শিরোনাম
বুধবার, ২৬ জুন, ২০২৪ ০০:০০ টা
নৈতিক অবক্ষয় চরমে

বেড়েছে সামাজিক অপরাধ

মা-বাবা সন্তানকে, সন্তান হত্যা করছে মা-বাবাকে ♦ জমি নিয়ে বিরোধ, আর্থিক অনটন, মাদকাসক্তি, সুইসাইড ♦ পারিবারিক কলহ মূল কারণ

জিন্নাতুন নূর

বেড়েছে সামাজিক অপরাধ

দেশে নৈতিক অবক্ষয় চরম আকার ধারণ করেছে। মানবিক গুণগুলো ধীরে ধীরে কমে যাচ্ছে। বিভিন্ন ঘটনা ও কেস স্টাডি বলছে, কিছু মা-বাবা কোনো কিছু চিন্তা না করেই এখন নিজ সন্তানকে হত্যা করছেন। আবার সন্তানদেরও মা-বাবাকে হত্যা করতে হাত কাঁপছে না। এর কারণ অনুসন্ধানে দেখা যাচ্ছে, জমি নিয়ে বিরোধ, অনৈতিক সম্পর্ক, আর্থিক অনটন, মাদকাসক্তি, পারিবারিক কলহের জেরে এ ধরনের সামাজিক অপরাধ ঘটছে। সমাজ ও মনোবিজ্ঞানীরা বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলছেন, দেশে এখন যে সামাজিক অপরাধগুলো সংঘটিত হচ্ছে তার বেশির ভাগই অর্থসম্পদকে কেন্দ্র করে হচ্ছে। একটা সময় ছিল যখন পরিবারের মধ্যে সম্পদ ভাগাভাগি হতো না। কিন্তু পরিস্থিতি বদলে গিয়েছে। জমিজমাকে কেন্দ্র করে এখন সামাজিক অপরাধ সংঘটিত হচ্ছে। অর্থ-সম্পদ ও টাকা-পয়সার প্রতি মানুষের মোহ বাড়ছে। আর এসব কারণে সামাজিক অপরাধের মতো ঘটনাও ঘটছে। মানুষের মধ্যে এখন সহিষ্ণুুতার অনেক অভাব। যত দিন যাচ্ছে মূল্যবোধের অবক্ষয়ে সামাজিক অপরাধও বাড়ছে। এ কারণে পারিবারিক বন্ধনও শিথিল হয়ে যাচ্ছে।

বিশেষজ্ঞদের মতে, সামাজিক অপরাধগুলোর সঙ্গে অর্থনৈতিক চাপের সম্পর্ক রয়েছে। ঋণগ্রস্ত হয়ে অনেক মানুষ এখন নিজে আত্মহত্যা করে তার পরিবারের সদস্যদেরও হত্যা করছেন। মনোবিজ্ঞানীরা একে ‘সিরিয়াল সুইসাইড’ বলছেন। এ ধরনের বিষণœ রোগীদের অবশ্যই চিকিৎসকের কাছে যেতে হবে। সামাজিক অপরাধ দমনে অপরাধীদের মোটিভেশন দেওয়া খুব গুরুত্বপূর্ণ। এর সঙ্গে পরিবারগুলোতে যে সাংস্কৃৃতিক ও সামাজিক মূল্যবোধ আছে এ বিষয়ে সন্তানদের সঙ্গে আলোচনা করতে হবে।

কেস স্টাডি-১ : কিশোরগঞ্জের ভৈরবে নিজের নবজাতক সন্তানকে নয় তলা ভবন থেকে নিচে ফেলে হত্যা করেন তার মা তৃষা আক্তার। ঈদুল আজহার দিন রাত সাড়ে ৩টায় শহরের নিউটাউন এলাকায় অবস্থিত ফুল মিয়া সিটির নয় তলা থেকে তৃষা তার সাত দিন বয়সি সন্তানকে নিচে ফেলে হত্যা করেন। পুলিশের জিজ্ঞাসাবাদে সন্তানকে হত্যা করার কথা স্বীকার করেন তৃষা। জানা যায়, মৃত সন্তানের বাবা সহকারী অধ্যাপক ডা. ওসমান গনির দ্বিতীয় স্ত্রী তৃষা। স্বামীর সঙ্গে তার বয়সের পার্থক্য ৩০ বছরের। এই দম্পতির মধ্যে প্রায়ই মনোমালিন্য হতো। নানা কারণে তৃষা মানসিক যন্ত্রণায় থাকতেন। তাদের দেড় বছর বয়সি একটি পুত্র সন্তান আছে। কিন্তু দ্বিতীয় সন্তান নেওয়ার ইচ্ছা তৃষার ছিল না। স্বামীর কথায় দ্বিতীয় সন্তান নিয়ে মানসিকভাবে বিপর্যস্ত ছিলেন। এ কারণে নিজের সন্তানকে হত্যা করেছেন বলে পুলিশের কাছে স্বীকার করেন এই মা।

কেস স্টাডি-২ : মশিউর রহমান আর্থিক অনটনের কারণে নিজে আত্মহত্যা করেন এবং তার উচ্চমাধ্যমিকে পড়ুয়া সন্তান মোদাব্বির রহমানকে (১৮) হত্যা এবং ৭ম শ্রেণিতে পড়ুয়া কন্যা সন্তানকে হত্যার চেষ্টা করেন। ছেলের মৃত্যু হলেও মেয়েকে আহত অবস্থায় হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। গত এপ্রিল মাসের প্রথম সপ্তাহে রাজধানীর আগারগাঁওয়ের মোল্লারপাড়া এলাকায় এ দুর্ঘটনা ঘটে। পুলিশের ধারণা ছেলেকে হত্যার পর তার বাবা আত্মহত্যা করেন। মশিউর দীর্ঘদিন ধরে ঢাকায় বসবাস করতেন। মশিউরের স্ত্রী মজিদা জানান, আর্থিক অনটনের কারণে তার স্বামী হতাশাগ্রস্ত হয়ে ছেলেকে খুন করে নিজে আত্মহত্যা করেছেন। তার মেয়েকেও খুন করতে চেয়েছিলেন।

