বৃহস্পতিবার, ১৩ জুন, ২০২৪ ০০:০০ টা

শেয়ারবাজার ৪২ মাসে ভয়াবহ বিপর্যয়ে

আলী রিয়াজ

শেয়ারবাজার ৪২ মাসে ভয়াবহ বিপর্যয়ে

ভয়াবহ বিপর্যয়ের মুখে পড়েছে দেশের শেয়ারবাজার। ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের (ডিএসই) প্রধান মূল্যসূচক গত ৪২ মাস বা সাড়ে তিন বছরের মধ্যে সর্বনিম্ন অবস্থানে নেমে গেছে। মাত্র তিন মাসের ব্যবধানে ডিএসই প্রধান সূচক প্রায় ১ হাজার পয়েন্ট কমেছে।

বাজার মূলধন হারিয়েছে প্রায় ১ লাখ কোটি টাকা। সর্বশেষ আগামী অর্থবছরের প্রস্তাবিত বাজেটে মূলধনী মুনাফা (গেইন ট্যাক্স) আরোপের ঘটনায় চরমভাবে বিপর্যস্ত হয়ে উঠেছে বাজার।

শেয়ারবাজারে বিনিয়োগ করে লাখো বিনিয়োগকারী নিঃস্ব হয়ে পথে বসেছেন। সাধারণ বিনিয়োগকারীদের পুঁজি হারিয়ে দিশাহারা ব্রোকারেজ হাউস ও মার্চেন্ট ব্যাংকগুলো। প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারীরাও চরমভাবে ক্ষতিগ্রস্ত। দিন যত যাচ্ছে পুঁজি হারিয়ে নিঃস্ব হচ্ছেন বিনিয়োগকারীরা। নিয়ন্ত্রক সংস্থার ঘন ঘন সিদ্ধান্ত পরিবর্তন, কারসাজি চক্রের দৌরাত্ম্য, নিত্যনতুন গুজবের ঘূর্ণিতে শেয়ারবাজারে চরম আস্থাহীনতার সৃষ্টি হয়েছে। লোকসান কমাতে কোনো দিশা খুঁজে পাচ্ছেন না সাধারণ ও প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারীরা।

শুরু হওয়া টানা পতন শেয়ারবাজারকে তলানির দিকে নিয়ে যাচ্ছে। চরম বিপর্যয়ের মুখে বাজারে ক্রেতার চেয়ে বিক্রেতা বেশি। গত এপ্রিল থেকে বিদেশি বিনিয়োগকারীরাও তাদের শেয়ার বিক্রি করে দিচ্ছেন। সর্বশেষ ডিএসইর প্রধান মূল্যসূচক ডিএসইএক্স ৫ হাজার ৮৩ পয়েন্টে দাঁড়িয়েছে। ডিএসইর মূল্যসূচক ৫ হাজার পয়েন্টের ঘরে ছিল ২০২০ সালের ডিসেম্বরে। চলতি বছরে ১২ মার্চ ডিএইসর সূচক ছিল ৬ হাজার পয়েন্ট। এই তিন মাসে সূচক কমেছে ১ হাজার পয়েন্ট। উল্লিখিত সময় ডিএসইর বাজার মূলধন ছিল ৭ লাখ ৩৬ হাজার কোটি টাকা। গতকাল সর্বশেষ বাজার মূলধন দাঁড়িয়েছে ৬ লাখ ৩০ হাজার কোটি টাকায়।

