রবিবার, ২৩ জুন, ২০২৪ ০০:০০ টা

হঠাৎ রাসেলস ভাইপার আতঙ্ক

উৎকণ্ঠা গুজবে, দংশনের ১০০ মিনিটের মধ্যে অ্যান্টিভেনম নিলে নিরাপদ

জিন্নাতুন নূর

হঠাৎ রাসেলস ভাইপার আতঙ্ক

বাংলাদেশের বিভিন্ন অঞ্চলে হঠাৎ করে রাসেলস ভাইপার বা চন্দ্রবোড়া সাপ নিয়ে আতঙ্ক দেখা দিয়েছে। সাপটি চর ও বরেন্দ্র অঞ্চলে বেশি দেখা গেলেও এখন চাঁদপুর, বরিশাল, মানিকগঞ্জ, মুন্সীগঞ্জ, ফরিদপুর, শরীয়তপুর পটুয়াখালীতে বিস্তৃত হয়েছে। সাপ বিশেষজ্ঞ ও সাপ উদ্ধারকারীরা বাংলাদেশ প্রতিদিনকে জানান, মূলত সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে গুজব ছড়ানোর কারণে রাসেলস ভাইপার নিয়ে হঠাৎ এত আতঙ্ক। তারা আরও জানান, এটি মোটেও দেশের সবচেয়ে বিষধর সাপ নয়। তবে এ সাপের দংশনে মানুষের কিডনি ফেইল, হার্ট ও ফুসফুসের সমস্যাসহ দেহে রক্তকণিকা নষ্ট এবং অভ্যন্তরীণ রক্তক্ষরণ হওয়ার আশঙ্কা আছে। দংশনের পর দ্রুত অ্যান্টি ভেনম নেওয়া হলে রোগী ৯০ থেকে ১০০ ভাগ সুস্থ হয়ে যাবেন। উদ্বেগের বিষয় হচ্ছে, রাসেলস ভাইপার মনে করে আতঙ্কে মানুষ এখন অন্য সাপ দেখা মাত্রই মেরে ফেলছেন। এতে পরিবেশের ভারসাম্য নষ্ট হচ্ছে। জানা যায়, দেশে বছরে ৪ লাখ মানুষ সাপের দংশনের শিকার হন। আর মারা যান সাড়ে ৭ হাজারের মতো। তবে এর বেশির ভাগই কোবরা ও কেউটে সাপের কারণে। তবে গত এক-দুই মাসে রাসেলস ভাইপারের কামড়ে কমপক্ষে ১০ জন মানুষ মারা গেছেন। এর অধিকাংশই কৃষক এবং জেলে। রাসেলস ভাইপার দেখতে অনেকটা অজগরের মতো। সাপটি দৈর্ঘ্যে তিন থেকে পাঁচ ফুট পর্যন্ত হয়ে থাকে। এই সাপ মানুষের বসতি এড়িয়ে চলে। সাধারণত নিচু ভূমির ঘাসবন, ঝোপজঙ্গল, উন্মুক্ত বন, কৃষি এলাকায় সাপটি বাস করে। এটি মেটে রঙের হওয়ায় মাটির সঙ্গে সহজে মিশে যেতে পারে। মানুষ খেয়াল না করে সাপের খুব কাছে গেলে সাপটি বিপদ দেখে ভয়ে আক্রমণ করে। এরই মধ্যে পদ্মা তীরবর্তী চরাঞ্চলজুড়ে এ সাপের আতঙ্ক ছড়িয়েছে। সেখানে কৃষক ও চাষিরা ফসলি জমিতে এখন গামবুট পায়ে দিয়ে চলাফেরা বা চাষাবাদ করছেন।

সাপ বিশেষজ্ঞরা বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, গত বছরের তুলনায় এ বছর হয়তো সামান্য বংশ বৃদ্ধি করেছে। সাপ নিয়ে দেশে তেমন কোনো গবেষণা নেই। ২০১৩ সালের পর থেকে দেশে আবার এই সাপের দেখা মেলে। আগে চরাঞ্চলে কৃষিকাজ কম হতো। এখন সেখানে কৃষিকাজ বেড়ে যাওয়ায় কৃষকরা এই সাপ দেখতে পারছেন। এসব চরে আগে যেসব শিকারি প্রাণী ছিল, মানুষের কারণে এখন সেগুলো আর নেই। এতে চন্দ্রবোড়া সাপটি সেখানে বংশবৃদ্ধি করে যাচ্ছে। রাসেলস ভাইপারের আক্রমণে দেহে বিভিন্ন রকমের বিষক্রিয়া হয়। তবে এর বিষের মাত্রা কোবরার মাত্রার চেয়ে কম। এখন পর্যন্ত এ সাপের কামড়ে সবচেয়ে বেশি রাজশাহী এলাকার মানুষের মৃত্যু হয়েছে।

