রবিবার, ১৬ জুন, ২০২৪ ০০:০০ টা

মানুষের ঢল বাস লঞ্চ ট্রেনে

♦ টার্মিনাল রেলস্টেশনে উপচে পড়া ভিড় ♦ বাড়তি ভাড়া নেওয়ার অভিযোগ ♦ গাজীপুরে পার হতে যানজট নেই, টাঙ্গাইলে মহাসড়কে ধীরগতি

ওয়াজেদ হীরা

মানুষের ঢল বাস লঞ্চ ট্রেনে

নাড়ির টানে ছুটছে মানুষ। অনেকে ঝুঁকি নিয়ে উঠেছেন ট্রেনের ছাদে। টঙ্গী স্টেশন থেকে গতকাল তোলা ছবি -রোহেত রাজীব

ঈদের ছুটিতে স্বজনদের সঙ্গে ঈদ আনন্দ উদ্যাপন করতে বাড়ি ছুটছে মানুষ। যে যেভাবে পারছে সেভাবেই যানবাহনে চেপে বাড়ির পথ ধরেছে। রাজধানীর বাস টার্মিনাল, রেলস্টেশন, সদরঘাটের লঞ্চঘাটে ঘরমুখো মানুষের চাপ বেড়েছে কয়েক গুণ। অলিগলি থেকে সড়ক-মহাসড়ক সব পথেই বাড়ি ফেরা মানুষের ঢল। ঢাকা ছেড়ে যাওয়ার সব সড়ক বেশ ফাঁকা। ফলে ভোগান্তি ছাড়াই স্বস্তির হাসি নিয়ে ঢাকা ছাড়তে দেখা গেছে মানুষকে। তবে বিভিন্ন মহাসড়কের কিছু কিছু স্থানে যানজটের কারণে পরবর্তীতে ধীরগতিতে চলছে যানবাহন।

ঈদের ছুটি শুরু হয়েছে শুক্রবারই। তবে শনিবার কিছু বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের শেষ কর্মদিবস ছিল। সে কারণে অনেকেই দ্রুত অফিসের কাজ শেষ করে ধরেন বাড়ির পথ। গতকাল সকাল থেকেই রাজধানীর মহাখালী, গাবতলী, সায়েদাবাদ বাস টার্মিনালে ভিড় দেখা যায়। দুপুরের পর সে ভিড় আরও কয়েক গুণ বেড়ে যায়। বাড়ি ফেরা মানুষের ঢল দেখা গেছে কমলাপুর রেলস্টেশনেও। এ ছাড়া বিমানবন্দর রেলস্টেশনেও কাক্সিক্ষত ট্রেনে উঠতে শত শত মানুষকে অপেক্ষা করতে দেখা যায়। এদিকে বাড়তি চাপের কারণে অনেক বাস বাড়তি ভাড়া নিচ্ছে-এমন অভিযোগ যাত্রীদের। ঢাকা থেকে উত্তরবঙ্গ এবং গাজীপুর হয়ে যাতায়াতে কোনো সমস্যা হয়নি। তবে দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের বিভিন্ন জেলায় যারা পদ্মা সেতু হয়ে বাড়ি ফিরছে তাদের ঢাকা থেকে বের হতে একটু ভোগান্তিতে পড়তে হয়েছে।

গতকাল ধানমন্ডিতে আওয়ামী লীগ সভানেত্রীর রাজনৈতিক কার্যালয়ে এক ব্রিফিংয়ে ঈদযাত্রায় সড়কে যানজট নিয়ে সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের বলেন, কিছু কিছু জায়গায় যানজট হলেও কোথাও ঘণ্টার পর ঘণ্টা অপেক্ষা করতে হয়নি। এবারের ঈদটা ভিন্ন। ধীরগতির পশুবাহী গাড়ি, সড়কের পাশে পশুর হাট একটা সমস্যা। রাস্তা কোনো সমস্যা নয় যানজটের জন্য। এবার সড়কে অনেক বেশি যানবাহন। যানবাহনের ভিড়টা অনেক বেশি।

