মঙ্গলবার, ২ জুলাই, ২০২৪ ০০:০০ টা
বন্যা পাহাড়ধস বজ্রপাত

বিপদ তিন দুর্যোগে

আতঙ্ক দুর্ভোগে বিপুল মানুষ। বজ্রপাতে চারজন নিহত, সিলেট সুনামগঞ্জে আবার বাড়ছে পানি রাঙামাটি খাগড়াছড়িতে সড়ক যোগাযোগ ব্যাহত

প্রতিদিন ডেস্ক

বিপদ তিন দুর্যোগে

সুনামগঞ্জে বন্যার পানিতে তলিয়ে গেছে সড়ক -বাংলাদেশ প্রতিদিন

টানা ভারী বৃষ্টিপাতের কারণে পাহাড়ধসের খবর পাওয়া গেছে। যার পরিপ্রেক্ষিতে পাহাড়ি অঞ্চলে ধস আতঙ্কে নির্ঘুম রাত কাটছে স্থানীয় বাসিন্দাদের। সেই সঙ্গে পাহাড়ি ঢলে বন্ধ হয়ে গেছে রাঙামাটি ও খাগড়াছড়ির সড়ক যোগাযোগ। অপরদিকে, পাহাড়ি ঢলের কারণে সিলেটে তৃতীয় দফা বন্যা দেখা দিয়েছে। ভারী বৃষ্টিপাতের পাশাপাশি বজ্রপাত অব্যাহত রয়েছে। এর মধ্যে বজ্রপাতে চারজন নিহতের খবর পাওয়া গেছে। নিজস্ব প্রতিবেদক ও প্রতিনিধিদের পাঠানো তথ্য।

বান্দরবান : শনিবার রাত থেকে মাঝারি থেকে ভারী বৃষ্টিপাত হচ্ছে। এর ফলে নদনদীতে পানি বাড়ছে এবং বিভিন্ন স্থানে পাহাড়ধসের ঘটনা ঘটছে। এর মধ্যে গতকাল দুপুরে বান্দরবান-রুমা সড়কের দলিয়ানপাড়া এবং খুমীপাড়া পয়েন্টে পাহাড়ধসের কারণে বান্দরবান জেলা সদর ও রুমা উপজেলার মধ্যে সড়ক যোগাযোগ বন্ধ হয়েছে। রুমা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মোহাম্মদ আতিকুর রহমান জানান, সড়ক যোগাযোগ দ্রুত        চালুর লক্ষ্যে সেনাবাহিনী ও ফায়ার সার্ভিস কাজ শুরু করেছে। বান্দরবান আবহাওয়া অফিস সূত্র জানায়, সোমবার বিকাল ৩টা পর্যন্ত বান্দরবান জেলা সদরে ১০৮ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত হয়েছে। অন্যদিকে বাংলাদেশ পানি উন্নয়ন বোর্ড জানিয়েছে, পৌর শহর লামায় গতকাল দুপুর ১২টা পর্যন্ত গত ২৪ ঘণ্টায় বৃষ্টিপাতের পরিমাণ ছিল ১৬০ দশমিক ৩ মিলিমিটার। এতে বন্যা ও পাহাড়ধসের আশঙ্কা করা হচ্ছে। এদিকে উজানে ভারী বৃষ্টিপাতের কারণে সাঙ্গু ও মাতামুহুরী নদীর পানিপ্রবাহ বেড়েছে।

