সোমবার, ১ জুলাই, ২০২৪ ০০:০০ টা

থেমে নেই জঙ্গি তৎপরতা

হোলি আর্টিজান হামলার আট বছর

সাখাওয়াত কাওসার

থেমে নেই জঙ্গি তৎপরতা

মাঠে সাংগঠনিক কার্যক্রম না চালালেও থেমে নেই নিষিদ্ধ ঘোষিত জঙ্গি সংগঠনগুলোর কার্যক্রম। বিভিন্ন নামে অনলাইনে সক্রিয় থেকে তারা গোপনে সদস্য সংগ্রহ করছে। সম্প্রতি ভারতে এবং বাংলাদেশের কক্সবাজারে ‘আস শাহাদাত’ নামে একটি জঙ্গি সংগঠনের পাঁচজনকে গ্রেফতারের পর বিষয়টি নিয়ে চিন্তায় ফেলেছে গোয়েন্দাদের। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, আইন প্রয়োগকারী সংস্থার কৌশলগুলোকে মাথায় রেখেই নিজেরা ভিন্ন কৌশলে কাজ করছে জঙ্গিরা। কারাগার থেকেও তারা সাংগঠনিক কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছে। নানা কৌশলে বার্তা পাঠাচ্ছে বাইরে থাকা তাদের সদস্যদের কাছে।

ঢাকা মহানগর পুলিশের কাউন্টার টেররিজম অ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম ইউনিটের (সিটিটিসি) প্রধান অতিরিক্ত কমিশনার মো. আসাদুজ্জামানের কাছে জঙ্গি তৎপরতা নিয়ে জানতে চাওয়া হয় গতকাল। তার বক্তব্য ছিল, ‘জঙ্গিদের সাংগঠনিক ভিত্তি একেবারেই দুর্বল হয়ে এসেছে। সাইবার দুনিয়াসহ সর্বত্রই তাদের ওপর মনিটরিং চলছে। কোনো ধরনের হামলা চালানোর মতো শক্তি নেই জঙ্গিদের।’

মানবাধিকার কর্মী ও হিউম্যান রাইটস সাপোর্ট সোসাইটি’র উপদেষ্টা নুর খান লিটন বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ‘হোলি আর্টিজান হামলার পর আমাদের আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কার্যক্রম প্রশংসার দাবিদার। তবে দেশে গণতান্ত্রিক আবহ, জবাবদিহিতা এবং স্বচ্ছতা নিশ্চিতের পরিবেশ সৃষ্টি করা সম্ভব না হলে যে কোনো সময় তা আবারও বিস্ফোরিত হওয়ার সম্ভাবনা থেকে যায়।’ এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘গ্রেফতারের পর জঙ্গিদের যেখানে রাখা হয় সেই কারাগারের লোকজনই তো এ বিষয়ে যথাযথ প্রশিক্ষিত নন। তাদের সমাজের মূল স্রোতের মধ্যে আনার তৎপরতা একেবারেই অনুপস্থিত। যেভাবে নজরদারি এবং ব্যবস্থাপনা করা দরকার সে ধরনের চিত্র দেখা যায় না আমাদের কারাগারগুলোতে। প্রায়ই শোনা যায়, কারাগারে থেকেও জঙ্গিরা সক্রিয়।’ জানা গেছে, গত ৩০ মে একটি গোপন খবরের ভিত্তিতে পুলিশের অ্যান্টি টেররিজম ইউনিট (এটিইউ)-এর একটি দল নরসিংদীর গাবতলীতে এক দুবাই প্রবাসীর বাড়িতে অভিযান চালায়। তবে সেখান থেকে কাউকে গ্রেফতার করতে না পারলেও কিছু সরঞ্জামাদি উদ্ধার করে। পরে এটিইউর পুলিশ সুপার (এসপি) ছানোয়ার হোসেন বলেন, ‘এখানে একটি শক্ত ঘাঁটি ছিল। তবে অভিযানের আগেই জঙ্গিরা সরে পড়ে। বেশ কিছু আলামত আমরা উদ্ধার করেছি।’ জানা গেছে, নব্য জেএমবির আমির মাহাদী হাসান জন তুরস্ক থেকে অনলাইনে সাংগঠনিক কর্মকান্ড চালাচ্ছেন। মাঝে তিনি তুরস্কে গ্রেফতার হয়েছেন খবর চাউর হলেও তা নিশ্চিত করতে পারেননি গোয়েন্দরা।