বাজার পর্যালোচনায় দেখা গেছে, চলতি বছরের শুরুতে শেয়ারবাজার কিছুটা ঘুরে দাঁড়াতে শুরু করে। করোনা মহামারির পর দীর্ঘদিন ফ্লোর প্রাইস দিয়ে শেয়ারের দাম এক জায়গায় আটকে রাখা হয়। এতে একটানা দরপতনে শেয়ারবাজার ভয়াবহ জটিল পরিস্থিতির তৈরি হয়। গত বছর থেকে ডলার সংকট শুরু হলে শেয়ারবাজার দরপতন আরও প্রকট হয়ে ওঠে। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ করতে বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন (বিএসইসি) ফ্লোর প্রাইস (দর কমার নির্ধারিত সীমা)  আরোপ করে। এরপরে বাজার আর ঘুরে দাঁড়াতে পারেনি। তবে চলতি বছরের গোড়ায় বাজার কিছুটা ঊর্ধ্বমুখী হয়ে উঠলেও ফের ভয়াবহ পতনের দিকে ছুটে চলতে শুরু করে। বিএসইসি বিভিন্ন সময় নানা ধরনের পদক্ষেপ নেওয়ার পরেও বাজার ঘুরে দাঁড়াতে পারেনি। এরপরে  চলতি বছরের জানুয়ারির মাঝামাঝি সময়ে ফ্লোর প্রাইস তুলে নেয় বিএসইসি। ফ্লোর প্রাইস তুলে নেওয়ার পর সাময়িক মূল্য সংশোধনের পর শেয়ারবাজার ঘুরে দাঁড়ায়। লেনদেন বেড়ে প্রায় ২ হাজার কোটি টাকার কাছাকাছি চলে আসে। সূচক বেড়ে ২২ মাসের মধ্যে সর্বোচ্চ অবস্থানে ওঠে। অধিকাংশ প্রতিষ্ঠানের শেয়ারের দাম বাড়ায় প্রায় প্রতিদিন বাড়তে থাকে মূল্যসূচক। এতে ১১ ফেব্রুয়ারি ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের (ডিএসই) প্রধান মূল্যসূচক ৬ হাজার ৪৪৭ পয়েন্টে উঠে আসে। কিন্তু গত এক মাসের ব্যবধানে ধারাবাহিক দরপতনের মধ্যে পড়ে ডিএসইর প্রধান সূচক এখন ৫ হাজার ৮৩ পয়েন্টে নেমে গেছে।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, নিয়ন্ত্রক সংস্থার ঘন ঘন সিদ্ধান্ত পরিবর্তন হচ্ছে। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে শেয়ারবাজার নিয়ে ছড়ানো হচ্ছে নানান গুজব। বাজারে সাপোর্ট দেওয়ার দায়িত্বে থাকা ইনভেস্টমেন্ট করপোরেশন অব বাংলাদেশ (আইসিবি) টাকার অভাবে পড়েছে। ব্যাংক, মার্চেন্ট ব্যাংক, অ্যাসেট ম্যানেজমেন্ট কোম্পানিগুলো শেয়ার কেনার বদলে বিক্রির চাপ বাড়াচ্ছে। আবার কিছু খাতের প্রতিষ্ঠানের ওপর থেকে বিনিয়োগকারীদের আস্থা নষ্ট হয়ে গেছে। সবকিছু মিলিয়েই শেয়ারবাজারে টানা দরপতন চলছে। বড় রকমের আস্থার সংকট চলছে শেয়ারবাজারে। বাজার নিয়ন্ত্রণের জন্য যে অবকাঠামো থাকা উচিত সেটা গত কয়েক বছরে নিশ্চিত করা যায়নি। ফলে ধরে রাখা যাচ্ছে না বাজারের নিয়ন্ত্রণ।

জানতে চাইলে পুঁজিবাজার বিশ্লেষক অধ্যাপক আবু আহমেদ বলেন, দীর্ঘ দরপতনের মুখে পড়েছে শেয়ারবাজার। কর্তৃপক্ষের উচিত ছিল বিপর্যস্ত বাজারে কিছু সুবিধা ঘোষণা করা। উল্টো শেয়ারবাজারের নেতিবাচক প্রভাব পড়ে এমন কিছু সিদ্ধান্তের কথা ঘোষণা করা হয়েছে। গেইন ট্যাক্স আরোপ এমন একটি সিদ্ধান্ত যা বাজারকে আরও বিপর্যস্ত করছে। এ ছাড়া তালিকাভুক্ত ও অতালিকাভুক্ত কোম্পানির ট্যাক্স পার্থক্য কমানো হয়েছে। এটা কোনোভাবে শেয়ারবাজারে ভালো বার্তা দেবে না। নতুন কোম্পানি বাজারে আসার আগ্রহ হারাবে। এ ছাড়া ব্যাংক সুদের হার বেড়েছে অনেক। বড় বড় ইনভেস্টর, মার্চেন্ট ব্যাংক, অ্যাসেট ম্যানেজার তারা তাদের টাকা বন্ড ও এফডিআরে খাটাচ্ছেন। ফলে শেয়ারবাজার দাঁড়াতে পারছে না। ডিএসই ব্রোকার্স অ্যাসোসিয়েশন (ডিবিএ) সভাপতি সাইফুল ইসলাম বলেন, মন্দা শেয়ারবাজারে আস্থা ফেরাতে প্রস্তাবিত বাজেটে আরোপ করা ক্যাপিটাল গেইন ট্যাক্স (মূলধনী মুনাফা) প্রত্যাহার করতে হবে।  প্রায় চার বছর ধরে শেয়ারবাজারে মন্দা বিরাজ করছে। প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারীরা রুগ্ণ হয়ে পড়েছে। যেভাবে বাজারে পতন হচ্ছে এর কোনো যৌক্তিক কারণ নেই। বাজার অস্থিতিশীল হয়ে পড়েছে। বিনিয়োগকারীদের ধরে রাখা কঠিন হয়ে যাচ্ছে। আমরা পুঁজিবাজারে রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন সংস্থাগুলোকে তালিকাভুক্ত করার জন্য একটি রোডম্যাপ প্রণয়ন করার অনুরোধ করছি। মানসম্পন্ন রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন কোম্পানি প্রতিযোগিতামূলক ভালো ব্যবসা তৈরিতে উৎসাহিত হবে।

সর্বশেষ খবর