বুধবার, ৩ জুলাই, ২০২৪ ০০:০০ টা
সাবেক এমপির স্ত্রীর মৃত্যুরহস্য

পরকীয়া আড়াল করতে মাকে খুন

নিজস্ব প্রতিবেদক

নিজের অনৈতিক কর্মকান্ড আড়াল করতে নিজ মাকে খুন করেছিলেন প্রয়াত এমপি ও ঢাকা জেলা আওয়ামী লীগের সাবেক সভাপতি শামছুদ্দোহা খান মজলিসের মেয়ে। গলায় ছুরি দিয়ে পোঁচ দেওয়ার পরও মারা না যাওয়ায় সবশেষ ইলেকট্রিক শক দিয়ে সেলিমা খান মজলিসের মৃত্যু নিশ্চিত করা হয়। যদিও দীর্ঘদিন ধরেই তা চুরি-ডাকাতির মতো বিচ্ছিন্ন ঘটনায় আটকে ছিল। থানা পুলিশের পর পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ-সিআইডি চাঞ্চল্যকর এই ঘটনায় চূড়ান্ত প্রতিবেদনও দিয়ে দিয়েছিল। অবশেষে ১৩ বছর পর এ হত্যাকান্ডের রহস্যভেদ করল পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন (পিবিআই)। গ্রেফতারকৃত আসামিরা এরই মধ্যে আদালতে নিজের সম্পৃক্ততার বিষয়টি স্বীকারও করেছেন।

বহুল আলোচিত এই হত্যাকান্ড নিয়ে গতকাল আনুষ্ঠনিকভাবে গণমাধ্যম কর্মীদের সঙ্গে কথা বলেন পিবিআই প্রধান বনজ কুমার মজুমদার। তিনি বলেন, প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় থেকে মামলা পুনরুজ্জীবিত করতে নির্দেশনা আসার পর পিবিআই খুনের ঘটনার তদন্ত শুরু করে। তদন্তকালে ভুক্তভোগী সেলিমার বড় মেয়ে শামীমা খান মজলিশের পাশাপাশি অন্য দুই মেয়েকেও সন্দেহের তালিকায় রাখা হয়। খোঁজ করা হয়, ওই বাসায় কারা যাতায়াত করত। তখনই পিবিআই জানতে পারে, একজন ইলেকট্রিশিয়ান মাঝে মাঝে সামসুদ্দোহা খান মজলিশের বাসায় যাওয়া-আসা করতেন। কিন্তু বহুদিন ওই বাসায় তার যাতায়াত নেই। তার নাম সুবল। তিনি ৩০ বছর ধরে সাভার থানা এলাকায় ইলেকট্রিশিয়ান হিসেবে কাজ করছেন। তার বড় একটি মুদি দোকানও রয়েছে। সাবেক সংসদ সদস্য সামসুদ্দোহা খান মজলিশ ইলেকট্রিশিয়ান সুবল কুমার রায়কে ব্যক্তিগতভাবে পছন্দ করতেন। এ কারণে ১৯৯৮ সাল থেকে সুবল মাঝেমধ্যে ওই বাসায় যাতায়াত করতেন এবং বাসার ইলেকট্রিকের কাজ করে দিতেন।

তদন্তকালে জানা যায়, নিহতের রুমের ইলেকট্রনিক সুইচ বোর্ড ভাঙা এবং দুটি ইলেকট্রনিক তার বের করে রাখা। এরপর ইলেকট্রিশিয়ান সুবলকে সেখানে নিয়ে যাওয়া হয়। আদালতের সুবল কুমার রায়ের স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দির বরাত দিয়ে পিবিআই প্রধান বলেন, সেলিমা খান মজলিশের বড় মেয়ে তার স্বামীকে নিয়ে ওই বাসার নিচতলায় থাকতেন। সেখানেই নিয়মিত যাতায়াতের একপর্যায়ে শামীমার স্বামীর সঙ্গে বিভিন্ন ব্যবসায় জড়িয়ে পড়েন সুবল। ২০০১ সালে শামীমা ও সুবল পরকীয়া সম্পর্কে জড়ান। ২০০৫ সালে বিষয়টি জানাজানি হলে মারধর এবং অপমানের একপর্যায়ে সুবল ওই বাসা থেকে চলে যান। সুবলকে ওই বাসায় যেতে নিষেধ করা হয়। ২০০৮ সালে সুবল বিয়ে করেন। তবে ২০১১ সাল থেকে তিনি আবার সেই বাসায় যাতায়াত শুরু করেন।

যে কারণে মামলার পুনঃতদন্ত : সিআইডি প্রতিবেদন দাখিলের পর বাদীপক্ষ মামলাটি পিবিআইয়ের সহায়তায় পুনরুজ্জীবিত করার আবেদন করেও ব্যর্থ হয়। একপর্যায়ে বাদীপক্ষ বিষয়টি সরকারের ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের নজরে আনে। পরে পিবিআইয়ের পুলিশ পরিদর্শক মো. সালাহ উদ্দিন ‘মামলার গুরুত্বপূর্ণ তথ্য আছে’ মর্মে মামলাটি পুনরুজ্জীবিত করার আবেদন করেন। এরই ধারাবাহিকতায় আদালত মামলার পুনঃতদন্তের জন্য পিবিআইকে নির্দেশ দেন। পিবিআই ঢাকা জেলার পুলিশ সুপার কুদরত-ই-খুদা’র তত্ত্বাবধানে ২০২৪ সালের ১৬ ফেব্রুয়ারি থেকে মামলাটির তদন্ত শুরু করেন এসআই সালেহ ইমরান।

যেভাব হত্যাকান্ড : হত্যাকান্ডের দিন ভোরে ফজরের নামাজের সময় সেলিমা খান মজলিশ বাসার ছাদে গিয়েছিলেন। সেখান থেকে দেখতে পান সুবল চুপিচুপি তার বাড়ির দিকে আসছেন। তা দেখে চিৎকার করতে করতে নিচে নামছিলেন সেলিমা। তখন চিৎকার থামাতে সুবল ও শামীমা দ্রুত সিঁড়ি বেয়ে ওপরের দিকে যান। এরপরই শামীমা তার মাকে জাপটে ধরেন এবং হাতের কাছে থাকা ফল কাটার একটি চাকু দিয়ে মায়ের গলার দুই পাশে তিনটি পোচ দেন। কিন্তু শামীমা দেখেন তার মা মারা যাননি। তখন সুবল ইলেকট্রিক বোর্ড ভেঙে সেখান থেকে দুটি তার বের করে সেলিমার মাথায় শক দেন এবং তার মৃত্যু নিশ্চিত করার চেষ্টা করেন। তারা ভেবেছিলেন, সেলিমার মৃত্যু নিশ্চিত হয়েছে। কিন্তু তখনো তিনি জীবিত ছিলেন। পরে চিকিৎসাধীন অবস্থায় তিনি মারা যান। পিবিআই বলছে, এ বিষয়টি ময়নাতদন্ত প্রতিবেদনে উঠে আসেনি। মামলার এজাহার সূত্রে জানা যায়, ২০১১ সালের ১৪ জুন সকাল সাড়ে ৬টা থেকে সাড়ে ৭টার মধ্যে নিজ বাসার দ্বিতীয় তলায় গলায় এবং পেটের নিচের অংশে গুরুতর জখমপ্রাপ্ত হয়ে মুমূর্ষু অবস্থায় পড়ে ছিলেন সেলিমা খান মজলিশ। পরে পরিবারের লোকজন এবং প্রতিবেশীরা তাকে উদ্ধার করে সাভারের এনাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের আইসিইউতে ভর্তি করে। এরপর উন্নত চিকিৎসার জন্য তাকে নেওয়া হয় সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালে (সিএমএইচ)। চিকিৎসাধীন অবস্থায় চার দিন পর ১৮ জুন সেলিমা খান মারা যান। এ ঘটনায় ওই বছরের ১৫ জুন নিহতের ভাই মো. শাফিউর রহমান খান ওরফে শাফি বাদী হয়ে অজ্ঞাতনামা আসামিদের বিরুদ্ধে সাভার মডেল থানায় হত্যা মামলা দায়ের করেন। পরবর্তীকালে থানা পুলিশের আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে মামলাটির তদন্তভার অপরাধ তদন্ত বিভাগে (সিআইডি) হস্তান্তর করা হয়।

সিআইডির তদন্ত : ২০১১ সালের ২৪ জুন থেকে ২০১৫ সালের ১৮ অক্টোবর পর্যন্ত ৪ বছর ৩ মাস ২৪ দিন মামলাটি তদন্ত করেন সিআইডির তৎকালীন তদন্তকারী কর্মকর্তা সহকারী পুলিশ সুপার মো. আবু বকর সিদ্দিক। তদন্তকালে তিনি খুনের ঘটনায় জড়িত সন্দেহে মামলার আসামি হিসেবে মো. আবু সুফিয়ান ওরফে রানা নামের একজনকে গ্রেফতার করেন। এ ছাড়া আবুল কালাম আজাদ ও হরিপদ সরকার নামে আরও দুজনকে গ্রেফতার করা হয়। তবে তদন্ত শেষে ঘটনার দায় থেকে গ্রেফতার তিনজনের অব্যাহতি চেয়ে আদালতে চূড়ান্ত প্রতিবেদন দাখিল করে সিআইডি।

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর