বৃহস্পতিবার, ১৩ জুন, ২০২৪ ০০:০০ টা

অপরাধের আখড়া রোহিঙ্গা ক্যাম্প

♦ উখিয়ায় আরসা কমান্ডার নিহত ♦ আরএসও সদস্যকে পিটিয়ে হত্যা

নিজস্ব প্রতিবেদক, চট্টগ্রাম ও কক্সবাজার প্রতিনিধি

অপরাধের আখড়া রোহিঙ্গা ক্যাম্প

কক্সবাজারের রোহিঙ্গা ক্যাম্প অস্থির করে তুলেছে ৯ সন্ত্রাসী সংগঠন। যার মধ্যে পাঁচটিই উগ্রবাদী সন্ত্রাসী সংগঠন। এ সন্ত্রাসী সংগঠনগুলোর পাশাপাশি রোহিঙ্গা ক্যাম্প অস্থিরতার নেপথ্যে উঠে এসেছে পাকিস্তানভিত্তিক একটি সংস্থার নাম। যদিও রোহিঙ্গা ক্যাম্পে দায়িত্বরত আইন প্রয়োগকারী সংস্থাগুলোর দাবি- রোহিঙ্গা ক্যাম্পে অস্থিরতার যারা মদত দিচ্ছে তাদের তালিকা করা হয়েছে। ওই তালিকা ধরেই অভিযান চালানো হচ্ছে।

আর্মড পুলিশ ব্যাটালিয়ন (এপিবিএন) ৮-এর সহ-অধিনায়ক খন্দকার ফজলে রাব্বি বলেন, ‘রোহিঙ্গা ক্যাম্পের অস্থিরতার নেপথ্যে যারা রয়েছে তাদের তালিকা করা হয়েছে। ওই তালিকা ধরেই নিয়মিত গ্রেফতার করা হচ্ছে। পাশাপাশি নিয়মিত অভিযান পরিচালনা করা হচ্ছে তাদের আস্তানায়। এ ছাড়া ক্যাম্পের অপরাধ নিয়ন্ত্রণে মোবাইল এবং ফুট প্যাট্রোল অব্যাহত আছে।’

অনুসন্ধানে জানা যায়, কক্সবাজারের ৩৪ রোহিঙ্গা ক্যাম্পের সবগুলোতেই সক্রিয় রয়েছে ছোট বড় অর্ধশতাধিক সন্ত্রাসী সংগঠন। এ সংগঠনগুলোর মধ্যে ক্যাম্প অস্থিরতার নেপথ্যে ৯ সন্ত্রাসী সংগঠন রয়েছে। যার মধ্যে রোহিঙ্গা ক্যাম্পে অস্থিরতায় কলকাটি নাড়ছেন নবী হোসেন গ্রুপ। আরাকান স্যালভেশন আর্মি (আরসা) ও রোহিঙ্গা সলিডারিটি অর্গানাইজেশনের (আরএসও) একটি অংশ যোগদানের পর নবী হোসেনের গ্রুপ ক্যাম্পে হয়ে অপ্রতিরোধ্য উঠেছে। কিন্তু নবী হোসেন ক্যাম্পগুলোতে সরাসরি নেতৃত্ব না দিয়ে শূরা কমিটির মাধ্যমে পুরো রোহিঙ্গা ক্যাম্প নিয়ন্ত্রণ করছে। বর্তমানে এ কমিটিতে নেপথ্যে থেকে কাজ করছেন মাস্টার আইয়ুব প্রকাশ নুর ও মাস্টার ইউনুস। কমিটির দুজনেরই বিরুদ্ধে রয়েছে মাদক ও অস্ত্র ব্যবসা, চোরাকারবারিসহ নানান অভিযোগ। আরসা থেকে বের হয়ে আরেকটা গ্রুপ তৈরি হয়েছে রোহিঙ্গা ক্যাম্পে। এ গ্রুপে রয়েছে দুই শতাধিক সশস্ত্র সদস্য। এ গ্রুপের নেতৃত্বে রয়েছে আবদুল হালিম প্রকাশ কেফায়েতুল্লাহ। তার সহযোগী হিসেবে রয়েছে আমির রফিক প্রকাশ মাস্টার রফিক, মুফতি আনাস, আবু সোয়াব প্রকাশ হামিদ হোসেন ও ফজল করিম। তাদের বিরুদ্ধে রয়েছে মাদক ব্যবসা ও চাঁদাবাজির অভিযোগ। আরসা এবং ইসলামী মাহাজ ভেঙে তৈরি হয়েছে আরেকটি শক্তিশালী গ্রুপ। তাদের বিরুদ্ধে রয়েছে অপহরণ, ছিনতাইসহ নানা অপকর্মের অভিযোগ। এ গ্রুপের নেতৃত্ব দিচ্ছেন মৌলভী মোহাম্মদ নুর। সহযোগী হিসেবে রয়েছে নুর বশর, কামাল প্রকাশ মোস্তফা কামাল, সাদ্দাম ও মো. আলী। গান গ্রুপ নামে আরেকটা সন্ত্রাসী গ্রুপ সক্রিয় রয়েছে ক্যাম্পে। এ গ্রুপের নেতৃত্বে রয়েছে মো. ইউনুস। সহযোগী হিসেবে রয়েছেন সলিম প্রকাশ হাড্ডি সেলিম ও রুহুল আমিন।

সম্প্রতি এক গোয়েন্দা প্রতিবেদনে উঠে এসেছে রোহিঙ্গা ক্যাম্পে পাঁচ জঙ্গি সংগঠনের তৎপরতার তথ্য। ওই প্রতিবেদনে বলা হয়েছে- আরসা, আরএসও, আরাকান রোহিঙ্গা আর্মি (এআরএ) ও ইসলামী মাহাজ অস্থির করে তুলেছে রোহিঙ্গা ক্যাম্প। সংগঠনগুলো রোহিঙ্গা ক্যাম্পে পুরোপুরি সক্রিয়। সম্প্রতি আরসা ও আরএসওর মধ্যে সংঘাত ব্যাপক আকারে ছড়িয়েছে পড়েছে। এ ছাড়া সাবেক আরসা সদস্য নবী হোসেন মংডুতে বসেই গড়ে তুলেছেন এআরএ নামে একটি সশস্ত্র সংগঠন। মাদক সাম্রাজ্য নিয়ন্ত্রণের দিক থেকে এটিই বৃহৎ সশস্ত্র গোষ্ঠী। নবী হোসেনের গ্রুপের বেশির ভাগই আরসার সাবেক সদস্য। আবার আরএসওর একটি অংশ নবী হোসেনের অনুগত। এর বাইরে রয়েছে রোহিঙ্গা নেতা মাস্টার মুহিবুল্লাহর দল ইসলামী মাহাজ। গত ১৫ মে কক্সবাজারের উখিয়ার গহিন অরণ্যে অভিযান পরিচালনা করে র‌্যাব। অভিযানে আরসা আস্তানা থেকে বিপুল অস্ত্র উদ্ধার করে। অভিযানে গ্রেফতার করা হয় দুই সন্ত্রাসীকে। তাদের জিজ্ঞাসাবাদে র‌্যাব জানতে পারে- বাংলাদেশে আশ্রিত রোহিঙ্গাদের ক্যাম্পগুলোকে জঙ্গিবাদের আস্থানা হিসেবে পরিণত করতে চায় পাকিস্তানভিত্তিক একটি সংস্থা। ওই সংস্থার সৃষ্টি হচ্ছে আরসা।

উখিয়ার রোহিঙ্গা ক্যাম্পে আরসা কমান্ডার নিহত : কক্সবাজারে উখিয়ার ঘোনারপাড়া ১৯ নম্বর রোহিঙ্গা ক্যাম্পে আরসার দুই  গ্রুপ ও পুলিশের গুলিবিনিময়ে আবদুল মোনাফ (২৬) নামে এক রোহিঙ্গা সন্ত্রাসী নিহত হয়েছেন। এ সময় ঘটনাস্থল থেকে একটি বিদেশি পিস্তল উদ্ধার করা হয়। গতকাল সকালে ক্যাম্পের এ-৪ ব্লকে এ ঘটনা ঘটে। আবদুল মোনাফ ওই ক্যাম্পের আজিম উল্লাহর ছেলে। পুলিশ জানিয়েছে, আরসা কমান্ডার আবদুল মোনাফ চিহ্নিত সন্ত্রাসী। তার বিরুদ্ধে হত্যা ও অস্ত্রসহ একাধিক মামলা রয়েছে। ৮ এপিবিএন এর অধিনায়ক অতিরিক্ত উপ-মহাপরিদর্শক (এডিআইজি) মো. আমির জাফর ঘটনার সত্যতা নিশ্চিত করেছেন। তিনি বলেন, সকালে উখিয়ার ঘোনারপাড়া ১৯ নম্বর রোহিঙ্গা ক্যাম্পের এ-৪ ব্লকে আরসার সন্ত্রাসীদের দুই পক্ষের মধ্যে গুলি বিনিময় হয়েছে। খবর পেয়ে এপিবিএন পুলিশের একটি দল ঘটনাস্থলে পৌঁছালে আরসা সন্ত্রাসীরা অতর্কিত গুলি ছুড়তে থাকেন। আত্মরক্ষার্থে পুলিশও পাল্টা গুলি ছোড়ে। ত্রিমুখী গুলিবিনিময়ের একপর্যায়ে আরসা সন্ত্রাসীরা পালিয়ে গেলে ঘটনাস্থলে একজনকে গুলিবিদ্ধ অবস্থায় পাওয়া যায়। এ সময় ঘটনাস্থলের আশপাশে তল্লাশি চালিয়ে উদ্ধার করা হয় বিদেশি একটি পিস্তল। পরে গুলিবিদ্ধ যুবককে উখিয়া উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে নিয়ে গেলে কর্তব্যরত চিকিৎসক মৃত ঘোষণা করেন। এডিআইজি আমির জাফর বলেন, কী কারণে আরসা সন্ত্রাসীদের মধ্যে গুলিবিনিময়ের ঘটনা ঘটেছে পুলিশ তা নিশ্চিত নয়। এ ব্যাপারে পুলিশ খোঁজখবর নিচ্ছে। নিহত আবদুল মোনাফের লাশ ময়নাতদন্তের জন্য কক্সবাজার জেলা সদর হাসপাতাল মর্গে পাঠানো হয়েছে বলে জানান আমির জাফর।

আরএসও সদস্যকে পিটিয়ে হত্যা : কক্সবাজারের উখিয়ায় রোহিঙ্গা ক্যাম্পে এক যুবককে পিটিয়ে হত্যা করা হয়েছে। নিহত সৈয়দ আমিন (৩৫) আরএসও সদস্য ও উখিয়ার ৪ নম্বর ক্যাম্পের এ/৪ বক্লের আহমেদের ছেলে। আধিপত্য বিস্তারকে কেন্দ্র করে মিয়ানমারের আরেক সশস্ত্র গোষ্ঠী আরসা এ হত্যাকান্ড ঘটিয়েছে বলে ধারণা করছে পুলিশ। উখিয়া থানার ওসি মো. শামীম হোসেন জানিয়েছেন, উখিয়ার ৪ নম্বর ক্যাম্পে দুপুর আড়াইটার দিকে হঠাৎ কিছু লোক আমিনকে পিটিয়ে আহত করে। তাকে উদ্ধার করে ক্যাম্প সংলগ্ন জিকে হাসপাতালে নেওয়া হয়। সেখান থেকে উন্নত চিকিৎসার জন্য উখিয়া স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে নিলে চিকিৎসক তাকে মৃত ঘোষণা করেন। ওসি শামীম বলেন, আরসা ও আরএসওর মধ্যে আধিপত্য বিস্তারকে কেন্দ্র করে এ ঘটনা ঘটেছে বলে ধারণা করা হচ্ছে। আমিনের লাশ উদ্ধার করে ময়নাতদন্তের জন্য সদর হাসপাতাল মর্গে পাঠানো হয়েছে। এর আগে সোমবারও একই ক্যাম্পে তিনজনকে গুলি ও কুপিয়ে হত্যা করা হয়েছে। এ ঘটনায় আহত রয়েছে ৭ রোহিঙ্গা। একই ক্যাম্পে এর আগে সোমবার তিনজনকে গুলি ও কুপিয়ে হত্যা করা হয়। এ ঘটনায় আহত হয় সাত রোহিঙ্গা। ক্যাম্পের নিরাপত্তার দায়িত্বে থাকা আর্মড পুলিশ ব্যাটালিয়ন (এপিবিএন) ও থানা পুলিশ বলছে, আধিপত্য বিস্তারকে কেন্দ্র করে আরসা সদস্যরা এ ঘটনা ঘটিয়েছে। জানা গেছে, হতাহত সবাই আরএসও সদস্য।

সর্বশেষ খবর