বন্যপ্রাণী ও পরিবেশ বিশেষজ্ঞ মো. আবু সাইদ গতকাল বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, আক্রমণের আগে রাসেলস ভাইপার খুব জোরে শিস দিয়ে মানুষকে দংশন করে। এক সময় রাজশাহী, রংপুর, খুলনা ও চট্টগ্রামে এই সাপ মিলেছিল। এ ছাড়া নওগাঁ, নাটোর ও ফরিদপুরেও এর দেখা মেলে। ২০১৬ সালের পর থেকে এর বিস্তৃতি অন্য জেলাতেও দেখা যাচ্ছে। এরা বর্ষায় নদীর পানিতে কচুরিপানার সঙ্গে ভেসে এক জায়গা থেকে অন্যত্র চলে যায়।

এরই মধ্যে পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রী সাবের হোসেন চৌধুরীর নির্দেশনায় বাংলাদেশ বন বিভাগ পরিস্থিতি মোকাবিলায় বিভিন্ন পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে। পরিবেশ মন্ত্রণালয় থেকে জানানো হয় যে, সাপটি দক্ষ সাতারু হওয়ায় নদীর স্রোত ও বন্যার পানিতে দেশের বিভিন্ন এলাকায় ছড়িয়েছে। এজন্য যেসব এলাকায় এ সাপ দেখা গেছে, সেখানে চলাচলে বাড়তি সতর্কতা অবলম্বন করতে হবে। গর্তের মধ্যে হাত-পা ঢোকানো যাবে না। সংশ্লিষ্ট এলাকায় কাজ করার সময় বুট এবং লম্বা প্যান্ট পরতে হবে। রাতে চলাচলের সময় অবশ্যই টর্চ লাইট ব্যবহার করতে হবে। বাড়ির চারপাশ পরিষ্কার রাখতে হবে। জ্বালানির লাকড়ি ও খড় সরানোর সময় সাবধানতা নিতে হবে। সাপ দেখলে তা মারার চেষ্টা করা যাবে না। প্রয়োজনে জাতীয় হেল্পলাইন ৩৩৩-তে ফোন করতে বা নিকটস্থ বন বিভাগের অফিসে জানাতে হবে। আর সাপ কামড় দিলে দংশিত অঙ্গ নড়াচড়া করা যাবে না। পায়ে দংশনে বসে যেতে হবে। হাঁটা যাবে না। হাতে দংশনে হাত নড়াচড়া করা যাবে না। হাত-পায়ের গিড়া নাড়াচাড়ায় মাংসপেশীর সংকোচনের ফলে বিষ দ্রুত রক্তের মাধ্যমে শরীরে ছড়িয়ে গিয়ে বিষক্রিয়া করতে পারে। আক্রান্ত স্থান সাবান দিয়ে আলতোভাবে ধুতে হবে অথবা ভেজা কাপড় দিয়ে আলতোভাবে মুছে দিতে হবে। ঘড়ি বা অলংকার খুলে ফেলতে হবে। দংশিত স্থান কাটা বা সুই ফোটানো যাবে না। কোনো প্রলেপ লাগানো যাবে না। সাপে কাটলে ওঝার কাছে গিয়ে সময় নষ্ট করা যাবে না। দ্রুত নিকটস্থ হাসপাতাল বা স্বাস্থ্যসেবা কেন্দ্রে যেতে হবে।

এ ছাড়া স্বাস্থ্য ও পরিবারকল্যাণ মন্ত্রী ডা. সামান্ত লাল সেন গতকাল সারা দেশের সিভিল সার্জন, পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা, বিভাগীয় পরিচালক, মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের পরিচালকদের সঙ্গে অনলাইন প্লাটফর্মে জুম মিটিং করেছেন। এ সময় তিনি বলেন, দেশে পর্যাপ্ত পরিমাণ বিষ প্রতিষেধক বা অ্যান্টিভেনম আছে। এরই মধ্যে সব জায়গায় হাসপাতালগুলোতে অ্যান্টিভেনম রাখার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। সাপ দংশনের পর সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে রোগীকে দ্রুত ডাক্তারের কাছে নিয়ে যাওয়া।   স্নেক রেসকিউ টিম’ বাংলাদেশের সাধারণ সম্পাদক প্রীতম সুর রায় বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, গত সেপ্টেম্বর থেকে গত মে মাস পর্যন্ত আমরা চার থেকে পাঁচটি রাসেলস ভাইপার উদ্ধার করেছি। তবে সাপটি নিয়ে মানুষের মধ্যে গুজব ছড়িয়ে পড়ায় এ নিয়ে এক ধরনের আতঙ্ক তৈরি হয়েছে। এজন্য মানুষ এখন অন্য সাপ দেখলেও আতঙ্কে সেগুলো মেরে ফেলছেন। পদ্মা তীরবর্তী অঞ্চলে এ সাপ বেশি দেখা যায়। তবে এখন বন্যার সময় এগুলো সমতল ভূমিতে চলে আসছে। আগের চেয়ে এ সাপের পরিমাণ যে বৃদ্ধি পেয়েছে এমনও না। আবার এক জেলায় এই সাপ উদ্ধার হলে তার ছবি অন্য জেলার কিছু মানুষ ফেসবুকে ব্যবহার করায় আতঙ্ক ছড়াচ্ছে। যেহেতু এ সাপের বিষের ধরন ‘হেমোট্রক্সিন’  এজন্য শরীরের অভ্যন্তরে রক্ত প্রবাহে সমস্যা হয়। তবে সঠিক সময়ে হাসপাতালে নেওয়া হলে রোগীর সুস্থ হওয়ার সম্ভাবনা ৯০ থেকে ১০০ শতাংশ থাকে।  বেসরকারি সংস্থা ‘ডিপ ইকোলজি অ্যান্ড ¯েœক কনজারভেশন ফাউন্ডেশন’-এর কমপ্লায়েন্স অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট অফিসার  সৈয়দা অনন্যা ফারিয়া বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, রাসেলস ভাইপার আমাদের দেশীয় সাপ নয় এবং এটি ঢাকায় ধেয়ে আসছে, এ দুটি বিষয় মানুষের মধ্যে আতঙ্ক তৈরি করেছে। ১৯৬৮ সাল থেকেই পদ্মা তীরবর্তী এলাকায় সাপটি ছিল। মাঝের সময়টিতেও বরেন্দ্র অঞ্চলে সীমিত পরিসরে সাপটি ছিল। দেশে নতুন চর জেগে ওঠায় সেখানে মানুষের কৃষিকাজ বৃদ্ধি পাওয়ায় আবারও সাপটি দৃশ্যমান হয়ে উঠেছে। আর বর্ষাকাল সাপটির প্রজননের সময়, এ সময় প্রতিবছরই সাপটির দেখা মেলে। এ সাপ কিছু নির্দিষ্ট এলাকায় নজরে পড়ছে। অন্য এলাকায় দুধরাজ, অজগর এ ধরনের সাপ নজরে আসছে। কিন্তু মানুষ এগুলোকে রাসেলস ভাইপার মনে করে মেরে ফেলছে। ঢাকার কাছে মানিকগঞ্জ, মুন্সীগঞ্জ ও দোহারে আগেও সাপটি ছিল। এসব এলাকা পদ্মার কাছে হওয়ায় সেখানে এর দেখা মিলছে। তবে ঢাকায় এ সাপ আসার কোনো সুযোগ নেই। সাপটিও দেশের সবচেয়ে বিষধর সাপ নয়। এর বিষের তীব্রতা কম হলেও এটি খুব যন্ত্রণাদায়ক। এ সাপ কামড়ালে দ্রুত অ্যান্টি ভেনম না নিলে লিভার, কিডনি ফেইল করে। সাপে কামড়ানোর ৪ ঘণ্টার মধ্যে অ্যান্টি ভেনম দিলে কাজ হয়। কিন্তু দংশনের  ১০০ মিনিটের মধ্যে অ্যান্টি ভেনম দিলে নিরাপদ থাকা যায়। এ ক্ষেত্রে অ্যান্টি ভেনম নিলেও রোগীকে পুরো চিকিৎসা নিতে হবে। না হলে ১৫-২০ দিন পর রোগীর আবার সমস্যা দেখা দিতে পারে।

সর্বশেষ খবর