এদিকে, গত ২৭ জুন কক্সবাজার সদরের চৌফলদন্ডী থেকে নিষিদ্ধ জঙ্গি সংগঠন আনসার আল ইসলামের তিন সক্রিয় সদস্যকে গ্রেফতার করে র‌্যাব। এ সময় তাদের কাছ থেকে উদ্ধার করা হয় লিফলেট, পুস্তিকা, বিস্ফোরক তৈরির ম্যানুয়াল ও মোবাইল। গ্রেফতারকৃতরা হলেন- মোহাম্মদ জাকারিয়া মন্ডল, মোহাম্মদ নিয়ামত উল্লাহ ও মোহাম্মদ উজায়ের। জাকারিয়া মন্ডল ময়মনসিংহের ফুলবাড়িয়া ও নিয়ামত এবং উজায়ের চট্টগ্রামের পটিয়ার মাদরাসাছাত্র। র‌্যাব বলছে, এরা কক্সবাজারে অবস্থান করা সংগঠনের গুরুত্বপূর্ণ নেতার সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে এসেছিল। তবে কোন জঙ্গিদের মদতদাতা নেতা কক্সবাজারে অবস্থান করছে, তার পরিচয় জানায়নি র‌্যাব। জঙ্গি কর্মকান্ডের বিষয়ে র‌্যাবের আইন ও গণমাধ্যম শাখার পরিচালক কমান্ডার আরাফাত ইসলাম বলেন, ‘হোলি আর্টিজানের পৈশাচিক ঘটনার পর থেকে র‌্যাবসহ অন্যান্য সংস্থা অনেক কাজ করেছে। আমাদের সক্ষমতাও বেড়েছে। আমরা বহু জঙ্গিকে আইনের আওতায় এনেছি। এতটুকু বলতে পারি জঙ্গিদের একযোগে হামলা কিংবা নাশকতার ক্ষমতা নেই।’ তিনি আরও বলেন, ‘জঙ্গিরা এখন নানা নামে সংগঠিত হওয়ার চেষ্টা করছে। ছদ্মনাম দিয়ে কর্মী সংগ্রহ ও দাওয়াতি কার্যক্রমের চেষ্টা করছে। তবে আমাদের নজরদারির বাইরে তারা যেতে পারছে না। এরই মধ্যে আমরা আনসার আল ইসলামের কর্মীরা যে আস শাহাদাত নামের সংগঠন করেছিল তাদের অনেককে প্রথমে ঢাকা, নারায়ণগঞ্জ এবং সর্বশেষ গত তিন দিন আগে কক্সবাজার থেকে গ্রেফতার করতে সক্ষম হয়েছি।’ জানা গেছে, শীর্ষ জঙ্গি নেতা মাওলানা সালাউদ্দিন পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতে অবস্থান করছেন দীর্ঘদিন ধরে। সেখানে থেকেই তিনি বর্তমানে আস শাহাদাত নামের জঙ্গি সংগঠনের সমন্বয় করছেন। এ সংগঠনের সদস্য সংখ্যা আনুমানিক ৮৫-১০০ জন। এই গ্রুপটির উদ্ভাবক পার্শ্ববর্তী দেশের নাগরিক হাবিবুল্লাহ এবং কথিত আমির সালাউদ্দিন। এ ছাড়াও তারা বাংলাদেশকে এ সংগঠনের একটি শাখা বলে দাবি করে। এই গ্রুপটির বাংলাদেশের আঞ্চলিক শাখার দায়িত্বপ্রাপ্ত আমির ছিলেন র‌্যাব কর্তৃক পূর্বে গ্রেফতারকৃত ইসমাইল হোসেন।

