বুধবার, ৩ জুলাই, ২০২৪ ০০:০০ টা

মাফিয়াদের টাকা দিয়ে মিলছে না মুক্তি

লিবিয়া তিউনিসিয়া বন্দিশালায় কয়েক শ বাংলাদেশি, লিবিয়ায় অপহরণে বগুড়ায় দুজন গ্রেফতার

মাদারীপুর প্রতিনিধি ও নিজস্ব প্রতিবেদক, বগুড়া

মাদারীপুরের তরুণ যুবকদের মধ্যে অনেকেই স্বপ্ন ছোঁয়ার আশায় পাড়ি জমাচ্ছে ইউরোপের বিভিন্ন দেশে। তবে তাদের কারও কারও স্বপ্ন অধরাই থেকে যায়। ইউরোপ নেওয়ার প্রলোভন দেখিয়ে লিবিয়া ও তিউনিসিয়ার বিভিন্ন বন্দিশিবিরে আটক রেখে চালানো হয় নির্যাতন। এরপর আদায় করা হয় লাখ লাখ টাকা মুক্তিপণ। পণ দিয়েও মুক্তি মিলে না অনেকের।

এদিকে লিবিয়ায় দুই বাংলাদেশিকে অপহরণ করে মুক্তিপণ দাবির ঘটনায় অপহরণ চক্রের দুই সদস্যকে গ্রেফতার করেছে বগুড়া জেলা পুলিশ। গত সোমবার শহরের চেলোপাড়া এলাকা থেকে তাদের গ্রেফতার করা হয়। এ সময় তাদের কাছ থেকে মুক্তিপণের ১ লাখ টাকা উদ্ধার করা হয়।

জানা গেছে, মাদারীপুরের রাজৈর উপজেলার আমগ্রামের শুভ বাগচি (২২)। আট মাস আগে ভাগ্য বদলের আশায় পাড়ি জমিয়েছিলেন ইতালির উদ্দেশে। বর্তমানে পরিবারের সঙ্গে তার যোগাযোগ নেই। বেঁচে আছেন নাকি মারা গেছেন তাও জানে না পরিবারের লোকজন। একই গ্রামের রবিন মল্লিক পাঁচ মাস আগে ইতালি যাওয়ার জন্য বাড়ি ছাড়েন। কিন্তু তারও কোনো সন্ধান নেই। কালকিনি উপজেলার পূর্ব আলীপুর গ্রামের জুবায়ের হাওলাদারকে ইউরোপে নেওয়ার প্রলোভন দেখিয়ে আটকে রাখা হয়েছে তিউনিসিয়ায়। দফায় দফায় নির্যাতন করে আদায় করা হয় লাখ লাখ টাকা। শুধু শুভ, রবিন, জুবায়েরই নন। লিবিয়া ও তিউনিসিয়ার বিভিন্ন বন্দিশিবিরে আটক রয়েছেন কয়েকশ বাংলাদেশি। মাদারীপুরের পূর্ব আলীপুর গ্রামের জুবায়েরসহ বন্দিরা মুক্তির আকুতি জানিয়ে এ প্রতিবেদকের কাছে একটি ভিডিও পাঠিয়েছেন। সেই বন্দিরা নির্মম নির্যাতনের বর্ণনা দিয়েছেন। ভিডিও বার্তায় মো. ইয়াকুব নামে এক বন্দি জানান, তার বাড়ি কুড়িগ্রাম জেলায়। তাকে ১০ লাখ টাকায় ইতালি নেওয়ার প্রলোভন দেখানো হয়। প্রলোভনে পড়লে তাকে ভিজিট ভিসায় নাইজার হয়ে ইতালি নেওয়ার মৌখিক চুক্তি করে। প্রথমে দুবাই তারপর ইথিওপিয়া তারপর নাইজার নেয়। এ পর্যন্ত বিমানেই নেওয়া হয়। এরপর তিন দিন সড়ক পথে সেখান থেকে মরুভূমি পাড় হয়ে আলজেরিয়া নেয়। সেখানে আলজেরিয়ান পুলিশের হাতে ধরা পড়েন। এরপর এক মাস জেলখাটে ইয়াকুব। জেলের ভিতরেও অমানবিক নির্যাতের শিকার হন। জেল থেকে মুক্তি পেলে দালালচক্র আরও ৫ লাখ টাকা নেয়। এরপর জেল থেকে ছাড়া পাওয়ার পর তাদের তিউনিসিয়া নেওয়া হয়। এপর সেখানে বসেই তাদের টাকার জন্য চাপ প্রয়োগ করে আরও ৫ লাখ টাকা আদায় করা হয়। তালাবদ্ধ একটি ঘরে আটকে রাখা হয়। সেখানে ঠিকমতো খাবার দেওয়া হতো না। তাদের সঙ্গে ৩৪ জনের একটি দল ছিল বলে জানান ইয়াকুব। তিনি ভিডিও বার্তায় দাবি করেন, ভিজিট ভিসায় নেওয়ার কথা থাকলেও তিউনিসিয়া থেকে তাদের অবৈধভাবে সাগর পথে বোটে করে ইতালি নেওয়ার প্রস্তাব করে এবং আরও ৭ লাখ টাকা দাবি করেন। অবৈধ পথে যেতে এবং টাকা দিতে অস্বীকৃতি জানালে তাদের নির্মম নির্যাতন চালানো হয়। তাদের বিড়ির আগুন দিয়ে শরীরের বিভিন্ন স্থান ঝলসে দেয়। আঙুলের নখ টেলে তুলে ফেলে। আঙুলের মাথা কেটে ফেলা হয়। এ নির্যাতনের সঙ্গে জাহিদ, হোসেন, সাইফুল, মফিজ নামে বাংলাদেশি দালাল জড়িত। এদের মধ্যে মফিজের বাড়ি মাদারীপুর। মফিজই সবচেয়ে বেশি নির্যাতন করে বলেও জানান তিনি। ভিডিও বার্তায় নির্যাতনের শিকার মাদারীপুরের আলীপুরের বাসিন্দা জুবায়ের হাওলাদার বলেন, এই দেখেন আমারে বিড়ির আগুন দিয়ে পুড়ে ফেলেছে। এ সময় ভিডিওতে নির্যাতনের ক্ষত দেখানো হয়। তিনি সরকারের কাছে বন্দি থেকে মুক্তি পেতে আকুতি জানিয়েছেন। নির্যাতনের শিকার ইয়াকুব বলেন, আমার সর্বশেষ সম্বল ২ শতাংশ জমি ছিল। সেটা বিক্রি করে ওদের টাকা দিয়েছি। এখন আমার বউ বাচ্চা শ্বশুর বাড়িতে থাকে। দফায় দফায় নির্যাতন করে ১৭ লাখ টাকা হাতিয়ে নেয়। ভিডিও বার্তায় তিনি আরও বলেন দালাল জাহিদ, হোসেন, সাইফুল, মফিজ হুন্ডির মাধ্যমে টাকা আদায় করে। তাদের পক্ষ থেকে পরিবারের লোকজন টাকা গ্রহণ করে থাকে। খোঁজ নিয়ে জানা যায়, মাদারীপুর সদর উপজেলার পাঁচখোলা গ্রামের স্বপন কয়েক মাস আগে ভাগ্য ফেরাতে অবৈধ পথে ইতালি যাওয়ার উদ্দেশে বাড়ি ছাড়েন। লিবিয়া পৌঁছে ধরা পড়েন মাফিয়াদের হাতে। মুক্তিপণ হিসেবে মাফিয়ারা দাবি করেন ৩০ লাখ টাকা। স্বামীকে বাঁচাতে ভিটেমাটি বিক্রি করে দফায় দফায় ২০ লাখ টাকা তুলে দেন  দেলোয়ার সরদার নামে এক দালালের হাতে। তবে দেশে ফেরা এখনো অনিশ্চিত স্বপনের।

মাফিয়াদের হাতে জিম্মি শুভ বাগচীর মামা অপূর্ব বৈদ্য বলেন, ‘ধাপে ধাপে দালাল মমরাজ বেপারী ২২ লাখ টাকা নিয়েছে। জমিজিরাত বিক্রি করে টাকা দিয়েছি। এখন আর টাকা দেওয়ার উপায় নেই। আমার ভাগনে এক সপ্তাহ ধরে কেমন আছে, তাও জানি না।’ লিবিয়ায় বন্দি রবিনের মা বলেন, ‘ধামার ছেলেকে মাফিয়ারা জিম্মি করে রেখেছে। তারা বিভিন্ন কৌশলে লাখ লাখ টাকা নিয়েছে।

বিষয়টি নিয়ে মাদারীপুরের অতিরিক্তি পুলিশ সুপার কামরুল ইসলাম বলেন, ভুক্তভোগী পরিবারের পক্ষ থেকে লিখিত অভিযোগ পেলে তদন্তপূর্বক আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হবে। তাদের ফেরত আনার বিষয় সংশ্লিষ্ট দূতাবাসে পত্র প্রেরণ করা হবে।’ এদিকে লিবিয়ায় দুই বাংলাদেশিকে অপহরণ করে মুক্তিপণ দাবির ঘটনায় অপহরণ চক্রের দুই সদস্যকে গ্রেফতার করেছে বগুড়া জেলা পুলিশ। গ্রেফতারকৃতরা হলেন- বগুড়ার সোনাতলা উপজেলার শিহিরপুর গ্রামের আয়েন উদ্দিনের ছেলে মো. পান্নু মিয়া (৩৫) এবং একই উপজেলার নওদাবগা গ্রামের মৃত আবদুস সাত্তারের ছেলে মো. শিপলু সরকার (৪০)। গতকাল অতিরিক্ত পুলিশ সুপার স্নিগ্ধ আকতার জানান, মামলার পর দুজনকে গ্রেফতার করা হয়েছে। এ ছাড়া লিবিয়া প্রবাসী সাঈদ খন্দকারকে বাংলাদেশে ফেরত আনা হয়েছে এবং পাপ্পু খন্দকার অপহরণকারীদের কাছ থেকে নিরাপদ স্থানে রয়েছেন। তাকেও বাংলাদেশে আনা হবে। জানা যায়, বগুড়ার দুপচাঁচিয়া উপজেলার মো. পাপ্পু খন্দকার (২৭) ও মো. সাঈদ খন্দকার আপন দুই ভাই। চাকরি দেওয়ার নাম করে তাদের লিবিয়ায় নিয়ে আটকে রাখে একটি চক্র। পরে অপহৃতদের ভাইয়ের কাছে ১০ লাখ টাকা মুক্তিপণ দাবি করা হয়। ঘটনার পর গত ৮ জুন দুই প্রবাসীর ভাই রাব্বি খন্দকার বাদী হয়ে বগুড়ার দুপচাঁচিয়া থানায় মামলা করেন।

সর্বশেষ খবর