কেস স্টাডি-৩ : ঠিকমতো নিজের সন্তান ইসরাফিলকে বুকের দুধ পান করাতে পারতেন না মা রেহেনা খাতুন (৩২)। এ জন্য আড়াই মাসের শিশু সন্তানের কান্নাকাটি সহ্য করতে না পেরে শিশুটিকে প্রথমে মাটিতে আছড়ে, পরে গলা টিপে শ্বাসরোধে হত্যা করেন রেহেনা। কুষ্টিয়ার কুমারখালীর চাঁদপুর ইউনিয়নের আনন্দনগর গ্রামের কৃষক জিয়াউর রহমানের স্ত্রী রেহেনা চলতি মাসের মাঝামাঝি এ ঘটনা ঘটান। এ দম্পতির আরও তিন মেয়ে সন্তান আছে। রেহেনার মা রানু খাতুনের ভাষ্য, তার মেয়ে মানসিকভাবে সুস্থ নন। 

কেস স্টাডি-৪ : গত মে মাসের ২৩ তারিখ মৌলভীবাজারের শ্রীমঙ্গলে বিষ খাইয়ে নিজের প্রতিবন্ধী শিশু সন্তানকে হত্যা করে তার বাবা রাশেদ মিয়া এবং মা শাপলা বেগম। উপজেলার ভুনবীর ইউনিয়নের রাজপাড়া গ্রামের রাশেদ-শাপলা দম্পতির দুই বছরের সন্তান ফারিয়া জান্নাত জন্মগতভাবেই শারীরিক প্রতিবন্ধী। সে চলাফেরা করতে পারত না। মা-বাবা তার দেখাশোনা করতে গিয়ে অধৈর্য হয়ে নিজের সন্তানের মুখে বিষ ঢেলে বাড়ি থেকে পালিয়ে যান। পরে শিশুটির নানা ওয়াসির মিয়া বাদী হয়ে মামলা করলে পুলিশ তাদেন গ্রেফতার করে। প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে তারা শিশুটিকে হত্যার কথা স্বীকার করেন।

এ ছাড়া গত ফেব্রুয়ারির প্রথম সপ্তাহে জমি নিয়ে বিরোধের জেরে প্রতিপক্ষকে ফাঁসাতে গিয়ে মরিয়ম নামের আট বছর বয়সি সন্তানকে হত্যা করে তার মা রিনা বেগম ও চাচা সেন্টু মিয়া। পটুয়াখালীর দশমিনা উপজেলার বেতাগী সানবিপুর ইউনিয়নের রামবল্লভ গ্রামে এ হত্যার ঘটনা ঘটে। গত মার্চের শেষদিকে ঢাকার দক্ষিণ কেরানীগঞ্জে পারিবারিক কলহের জেরে দুই ছেলে মিলে তাদের বাবা হাবিব খানকে শ্বাসরোধে হত্যা করে। বড় ভাই রাব্বিকে বের করে দেওয়ার জেরে ছোট ভাই সাব্বির তার ভাইকে নিয়ে নিজের বাবাকে পিটিয়ে হত্যা করে।

মানবাধিকারকর্মী অ্যাডভোকেট এলিনা খান বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, যে সামাজিক চর্চায় থাকার কথা তা না করে আমরা ক্রমাগত বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ছি। কেউ কারোর বিষয় নিয়ে এখন মাথা ঘামাই না। কারও বিপদে এগিয়ে যাই না, আবার কারও বিপদে বেশি এগিয়ে যাই। অর্থাৎ কোথাও আমাদের ভারসাম্যপূর্ণ কোনো অবস্থান নেই। ফলে সামাজিক অপরাধগুলো ঘটছে। এজন্য পরিবার, বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান ও সমাজে মানুষদের মোটিভেশন বাড়াতে হবে।

মনোচিকিৎসক অধ্যাপক মো. গোলাম রাব্বানী বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, যে ব্যক্তি পরিবারের সদস্যদের হত্যা করে নিজে আত্মহত্যা করে বা করতে চায় তার মধ্যে বিষণœতা থাকে। একই সঙ্গে তার মধ্যে উদ্বিগ্নতাও থাকে। সে নিজে ঋণগ্রস্ত হওয়ায় এবং পরিবারকে ধ্বংস করার কারণে উদ্বিগ্ন থাকেন। তখন তিনি চিন্তা করেন যে, তার ঋণগ্রস্ত হওয়ায় পরিবারকে বিপদে ফেলায় তিনি যদি আত্মহত্যা করেন তখন তার পরিবারকেও সমস্যায় পড়তে হতে পারে। এজন্য তিনি নিজে আত্মহত্যা করেন এবং পরিবারের অন্যদেরও হত্যা করতে চান। এ ধরনের চিন্তার ওপর ভিত্তি করেই সাধারণত একটু বেশি বয়সি বা মধ্য বয়সি লোকেরা যাদের অতিরিক্ত উদ্বিগ্নতা থাকে তারা এ ধরনের বিপজ্জনক কাজ করেন। আমরা এ ধরনের কাজকে ‘সিরিয়াল সুইসাইড’ বলি।

সর্বশেষ খবর