রাঙামাটি : অবিমার ঝড়বৃষ্টির সঙ্গে ধসছে পাহাড়ের মাটি। এই অবস্থায় পাহাড়ধসের আতঙ্কে নির্ঘুম রাত কাটছে পাহাড়বাসীর। বন্ধ হয়েছে রাঙামাটি ও খাগড়াছড়ি সড়ক যোগাযোগ। গতকাল সকাল ৬টার দিকে রাঙামাটি-চট্টগ্রাম মহাসড়ক, রাঙামাটি-কাপ্তাই আসামবস্তি সড়ক এবং রাঙামাটি-খাগড়াছড়ি সড়কের বিভিন্ন স্থানে পাহাড়ধস হয়েছে। এখনো পাহাড়বাসীর বাড়িঘর অক্ষত আছে। বড় কোনো ক্ষতি এড়াতে মাঠে নেমেছে প্রশাসনের বিশেষ নিরাপত্তা দল। রাঙামাটি আবহাওয়া অফিস জানায়, ২৪ ঘণ্টায় রাঙামাটিতে বৃষ্টিপাত রেকর্ড করা হয়েছে ৯৩.৭ মিলিমিটার। এ বৃষ্টি অব্যাহত থাকার সম্ভাবনা রয়েছে আরও চার থেকে পাঁচ দিন। রয়েছে ভারী বৃষ্টির আশঙ্কা। তাই স্থানীয়দের সতর্ক থাকতে বলা হয়েছে। রাঙামাটি জেলা প্রশাসক মো. মোশারফ হোসেন খান বলেন, রাতে ভারী বৃষ্টিপাত অব্যাহত থাকলে আশ্রয় কেন্দ্রে ঝুঁকিরতদের সরিয়ে আনা হবে। রাঙামাটির ২৬টি পয়েন্টে মাইকের মাধ্যমে স্থানীয়দের সতর্ক করা হচ্ছে। এ ছাড়া আমাদের উদ্ধারকর্মী, মেডিকেল টিমসহ নিরাপত্তাকর্মীরা প্রস্তুত রয়েছেন। পাশাপাশি মানুষের জনমালের নিরাপত্তা দিতে মাঠে নেমেছেন জনপ্রতিনিধিরাও।

সিলেট : ভারতের চেরাপুঞ্জিতে ভারী বৃষ্টিপাতের কারণে উত্তর সিলেটের চার উপজেলার নিম্নাঞ্চল বন্যার পানিতে ফের তলিয়ে গেছে। গতকাল সকাল থেকে হু হু করে বাড়ছে নদীর পানি। প্লাবিত হচ্ছে নিত্যনতুন এলাকা। আগামী কয়েকদিন ভারী বৃষ্টিপাতের আগাম বার্তা দিচ্ছে আবহাওয়া অফিস। আর পানি উন্নয়ন বোর্ডের কর্মকর্তারা বলছেন, ভারী বৃষ্টিপাত বন্ধ না হলে সিলেটে বন্যা পরিস্থিতির অবনতি হবে। তারা আশঙ্কা করছে তৃতীয় দফা বন্যার।

স্থানীয় সূত্র জানায়, সকাল থেকে উজান থেকে নেমে আসা পাহাড়ি ঢলে কানাইঘাটের সুরমা ও লোভা নদীর পানি দ্রুত গতিতে বাড়তে থাকে। কানাইঘাট উপজেলার ৯টি ইউনিয়ন ও পৌরসভার প্রত্যন্ত জনপদ ফের বন্যার পানিতে তলিয়ে গেছে। এ ছাড়া প্লাবিত হয়েছে গোয়াইনঘাট, কোম্পানীগঞ্জ ও জৈন্তাপুর উপজেলার নতুন নতুন এলাকা। ফলে তৃতীয় দফা ভোগান্তিতে পড়েছে মানুষ।

সুনামগঞ্জ : ভারী বৃষ্টিপাত আর পাহাড়ি ঢলে ক্রমেই বাড়ছে নদনদী এবং হাওড়ের পানি। এক সপ্তাহের ব্যবধানে আবারও বন্যার আশঙ্কা দেখা দিয়েছে তাহিরপুর, বিশ্বম্ভরপুর, সদর, দোয়ারাবাজার ও ছাতক সীমান্ত এলাকায়। ইতোমধ্যে ওইসব এলাকার নিম্নাঞ্চল প্লাবিত হয়েছে। এ ছাড়া জাদুকাটা, বৌলাই, চেলা, খাসিয়ামারাসহ অপরাপর নদীর পানি বাড়ছে। এদিকে, সুনামগঞ্জ-তাহিরপুর সড়কের আনোয়ারপুর, শক্তিয়ারখলা ও দুর্গাপুর এলাকা পানিতে তলিয়ে গেছে। জেলা সদরের সঙ্গে তাহিরপুর, মধ্যনগর ও ধর্মপাশা উপজেলার সড়ক যোগাযোগ বন্ধ হয়েছে। পাউবো আরও জানায়, গত ২৪ ঘণ্টায় মেঘালয়ের চেরাপুঞ্জিতে ৩১৩ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত রেকর্ড করা হয়েছে। এ ছাড়া সুনামগঞ্জে বৃষ্টিপাত হয়েছে ১৭০ মিলিমিটার