সম্প্রতি ভারতে এবং বাংলাদেশে গ্রেফতার হওয়া আস শাহাদাতের সদস্যদের কাছ থেকে চাঞ্চল্যকর এমন তথ্য পেয়েছে গোয়েন্দারা। এর বাইরে মাওলানা আবদুল গফুর ভারতে বসে আনসার আল ইসলামের তৎপরতা চালাচ্ছেন দীর্ঘদিন ধরে। বিশ্বের বিভিন্ন দেশে অবস্থানরত সদস্যদের সঙ্গে তিনি নিয়মিত যোগাযোগ রাখছেন বলে তথ্য পেয়েছে গোয়েন্দারা। এর আগে গত বছর ১২ আগস্ট গোয়েন্দারা মৌলভীবাজারের কুলাউড়া উপজেলার পাহাড়ি এলাকার একটি বাড়িতে অভিযান চালিয়ে ‘ইমাম মাহমুদের কাফেলা’ নামে নতুন একটি জঙ্গি দলের অস্তিত পায়। তখন এ সংগংঠনের ৩৭ জনকে গ্রেফতার করেছিল পুলিশ। গ্রেফতারকৃতদের মধ্যে একজন চিকিৎসক, তার স্ত্রী এবং আরও নারী ও শিশু ছিল। ওই সময় দেশের বিভিন্ন অঞ্চল, বিশেষ করে যশোর, সিরাজগঞ্জ ও জামালপুর থেকে কিছু লোক নিখোঁজ হওয়ার ঘটনা তদন্ত করতে গিয়ে তারা এর সূত্র পায়। এরও আগে ২০২২ সালের ২৩ আগস্ট কুমিল্লা থেকে আট কলেজছাত্র নিখোঁজ হওয়ার ঘটনা তদন্ত করতে গিয়ে ‘জামা’আতুল আনসার ফিল হিন্দাল শারক্বীয়া’ নামে একটি জঙ্গি সংগঠনের খোঁজ পায় র‌্যাব। এই সংগঠনের সদস্যরা বান্দরবানের পাহাড়ে ‘কুকি-চিন ন্যাশনাল ফ্রন্ট’ নামে একটি বিচ্ছিন্নতাবাদী সংগঠনের সহায়তায় প্রশিক্ষণ নিচ্ছিল। পরে গত বছরের ১০ আগস্ট স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এ সংগঠনটিকে নিষিদ্ধ করে। নিরাপত্তা বিশ্লেষক মেজর জেনারেল (অব.) মোহাম্মাদ আলী শিকদার বলেন, জঙ্গিরা দুর্বল হয়ে পড়লেও তাদের মতাদর্শগত তৎপরতা থেমে নেই। এ কারণেই তারা নতুন নামে ও কৌশল পরিবর্তন করে সংগঠিত হওয়ার চেষ্টা করে। কিন্তু আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর জঙ্গিবিষয়ক সক্ষমতা বেড়ে যাওয়ায় শেষ পর্যন্ত তারা চিহ্নিত হয়ে যায়। দেড় বছরেও অধরা আদালত থেকে ছিনতাই হওয়া দুই জঙ্গি : দেড় বছরেও অধরা আদালত চত্বর থেকে ছিনতাই হওয়া দুই মৃত্যুদন্ডপ্রাপ্ত জঙ্গি। গত ২০২২ সালের ২০ নভেম্বর দিনে-দুপুরে আদালত প্রাঙ্গণ থেকে প্রকাশক দীপন হত্যা মামলায় মৃত্যুদন্ডপ্রাপ্ত মইনুল হাসান শামীম ও আবু সিদ্দিক সোহেলকে ঢাকার চিফ জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালত প্রাঙ্গণ থেকে ছিনিয়ে নেয় জঙ্গিরা। নিষিদ্ধ জঙ্গি সংগঠন আনসার আল ইসলামের সদস্য ছিলেন মৃত্যুদন্ডপ্রাপ্ত দুই জঙ্গি। এ ঘটনার পর রেড অ্যালার্ট জারি করে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। ঘটনার পর দেশের বিভিন্ন জায়গায় অভিযান চালালেও এখনো অধরা জঙ্গিরা। এর মধ্যে অন্তত ১৯ বার অভিযান চালালেও তাদের গ্রেফতার করতে পারেনি আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। যদিও তারা দাবি করে আসছেন, ছিনতাই হওয়া জঙ্গিরা দেশেই আছে। তাদের গ্রেফতারে অভিযানও অব্যাহত আছে।

সর্বশেষ খবর