ৪ মে, পূর্ব সুন্দরবনের বাগেরহাট জেলার আমরবুনিয়া এলাকার যে আগুন লাগে তা নেভাতে ফায়ার সার্ভিস, কোস্টগার্ড, ফরেস্ট গার্ড এবং অনান্য সরকারি সংস্থার কর্মীদের দুই দিন সময় লাগে। সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের এক বিবৃতিতে বলা হয়, সব মিলিয়ে আগুন ৭ দশমিক ৯ একর ম্যানগ্রোভ বনের মধ্যে ছড়িয়ে পড়ে এবং এটি ৫ একর জমির ক্ষতি করে। সুন্দরবনে আগুন লাগার ঘটনা নতুন নয় এবং বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই এ আগুন মানুষের কারণেই লাগে বলে সংশ্লিষ্টরা জানান। ‘প্যারামাইম শিফট ইন দ্য ম্যানেজমেন্ট অব দ্য সুন্দরবন ম্যানগ্রোভ ফরেস্ট অব বাংলাদেশ : ইস্যু অ্যান্ড চ্যালেঞ্জ’ শীর্ষক এক গবেষণা প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়, ২০০১ থেকে ২০২১ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশের সুন্দরবন অংশে ২৪টি অগ্নিদুর্ঘটনা ঘটে। তবে বাস্তবে ধারণা করা হচ্ছে, এ সংখ্যা আরও বেশি। বনে মাছ শিকারি, কাঠ সংগ্রহকারী ও মধু সংগ্রহকারীদের ফেলে দেওয়া জ্বলন্ত সিগারেটের টুকরো, কুপির আগুনে অগ্নিদুর্ঘটনা ঘটে। এতে আরও বলা হয়, গবাদিপশু চরানোর জন্য জমি পরিষ্কার করা, অগভীর জলের কাদায় বাস করা মাছ ধোঁয়া সৃষ্টি করে বের করা এবং বনে শিকারের কার্যকলাপ থেকে বন বিভাগের দৃষ্টি সরিয়ে নিতেও অনেক সময় ইচ্ছাকৃত আগুন জ্বালানো হয়। বন বিভাগ সুন্দরবনের আশপাশে বসবাসকারীদের বনের ওপর নির্ভরতা ও জাতীয় অর্থনীতিতে অবদানের কথা বিবেচনা করে সুন্দরবনের ব্যবস্থাপনা কার্যক্রম শুরু করেছিল। এরই মধ্যে ১৮৭৫ থেকে ২০২০ সাল পর্যন্ত মোট ১০টি পরিকল্পনা তৈরি করা হয়। এর মধ্যে কিছু পরিকল্পনা প্রয়োগ করা হয়, কিছু সংস্কার করা হয় আবার কিছু বাতিল হয়ে যায়। প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, সুন্দরবনকে অতিক্রমকারী অনেক খাল শুকিয়ে যাচ্ছে। আর এতে বনে পড়ে থাকা শুকনো পাতাগুলো পড়ে পুরু কার্পেটের মতো তৈরি করছে। আর এখানে কোনো জ্বলন্ত সিগারেট টুকরো পড়লেই সঙ্গে সঙ্গে আগুন জলে উঠবে। আবার সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধির জন্য সুন্দরবনের স্থানীয়দের জন্য নির্মাণ করা বাঁধের কারণে বনের অনেক অংশে ঠিকমতো পানি প্রবেশ করতে পারে না। এ কারণে বনের জীববৈচিত্র্যের ভারসাম্য বদলে যাচ্ছে। প্রসঙ্গত, সুন্দরবনের প্রাণ ও প্রকৃতি রক্ষায় টানা তিন মাস পর্যটক ও বনজীবীদের প্রবেশ বন্ধ ঘোষণা করেছে বন বিভাগ। এরই মধ্যে গত ১ জুন থেকে শুরু হওয়া নিষেধাজ্ঞা জারি থাকবে আগামী ৩১ আগস্ট পর্যন্ত। এ সময়ে বনজীবী, সাধারণ জনগণ ও পর্যটকদের কেউই বনে ঢুকতে পারবেন না। সাধারণত জুন থেকে আগস্ট এই তিন মাস সুন্দরবনের নদী-খালের মাছের প্রজনন মৌসুম হিসেবে ধরা হয়। এ সময় সুন্দরবনের নদী ও খালে থাকা বেশির ভাগ মাছ ডিম ছাড়ে। এটি বন্যপ্রাণীদেরও প্রজনন মৌসুম। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক এম এ আজিজ বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, সুন্দরবনকে রক্ষার জন্য বিশেষ করে অগ্নিদুর্ঘটনার ক্ষয়ক্ষতি কমাতে আমাদের একটি অ্যাকশন প্ল্যান হতেই পারে। প্রতি বছরই দেখা যাচ্ছে, সুন্দরবনে অগ্নিদুর্ঘটনায় ক্ষয়ক্ষতি হয়। এ সম্পর্কে একটি কর্মপরিকল্পনা থাকা ভালো। তবে এ ধরনের পরিকল্পনা বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে আমরা অধিকাংশ সময়ই চ্যালেঞ্জের মুখে পড়ি। এক্ষেত্রে জনবল ও দক্ষতার ঘাটতি কর্মপরিকল্পনা বাস্তবায়নে মূল চ্যালেঞ্জ। সুন্দরবনের মতো এত বড় বনের ব্যবস্থাপনায় আছে মাত্র হাজারখানেকের কম জনবল। এত বড় জায়গায় এ স্বল্পসংখ্যক কর্মী, যারা গহিন বনে মানবেতর জীবনযাপন করে এবং যাদের নানা ধরনের ঘাটতি আছে তাদের বিষয়ে গুরুত্ব দেওয়া প্রয়োজন। গাইডলাইন করার ক্ষেত্রে অনুসন্ধানী প্রতিবেদন ও গঠনমূলক তথ্য নিয়ে তার আলোকেই করা উচিত বলে মনে করি।

 

এই রকম আরও টপিক

এই বিভাগের আরও খবর

সর্বশেষ খবর