মঙ্গলবার, ১১ জুন, ২০২৪ ০০:০০ টা
নোয়াবের বাজেট আলোচনা

মূল্যস্ফীতি নিয়ে শুধুই কাগুজে পরিকল্পনা

নিজস্ব প্রতিবেদক

বাজেট-উত্তর আলোচনা সভায় দেশের বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ ও বিশিষ্টজনরা বলেছেন, মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে শুধু কাগুজে পরিকল্পনাই নেওয়া হয়েছে। কার্যকর কোনো পদক্ষেপ নেওয়া হয়নি। ফলে মূল্যস্ফীতি টানা ১৫ মাস ধরে বেড়েই চলেছে। প্রস্তাবিত বাজেটেও মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণের বিষয়ে একই রকম পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছে। তারপরও সুদের হার যে বাড়ানো হয়েছে, এতে মূল্যস্ফীতি কিছুটা নিয়ন্ত্রণে আসতে পারে। তবে সেটা এখনই নয়। একই সঙ্গে দেশে এত বেশি মন্ত্রণালয় থাকারও প্রয়োজন নেই বলে মনে করেন তারা। সরকারি খরচ কমানোর জন্য মন্ত্রণালয়ের সংখ্যা কমিয়ে আনার পরামর্শ দিয়েছেন অর্থনীতিবিদরা। বাজেট প্রণয়নের ক্ষেত্রে পরিশ্রমী উদ্যোক্তা ও পরিশ্রমী অর্থনৈতিক কর্মীদের কথা শোনা হয়নি। সংবাদপত্র মালিকদের সংগঠন নোয়াব ও সম্পাদক পরিষদের যৌথ আয়োজনে অনুষ্ঠিত ‘অর্থনীতির চালচিত্র ও বাজেট ২০২৪-২৫’ শীর্ষক আলোচনায় এসব কথা বলেন বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদরা। এতে সভাপতিত্ব করেন সম্পাদক পরিষদের সভাপতি মাহফুজ আনাম। অনুষ্ঠান পরিচালনা করেন বণিক বার্তার সম্পাদক দেওয়ান হানিফ মাহমুদ। প্রারম্ভিক বক্তব্য দেন নোয়াবের সভাপতি ও সমকালের প্রকাশক এ কে আজাদ। সভায় সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা ড. হোসেন জিল্লুর রহমান বলেন, ক্ষমতার প্রশ্রয়ে থেকে যারা ফুলেফেঁপে উঠেছেন, এই শ্রেণিগোষ্ঠীর কথা চিন্তা করেই কালো টাকা সাদা করার সুযোগ দেওয়া হয়েছে। আবার এই বিশেষ শ্রেণির কথা চিন্তা করে অর্থনীতিতে সংস্কার ও ব্যাংক খাত নিয়ে তেমন আলোচনা হয়নি। অর্থমন্ত্রী কার কার কথা শুনেছেন বাজেট তৈরিতে? আইএমএফ-এর কথা শুনেছেন। ওলিগার্লসদের কথা শুনেছেন। অনৈতিক সুবিধা যারা নিয়েছেন তারাই ওলিগার্লস। তাদের কথা শুনেছেন। কালো টাকা সাদা করার করহার অত্যন্ত অনৈতিক একটা নীতি। আমলাতন্ত্রের কথাও শুনেছেন। আর দুই শ্রেণির মানুষের কথা শোনেনি। এরা হলেন পরিশ্রমী উদ্যোক্তা ও পরিশ্রমী অর্থনৈতিক কর্মী। বাজেটে কর প্রশাসনের সংস্কার বলতে কোনো কিছু করা হয়নি। এটা পরিশ্রমী উদ্যোক্তাদের দাবি ছিল। অর্থনৈতিক কর্মী বলতে সাধারণ মানুষ। তাদের কথা শোনা হয়নি। অথচ তারাই বেশি গুরুত্বপূর্ণ। তিনি বলেন, এই