বাস টার্মিনালে মানুষ আর মানুষ, অপেক্ষা পথে পথেও : রাজধানীর তিনটি বাস টার্মিনালে সকাল থেকে ব্যাগহাতে মানুষ আর মানুষ দেখা গেছে। এ ছাড়া পথের মোড়ে মোড়ে কাক্সিক্ষত বাসের অপেক্ষা করতে দেখা গেছে। সুযোগ বুঝে অনেকেই বাড়তি ভাড়া আদায় করছে। বিশেষ করে মহাখালী থেকে ময়মনসিংহ, নেত্রকোনা, শেরপুর, জামালপুরগামী পরিবহনগুলো নির্ধারিত ভাড়া থেকে কয়েক গুণ বেশি নিতে দেখা যায়। আসন না পেয়ে অনেকেই দাঁড়িয়ে যাত্রা করছে দীর্ঘ গন্তব্যে। ইকবাল নামে যাত্রী বলেন, ‘অন্য সময় ২৫০, কখনো ৩০০ টাকায় ময়মনসিংহ যাতায়াত করি। এবার কোনো গাড়ি ৫০০, কোনো গাড়ি আরও বেশি ভাড়া নিচ্ছে।’ জামালপুর-শেরপুর যেতে নির্ধারিত ভাড়ার চেয়ে ৫০০ থেকে ৭০০ টাকা বেশি দিতে হচ্ছে বলেন অনেকেই। সায়েদাবাদ বাস টার্মিনালে দেখা যায় উপচে পড়া ভিড়। টিকিট সংকট না থাকলেও প্রায় প্রতিটি রুটেই বাড়তি ভাড়া আদায়ের অভিযোগ করেন যাত্রীরা। বাস টার্মিনাল ও জনপথের মোড়ের কাউন্টারগুলোয় দেখা যায় টিকিট নিয়ে চলছে দরদাম। লক্ষ্মীপুরগামী যাত্রী সিরাজ উদ্দিন বলেন, ‘ইকোনো বাসে ৫০০ টাকার ভাড়া ৭৫০-এ উঠেছে। ফরিদপুরগামী সাউদিয়া পরিবহন ৫০০ টাকার ভাড়া ঈদের সময় ৭০০-৮০০ করে নিচ্ছে। হিমালয় ও আল বারাকাহ পরিবহনে দেখা যায় বাড়তি ভাড়া নেওয়ার বিষয়টি। একাধিক বাস কাউন্টারে টিকিট বিক্রেতারা জানান, ঈদে ১০০-২০০ টাকা ভাড়া বৃদ্ধি এটা স্বাভাবিক। মানুষের চাপ বেশি। মানুষই ভালোবেসে একটু বাড়িয়ে দিয়ে ভালো সিট চায়। টিকিট বিক্রেতাদের মতে, রাজধানী থেকে যে বাসগুলো যাচ্ছে সেগুলো খালি ফিরে আসছে। গাবতলী বাস টার্মিনালেও ঘরে ফেরা মানুষের ভিড় দেখা যায়। গাবতলীর প্রধান সড়কের সামনের ফুটপাত ও কাউন্টারগুলোর সামনে বাড়ি ফেরা মানুষের ভিড় সব থেকে বেশি। উত্তরবঙ্গের বিভিন্ন গন্তব্যে যাওয়ার অপেক্ষায় রয়েছে হাজারো মানুষ।

গাজীপুরে যানজট নেই, ঢাকা-টাঙ্গাইল মহাসড়কে ধীরগতি : গাজীপুর দিয়ে ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়কে যারা যাত্রা করছে তাদের গাজীপুর পার হতে কোনো ভোগান্তি পোহাতে হচ্ছে না। তবে এরপর মাওনা গিয়ে গাড়ির ধীরগতি হচ্ছে। ঈদযাত্রায় ঢাকা-টাঙ্গাইল মহাসড়কে যানবাহনের চাপ বৃদ্ধির কারণে গতকাল ভোর থেকেই বঙ্গবন্ধু সেতুর পুব প্রান্ত থেকে টাঙ্গাইলের এলেঙ্গা পর্যন্ত ১৩ কিলোমিটারজুড়ে থেমে থেমে যানজট দেখা গেছে। ধীরগতিতে চলছে সকল প্রকার গাড়ি। পুলিশ ও সেতু কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে, সেতুর ওপর কয়েকটি গাড়ি বিকল হলে সেগুলো সরিয়ে নিতে কিছুটা সময় লাগে।

টাঙ্গাইল প্রতিনিধি জানান, ঢাকা-টাঙ্গাইল-বঙ্গবন্ধু সেতু মহাসড়কে যানবাহন ধীরগতিতে চলাচল করেছে। পরিবহনগুলো অতিরিক্ত ভাড়া নিচ্ছে। আঞ্চলিক সড়কেও সিএনজি ভাড়া বেশি নেওয়া হচ্ছে অভিযোগ যাত্রীদের। যানবাহনস্বল্পতার কারণে অনেক যাত্রী জীবনের ঝুঁকি নিয়ে পিকআপ ভ্যান, খোলা ছাদের ট্রাক ও বাসের ছাদে করে বাড়ি যাচ্ছে।