রংপুর : রংপুরের কাউনিয়া উপজেলায় তিস্তা নদীর পানি আবারও বিপৎসীমা অতিক্রম করেছে। গঙ্গাচড়ায় ও পীরগাছায় তিস্তার পানি বাড়ছে। উজানের ঢল আর টানা বৃষ্টির কারণে কয়দিন আগে তিস্তা নদীতে পানি বেড়ে বন্যা পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছিল। বর্তমানে কাউনিয়ার তিস্তা রেল সেতু পয়েন্টে বিপৎসীমার ৫ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে পানি প্রবাহিত হচ্ছে। ফলে কাউনিয়া ও গঙ্গাচড়ায় তিস্তাপাড়ের মানুষ ভাঙন আতঙ্কে দিন কাটাচ্ছেন।

গাইবান্ধা : ভারী বর্ষণ ও উজান থেকে নেমে আসা পাহাড়ি ঢলে আবারও গাইবান্ধার সবগুলো নদনদীর পানি বাড়তে শুরু করেছে। পানি বৃদ্ধির ফলে ইতোমধ্যে তিস্তার পানি বিপৎসীমার ৫ সেমি. ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। এতে নদীর তীরবর্তী নিম্নাঞ্চল প্লাবিত হচ্ছে। ফলে পানিবন্দি হয়ে পড়েছে হাজারও মানুষ। গত ২৪ ঘণ্টায় তিস্তার পানি (কাউনিয়া পয়েন্টে) বিপৎসীমার ৫ সেমি. ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। এ ছাড়া ব্রহ্মপুত্র নদের পানি (ফুলছড়ি পয়েন্টে) ৩৭ সেমি. বৃদ্ধি পেয়ে বিপৎসীমার ১০৮ সেমি, ঘাঘট নদীর পানি (নিউব্রিজ পয়েন্টে) ২৭ সেমি. বৃদ্ধি পেয়ে ১৬৯ সেমি. ও করতোয়া নদীর পানি (চকরহিমাপুর পয়েন্টে) ১ সেমি. বৃদ্ধি পেয়ে ৩৫৯ সেমি. নিচ দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। জেলায় বৃষ্টিপাত রেকর্ড করা হয়েছে ২৪ ঘণ্টায় ৬০ মিলিমিটার।

নদনদীগুলোর পানি বৃদ্ধির কারণে গাইবান্ধা সদর, সুন্দরগঞ্জ, ফুলছড়ি ও সাঘাটা উপজেলার নদীবেষ্টিত চরাঞ্চলে বেশ কিছু স্থান প্লাবিত হচ্ছে। সদরের কামারজানি, ঘাগোয়া, ফুলছড়ির ফজলুপুর, এরেন্ডাবাড়ি, সুন্দরগঞ্জের হরিপুর, কাপাসিয়া, তারাপুর এলাকায় পানি উঠতে শুরু করছে।

গাইবান্ধা পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী হাফিজুল হক বলেন, ভারী বর্ষণ ও উজানের ঢলে গাইবান্ধায় আবারও নদনদীর পানি বৃদ্ধি পেয়েছে। আগামীকাল পর্যন্ত পানি কিছুটা বাড়ার সম্ভাবনা রয়েছে।

লালমনিরহাট : ভারতে ভারী বর্ষণসহ উজান থেকে নেমে আসা ঢলে লালমনিরহাটের প্রধান নদনদীর পানি বৃদ্ধি অব্যাহত রয়েছে। এরই মধ্যে রেল সেতু পয়েন্টে তিস্তা নদীর পানি বিপৎসীমা অতিক্রম করছে। এ ছাড়া বেড়েই চলেছে জেলার অন্য নদনদীর পানি। এতে নদনদীর তীরবর্তী নিম্নাঞ্চল প্লাবিত হয়েছে। পাউবো জানিয়েছে, গতকাল দুপুর ১২টা থেকে তিস্তা নদীর রেল সেতু পয়েন্টে বিপৎসীমার ৭ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে পানি প্রবাহিত হচ্ছে। পানি বাড়ায় লালমনিরহাট জেলার পাটগ্রাম, হাতিবান্ধা, আদিতমারি ও সদর উপজেলার তিস্তা অববাহিকার নিম্নাঞ্চল, চর ও দ্বীপ চরের কিছু এলাকা প্লাবিত হয়েছে। তিস্তা নদীতে পানি বাড়া-কমায় ভাঙনের মুখে পড়েছে বিভিন্ন এলাকা। বেশকিছু চরাঞ্চলের বাড়িঘরের চারপাশে পানি প্রবেশ করার খবর পাওয়া গেছে। তলিয়ে গেছে গ্রামীণ সড়ক। ডুবে গেছে ওইসব এলাকার সবজি খেত।