মুহূর্তে পাঁচটি সংকট রয়েছে দেশের অর্থনীতিতে। এগুলো হলো- প্রথমত, সামষ্টিক অর্থনীতির ভঙ্গুরতা। দ্বিতীয়ত, উচ্চ মূল্যস্ফীতি। ৬ দশমিক ৫ মূল্যস্ফীতি। এটা একটা কাগুজে পরিকল্পনা ছাড়া কিছুই নয়। এটা যারা করেছেন হয়তো তারাও বাস্তবে এটা বিশ্বাস করেন না। তৃতীয় সংকট হলো- কর্মসংস্থানের সংকট। বাজেটে যুবকরা কোথায়? তাদের জন্য বিশ্বাসযোগ্য কর্মকৌশলটা কোথায়। চতুর্থত, ব্যবসায়িক পরিবেশের সংকট। আর সবশেষ সংকটটা খুবই ভয়াবহ। সেটা হলো, নৈতিকতার সংকট। এখানে ১৫ শতাংশ কর দিয়ে কালো টাকা সাদা করার সুযোগ দেওয়া হয়েছে অর্থাৎ, আপনি তো কালো টাকা বৃদ্ধির ওপরই জোর দিচ্ছেন। এটা নাকি সমস্যার কারণে করা হয়েছে। এতে নাকি অর্থনৈতিক সংকট কেটে যাবে। পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের চেয়ারম্যান ড. আহসান এইচ মনসুর বলেন, নয়ছয়ের বেড়াজাল দিয়ে আমরা আমাদের ব্যাংক খাতের দুর্বলতা নিজেরাই তৈরি করেছি। এসব সমস্যা সমাধানের জন্য রাজনৈতিক ইচ্ছে আছে কি না সেটা আগে ঠিক করতে হবে। মূল্যস্ফীতি যে কমবে এটা বাজেটের দায়িত্ব নয়। বাজারভিত্তিক সুদ হার আরও আগে করা দরকার ছিল। এটা দেরি হয়ে গেছে। সুদ বেড়ে গেছে। এটা ব্যবসার জন্য ভালো নয়। তবে এটাকে মেনে নিতে হবে। এতে এক্সচেঞ্জ রেট কমবে। সেটার জন্য অপেক্ষা করতে হবে। না হলে অন্য দেশে যা হয়েছে সেটাই হয়তো আমাদের এখানে হবে। এতে দাম কমবে না। তবে বৃদ্ধিটা হয়তো কমবে। তিনি বলেন, একটা অদ্ভুত ব্যাপার হলো অর্থনীতিতে ব্যক্তি খাতের সাইজ হচ্ছে ৮৬ শতাংশ, তারা ঋণ পাচ্ছে ২৬ শতাংশ। আর সরকারি খাতের অংশ হলো ১৪ শতাংশ, তারা নিয়ে যাচ্ছে ৭৪ শতাংশ ঋণ। তাহলে বিনিয়োগটা হবে কোথা থেকে। সরকারের উদ্দেশ্যে বলব, ব্যয় সংকোচন করা হয়েছে কিন্তু কমানো হয়নি। এটা কমাতে হবে। কমিয়ে আনুন। সংকট কমে যাবে। রাজস্বের ৪২ শতাংশ খরচ করি পরিচালন খাতে। সেটার কি দরকার আছে। এতগুলো মন্ত্রণালয় তো দরকার নেই। আমেরিকার মতো দেশে ১১টা মন্ত্রণালয়। মন্ত্রণালয় কমিয়ে আনুন। ঘাটতি কমে যাবে। ব্যাংক খাত নিয়ে সিরিয়াসলি ভাবতে হবে। এ দূরাবস্থা কেন হলো এর জন্য একটা শ্বেতপত্র বের করুন। এর জন্য দরকার পলিটিক্যাল কমিটমেন্ট। এর মূল কারণ হচ্ছে ব্যাংকিং খাত আমরা ধ্বংস করেছি। এটাতে কারেকশন করতেই হবে। একটা খাতের ব্যর্থতার জন্য সরকারকে আজকে দেউলিয়ার দিকে ঠেলে দিচ্ছে। সেটা হলো ট্যাক্স জিডিপি রেশিও। এটাকে বাড়াতেই হবে। সরকার তার নীতি পরিচালনায় স্মার্ট হোক। জনগণ কেন কর দেবে, যেখানে একটা সার্ভিস নিতে আবার ওপরি দিতে হয়।

বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ বলেন, আমরা বিদেশ থেকে ঋণ নিয়ে ঋণ শোধ করব, সে রকম সময় মনে হয় চলে আসছে। তবে আমি বলি, এডিপি কমিয়ে এক বা দেড় লাখে নামিয়ে আনুন। ঘাটতি কমে যাবে। এডিপিতে ১ হাজার ২০০ প্রকল্প আছে, যার অনেক প্রকল্পই অপ্রয়োজনীয়। যা মানুষের কোনো কাজে আসবে না। বাজেটের চ্যালেঞ্জ তিনটা মূল্যস্ফীতি, রিজার্ভ ও জ্বালানি। খেলাপি ঋণ তো বাড়ছেই? ইন্টারেস্টিং ব্যাপার হলো, ঘাটতির টাকা ব্যাংক থেকে ঋণ নেবেন। আরে ভাই, ব্যাংক খাত তো এমনিতেই বিপর্যস্ত। এখন তো মনে হচ্ছে ঋণ নিয়ে ঋণ শোধ করব, সে রকম দিন মনে হয় চলে আসছে। বাজেটে সাধারণ মানুষের কিছুই নেই। যেমন কর্মসংস্থান, বিনিয়োগের জন্য কিছু নেই। সাবেক অর্থসচিব মুসলিম চৌধুরী বলেন, বাংলাদেশ ব্যাংকের হিসাবে এখন খেলাপি ঋণের পরিমাণ ১ লাখ ৮২ হাজার কোটি টাকা। কিন্তু নীতির কারণে বহু ঋণখেলাপি হিসাবে তালিকাভুক্ত হয় না। যেমন ২ শতাংশ টাকা জমা দিয়ে (ডাউন পেমেন্ট) ঋণ নিয়মিত করা হয়। এ ধরনের ঋণখেলাপি ঋণের হিসাবে অন্তর্ভুক্ত হয় না। আবার আদালতে অনিষ্পন্ন থাকায় বিপুল পরিমাণ ঋণের অর্থ আটকে আছে, তা-ও খেলাপি ঋণে অন্তর্ভুক্ত হচ্ছে না। তিনি আরও বলেন, সব মিলিয়ে ৪ থেকে ৫ লাখ কোটি টাকার খেলাপি ঋণের মধ্যে অনেক ঋণের বিপরীতে প্রকল্পও নেই। শুধু কাগজের ওপর ভিত্তি করে এসব ঋণ দেওয়া হয়েছে। রাজস্ব আদায়ের বিষয়ে মুসলিম চৌধুরী বলেন, দুই-তৃতীয়াংশ রাজস্বই আসে পরোক্ষ কর থেকে। এনবিআরকে বিশাল লক্ষ্য দেওয়া হয়। কিন্তু এনবিআরের হাতে বিকল্প নেই। তাই রাজস্ব আদায়ের প্রবৃদ্ধির জন্য যেখানে কর বসানো যায়, সেখানেই কর বসিয়ে দেওয়া হয়। রাজস্ব খাতে কাঠামোগত সংস্কার প্রয়োজন বলে তিনি মন্তব্য করেন। রাজনৈতিক সরকারকে মেয়াদের প্রথম ও দ্বিতীয় বছরের মধ্যে সাহসী ও কঠোর সিদ্ধান্ত নিতে হয়। কিন্তু সরকারের মধ্যে এ বিষয়ে তেমন অঙ্গীকার দেখা যাচ্ছে না। তিনি মনে করেন, প্রশাসনিক সংস্কার কমিশন গঠন করা জরুরি। বেসরকারি গবেষণা সংস্থা সিপিডির নির্বাহী পরিচালক ড. ফাহমিদা খাতুন বর্তমান অর্থনৈতিক সংকট, ডলার ও রিজার্ভ সংকট এবং বাজেটের নানা অসঙ্গতি তুলে ধরেন। যুগান্তরের প্রকাশক সাবেক এমপি সালমা ইসলাম বলেন, বর্তমানে অনলাইন সাংবাদিকতার চরম ডামাডোলের মধ্যে অফলাইন সাংবাদিকতা তথা ছাপানো কাগজের পত্রিকা টিকিয়ে রাখা বড় চ্যালেঞ্জিং হয়ে পড়েছে। কাগজ-কালিসহ এর যাবতীয় খরচের বহর লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়ছে। আবার মূল্যস্ফীতির পাগলা ঘোড়া এবং ডলারের অব্যাহত দাম বৃদ্ধি সবার জীবনযাত্রাকে কঠিন করে তুলেছে। আমি বলতে চাই- পত্রিকাকে সরকার যদি শিল্প হিসেবে স্বীকৃতি দিয়ে থাকে তাহলে এ সেক্টরকে বাঁচাতে সরকারের পক্ষ থেকে আরও সহনশীল নীতি নিয়ে আসতে হবে। সংবাদপত্রের সব খাত থেকে সব ধরনের ডিউটি তুলে নিতে হবে। আমরা যাতে ওয়েজবোর্ড মোতাবেক পত্রিকা চালাতে পারি সে সুযোগটা তো সরকারকে করে দিতে হবে।

সর্বশেষ খবর