কালিয়াকৈর প্রতিনিধি জানান, গাজীপুরের কালিয়াকৈর উপজেলার চন্দ্রায় গতকাল বিকালেও কমেনি ঢাকা-টাঙ্গাইল মহাসড়কে যানজট। গাড়ি চলছে ধীরগতিতে। নবীনগর মহাসড়ক ও ঢাকা-টাঙ্গাইল মহাসড়কের দুই লাইনেই যানবাহন চলছে ধীরগতিতে, কোথাও আবার থেমে রয়েছে।

স্বাচ্ছন্দ্যে রেলে ঈদযাত্রা : ট্রেনে চেপে স্বস্তিতেই বাড়ি যাচ্ছে হাজার হাজার মানুষ। অনেককেই কাক্সিক্ষত ট্রেনের জন্য প্ল্যাটফরমে অপেক্ষা করতে দেখা যায়। তবে চোখে মুখে নেই কোনো বিরক্তির ছাপ। সড়কের ধকল কাটাতে অনেকেই বেছে নেয় রেলপথ। টিকিট না পেলে অনেকেই কাটে স্ট্যান্ডিং টিকিট। যাত্রার চতুর্থ দিনে গতকাল কোনো সূচিবিপর্যয় দেখা যায়নি। তবে উত্তরবঙ্গগামী ট্রেনগুলোয় যাত্রীর প্রচুর ভিড় দেখা গেছে। যাত্রীরা জানান, বাসের চেয়ে অনেক কম সময় লাগে ট্রেনে। কোনো যানজটের টেনশন নেই।

গতকাল সকাল থেকে রাত পর্যন্ত দুটি স্পেশালসহ মোট ৬৯ জোড়া ট্রেন চলাচল করবে বলে জানিয়েছেন স্টেশন ম্যানেজার মোহাম্মদ মাসুদ সারওয়ার। বাংলাদেশ রেলওয়ের ঢাকা বিভাগের বাণিজ্যিক কর্মকর্তা শাহ আলম কিরণ শিশির বলেন, ‘মোট আসনের বিপরীতে ২৫ শতাংশ স্ট্যান্ডিং টিকিট আমরা দিচ্ছি। তিন-স্তর-বিশিষ্ট টিকিট চেকিংয়ের ব্যবস্থা রয়েছে। তাই টিকিট ছাড়া যাওয়ার উপায় নেই।’

ট্রাক পিকআপে ছুটছে মানুষ : গাড়িতে সিট না পেয়ে অনেকেই ছুটটে ট্রাক-পিকআপে। ভাড়া দরকষাকষি করে অনেকেই পশুবাহী ফেরত যাওয়া গাড়িতে উঠে পড়ছে। ঢাকা থেকে বিভিন্ন গন্তব্যে এভাবে যাত্রা করছে অনেকেই। তবে পোশাকশ্রমিকের অনেকেই দলবদ্ধ হয়ে এ ধরনের ট্রাক-পিকআপ ভাড়া নিয়ে যাচ্ছেন বলে জানা গেছে।

চাপ বেড়েছে লঞ্চঘাটেও : ঘরমুখো যাত্রীর পদচারণে মুখর ঢাকার প্রধান নদীবন্দর সদরঘাট। গতকাল ভোরে ফজরের নামাজের পরই যাত্রীরা সদরঘাটে আসতে শুরু করে। বেলা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে যাত্রীচাপ বাড়তে থাকে। পদ্মা সেতুর কারণে বরিশাল রুটে যাত্রীর চাপ কিছুটা কম। তবে চাঁদপুর, ভোলা, বরগুনা, হাতিয়া, পটুয়াখালীগামী পন্টুনে যাত্রীর ভিড় ছিল। এদিকে সিঁড়িতে রেলিং না দেওয়ায় ও নিয়ম না মেনে পন্টুনে ভেড়ানোর চেষ্টা করায় ঢাকার সদরঘাটে দুটি লঞ্চকে জরিমানা করেছে বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌপরিবহন কর্তৃপক্ষ (বিআইডব্লিউটিএ)।

দৌলতদিয়া প্রান্তে স্বস্তির যাত্রা : রাজবাড়ী প্রতিনিধি জানান, দৌলতদিয়া-পাটুরিয়া নৌরুটের লঞ্চ ও ফেরিতে উপচে পড়া ভিড় রয়েছে। তবে কোনো ভোগান্তি নেই দৌলতদিয়া প্রান্তে। নির্বিঘ্নে মানুষ পদ্মা পাড়ি দিচ্ছে। দৌলতদিয়া-পাটুরিয়া নৌরুটে ১৮টি ফেরি ও ২০টি লঞ্চ চলাচল করছে। দৌলতদিয়া প্রান্তে চারটি ফেরিঘাট সচল রয়েছে। মানুষ স্বস্তিতে বাড়িতে যাচ্ছে।

সর্বশেষ খবর