সিরাজগঞ্জ : গত ২৪ ঘণ্টায় ভারী বর্ষণ ও উজান থেকে নেমে আসা পাহাড়ি ঢলে যমুনার পানি সিরাজগঞ্জ পয়েন্টে ১০ সেমি. বেড়েছে। পানি বাড়ায় যমুনার অরক্ষিত ও চরাঞ্চলে তীব্র ভাঙন শুরু হয়েছে। কোনোক্রমেই ভাঙন থামছে না। প্রতিদিন ভাঙনে বসতভিটা, মসজিদ, হাসপাতাল, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও ফসলি জমি বিলীন হচ্ছে। মানুষ নিঃস্ব হয়ে পড়ছে।

নেত্রকোনা : দুই দিন ধরে হুহু করে বাড়ছে জেলার পাহাড়ি সীমান্ত উপজেলার উব্দাখালী নদীর পানি। তবে সোমেশ্বরী, কংশসহ অন্যান্য নদীর পানি বিপৎসীমার নিচে রয়েছে বলে পানি উন্নয়ন বোর্ড। আবারও উজান থেকে নেমে আসা পাহাড়ি ঢলে বাড়ছে সব নদনদীর পানি। ফলে আবারও দেখা দিয়েছে নদী তীরবর্তী নিচু এলাকা প্লাবিত হওয়ার শঙ্কা।

নড়াইলে বজ্রপাতে নিহত ৩ : নড়াইল সদর উপজেলার কলোড়া ইউনিয়নের রামনগরচর গ্রামে বজ্রপাতে তিনজন নিহত হয়েছেন। তারা হলেন- সাতক্ষীরার পাটকেলঘাটা উপজেলার কাশিডাঙ্গা গ্রামের মিল্টন মণ্ডল (৪৫), একই গ্রামের নন্দ ঢালী (৫৫) এবং যশোরের মনিরামপুর উপজেলার নেহালপুর গ্রামের রতন মণ্ডল (৫৫)। এ সময় বজ্রপাতে পাটকেলঘাটা উপজেলার কাশিডাঙ্গা গ্রামের চিত্ত মণ্ডল (৩০) গুরুতর আহত হয়েছেন। তাকে নড়াইল সদর হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে। গতকাল ভোরে এ ঘটনা ঘটে। নিহত ও আহতরা মাঠেঘাটে শুকর চরাতেন। তারা রাতে মাঠের খোলা আকাশে তাঁবু টাঙিয়ে ঘুমিয়েছিলেন। নড়াইল সদর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মোহাম্মদ সাইফুল ইসলাম ঘটনার সত্যতা নিশ্চিত করেছেন।

পুলিশ ও প্রত্যক্ষদর্শী সূত্রে জানা গেছে, গত ২০-২৫ দিন আগে বাড়ি থেকে শুকর চরাতে বের হয়েছিলেন নিহত ও আহত ব্যক্তিরা। বিভিন্ন এলাকা ঘুরে তিন দিন আগে তারা নড়াইল সদর উপজেলার কলোড়া ইউনিয়নের রামনগরচর বিলে আসেন। সোমবার রাত ৩টার দিকে বৃষ্টির সময় বজ্রপাত হলে তাঁবুর নিচে থাকা চার ব্যক্তির মধ্যে মিল্টন, নন্দ ও রতন ঘটনাস্থলে মারা যান।

গাইবান্ধা : গাইবান্ধার ফুলছড়িতে হাঁস তাড়ানোর সময় বজ্রপাতে ফরহাদ হোসেন (১৮) নামের এক যুবকের মৃত্যু হয়েছে। ফরহাদ উপজেলার গজারিয়া ইউনিয়নের কাতলামারী এলাকার জিন্নাহ্ সর্দারের ছেলে। সে ফুলছড়ি কলেজ থেকে চলমান এইচএসসি পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করেছে। গতকাল সন্ধ্যায় গজারিয়া ইউনিয়নের কাতলামারী এলাকায় এ ঘটনা ঘটে।

স্বজনরা জানান, মাগরিবের আজানের পরপরই বাড়ির পাশের পুকুর থেকে হাঁস তাড়িয়ে বাড়িতে নিচ্ছিল ফরহাদ। এ সময় গুঁড়িগুঁড়ি বৃষ্টি হচ্ছিল। তখন বিকট শব্দে বজ্রপাত হলে আহত হয় ফরহাদ। পরে স্বজনরা তাকে উদ্ধার করে ফুলছড়ি উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে নিলে কর্তব্যরত চিকিৎসক তাকে মৃত ঘোষণা করেন।

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর