বুধবার, ২৬ জুন, ২০২৪ ০০:০০ টা

কেন থামছে না সড়ক দুর্ঘটনা

বিআরটিএর হিসাবে মে মাসে প্রাণ হারিয়েছেন ৪৫৭ জন

জয়শ্রী ভাদুড়ী

কাকডাকা ভোরে ভ্যানে করে মাছ নিয়ে স্থানীয় বাজারের দিকে যাচ্ছিলেন মাছ ব্যবসায়ী বরুণ চন্দ্র। বরিশালের গৌরনদী উপজেলার বাটাজোড় এলাকায় পৌঁছলে ঢাকা থেকে ছেড়ে আসা বরিশালগামী একটি ট্রাক ভ্যানটিকে চাপা দেয়। গত সোমবার এ দুর্ঘটনায় বরুণ চন্দ্রের সঙ্গে ঘটনাস্থলেই নিহত হন ভ্যানচালক আয়নাল প্যাদা। প্রতিদিন দেশের বিভিন্ন স্থানে সড়ক দুর্ঘটনার শিকার হয়ে ঝড়ছে প্রাণ। নিরাপদ সড়কের জন্য পাঁচ বছর আগে দেশ কাঁপানো আন্দোলন করেছিলেন শিক্ষার্থীরা। তখন সরকারের দিক থেকে সড়ক নিরাপদ করতে নানা আশ্বাস দেওয়া হয়েছিল। তবে বাস্তবতা এখন ভিন্ন। দেশের সড়ক-মহাসড়ক দিন দিন আরও প্রাণঘাতী হয়েছে। সরকারি হিসাবে গত বছর দেশে সড়ক দুর্ঘটনায় ৫ হাজারের বেশি মানুষের মৃত্যু হয়েছে।

গ্লোবাল হেলথ অ্যাডভোকেসি ইনকিউবেটরের (জিএইচএআই) ইন-কান্ট্রি কোঅর্ডিনেটর ড. শরিফুল আলম বলেন, রোডক্র্যাশ প্রতিরোধযোগ্য। তা বাস্তবায়ন করতে প্রয়োজন সেফ সিস্টেম এপ্রোচ। যার দর্শন হচ্ছে, সড়কে চলাচলকারী মানুষ ভুল করতেই পারে। কিন্তু সেখানে কাউকে দোষারোপ না করে প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করে ক্ষতি কমানোর ব্যবস্থা নিশ্চিত করা। এই পদ্ধতি বাস্তবায়নে কিছু রিস্ক ফ্যাক্টরকে বিবেচনায় নিতে হবে। যেমন : সড়কে গতিসীমা নিয়ন্ত্রণ করা; মোটরসাইকেল ব্যবহারকারী সবার হেলমেট ও নিরাপত্তা ব্যবস্থা গ্রহণ করা; গাড়ি ব্যবহারকারী সবার সিটবেল্ট ব্যবহার নিশ্চিত করা; শিশু সুরক্ষিত আসনের ব্যবস্থা রাখা এবং চালকের মদ্যপান ও নেশাজাতীয় দ্রব্য ব্যবহার না করা। এ ছাড়াও আরও কিছু বিষয় আছে যেগুলো রোডক্র্যাশ বৃদ্ধি করে। যেমন সড়কের দুর্বল অবকাঠামো, রোডক্র্যাশ পরবর্তী উদ্ধার প্রক্রিয়া না থাকা ও দ্রুততম সময়ে সুচিকিৎসার ব্যবস্থা না থাকা। এ রিস্ক ফ্যাক্টরগুলো বাস্তবায়ন করতে হলে প্রয়োজন একটি সড়ক নিরাপত্তা আইন। যা বাংলাদেশে নেই। এ কারণে রোডক্র্যাশ কমছে না। আইন না থাকলে আমরা সেফ সিস্টেম এপ্রোচ বাস্তবায়ন করতে পারব না। সড়ক পরিবহন খাতের নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষের (বিআরটিএ) তথ্য অনুযায়ী, গত মে মাসে সারা দেশে ৫১০টি সড়ক দুর্ঘটনায় ৪৫৭ জনের প্রাণহানি হয়েছে। আহত হয়েছেন ৫১০ জন। এপ্রিলে ৬৫৮ দুর্ঘটনায় মারা গেছেন ৬৩২ জন। মার্চে সড়কে ঝরেছে ৫৫০ জনের প্রাণ। গত বছর প্রতিদিন সড়কে প্রায় ১৪ জনের মৃত্যু হয়। তবে সড়কে মৃত্যুর সরকারি এই হিসাবের সঙ্গে বেসরকারি সংগঠনগুলোর তথ্যের পার্থক্য অনেক।

তাদের পরিসংখ্যান বলছে, সড়ক দুর্ঘটনায় বছরে অন্তত সাড়ে ৬ হাজার মানুষের মৃত্যু হয়। যদিও বিআরটিএ’র তথ্য বলছে, গত বছর দেশে সড়ক দুর্ঘটনা ঘটেছে ৫ হাজার ৪৯৫টি। এসব দুর্ঘটনায় মারা গেছেন ৫ হাজার ২৪ জন। আহত হয়েছেন ৭ হাজার ৪৯৫ জন। বিআরটিএ’র তথ্য অনুযায়ী, গত বছর ৭ হাজার ৮৩৭টি যানবাহন দুর্ঘটনার শিকার হয়েছে। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি দুর্ঘটনা ঘটেছে মোটরসাইকেলে, যা মোট দুর্ঘটনার ২২ দশমিক ২৯ শতাংশ। তারপর রয়েছে ট্রাক ও কাভার্ড ভ্যান ১৭ দশমিক ৭২ শতাংশ, বাস ও মিনিবাস ১৩ দশমিক ৮২ শতাংশ, অটোরিকশা ৬ দশমিক ৩৪ শতাংশ, ব্যাটারিচালিত রিকশা ৫ দশমিক ৩০ শতাংশ। অন্যান্য যানবাহন বাকি দুর্ঘটনার সঙ্গে সম্পৃক্ত।

সড়ক পরিবহন ও মহাসড়ক বিভাগের সচিব এ বি এম আমিন উল্লাহ নুরী বলেন, ‘সড়কে শৃঙ্খলা ফেরাতে আমরা নজর রাখছি। দেশের ৬৪ জেলাতে নিয়মিত ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনা করা হচ্ছে। সড়কে আইন মানতে মানুষের ভীষণ অনীহা। বারবার বলেও গতি নিয়ন্ত্রণে আনা যাচ্ছে না। তিনি আরও বলেন, ধীরগতির যানবাহন, থ্রি হুইলার, মোটরসাইকেল যে যেমন পারছে তার সর্বোচ্চ গতিতে মহাসড়কে চলাচল করছে। গতি কমলে জীবন বাঁচানো সম্ভব। মানুষকে সচেতন করাই আমাদের জন্য বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে।’ বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) অধ্যাপক ও পরিবহন বিশেষজ্ঞ সামছুল হক বলেন, ‘পরিবহনখাতে আইনের শাসন না থাকায় ব্যর্থ সিস্টেমে পরিণত হয়েছে। এখাতে আইন ভাঙার সংস্কৃতি গড়ে উঠেছে। সড়ক দুর্ঘটনা কমিয়ে বিশৃঙ্খলা ঠেকাতে নিবিড় মনিটরিং প্রয়োজন। কিন্তু দূরদর্শিতা, পেশাদারিত্বের অভাবে সড়কে মৃত্যুর মিছিল বাড়ছে।’ তিনি আরও বলেন, ‘আমাদের দেশে সবার মধ্যে একটা গা ছাড়া ভাব দেখা যায়। শিক্ষিত-অশিক্ষিত কেউই আইন মানতে আগ্রহী নয়। ফুটপাতে গাড়ি পার্কিং করায় বাধ্য হয়ে মানুষকে রাস্তায় নামতে হয়। পুলিশের সামনে দিয়ে রাস্তায় আনফিট লক্কড়-ঝক্কড় বাস চলছে, শিশুরা লেগুনা চালাচ্ছে। দূরদর্শী পেশাদারিত্বের অভাবে এখাতে বিশৃঙ্খলা প্রকট হয়ে উঠেছে।’

সর্বশেষ খবর