বৃহস্পতিবার, ৪ জুলাই, ২০২৪ ০০:০০ টা

আতঙ্ক বাড়াচ্ছে মাতৃমৃত্যু

♦ চট্টগ্রামে ১১ ও ঝিনাইদহে ৯ প্রসূতির মৃত্যু ♦ রাজধানীসহ সারা দেশে আরও অসংখ্য ঘটনা ♦ হাসপাতালে অবহেলা-অব্যবস্থাপনার অভিযোগ

জয়শ্রী ভাদুড়ী

আতঙ্ক বাড়াচ্ছে মাতৃমৃত্যু

ডায়রিয়া নিয়ে রাজধানীর পল্লবীতে ইসলামী ব্যাংক হাসপাতাল অ্যান্ড কার্ডিয়াক সেন্টারে ভর্তি হয়েছিলেন ব্যাংক কর্মকর্তা নাদিয়া নূর (৩০)। চিকিৎসাধীন অবস্থায় চার দিন পরই মারা যান ১৬ সপ্তাহের এ অন্তঃসত্ত্বা রোগী। শুধু একটা ঘটনা নয়। ঢাকা, চট্টগ্রাম, ঝিনাইদহসহ সারা দেশে অন্তঃসত্ত্বা ও প্রসূতি মায়ের মৃত্যু নিয়ে আতঙ্ক বাড়ছে। মৃত্যুর কারণ খুঁজতে গিয়ে হৃদরোগ, রক্তক্ষরণ, অন্য জটিল রোগ কিংবা হাসপাতালে চিকিৎসায় অবহেলা-অব্যবস্থাপনার চিত্র উঠে এসেছে। এর ফলে সরকারের মাতৃমৃত্যু প্রতিরোধের লক্ষ্যপূরণে তৈরি হচ্ছে প্রতিবন্ধকতা। স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণমন্ত্রী ডা. সামন্ত লাল সেন বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ‘প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করে মাতৃমৃত্যু, শিশুমৃত্যু প্রতিরোধে আমরা কাজ করছি। সিলেট, কক্সবাজারসহ দেশের বিভিন্ন বিভাগ, জেলা ও উপজেলা পর্যায়ের হাসপাতাল পরিদর্শন করে সমস্যা চিহ্নিত করার চেষ্টা করছি। রাজধানীর বেসরকারি হাসপাতাল পরিদর্শন করে যেসব অসংগতি চোখে পড়েছে সেগুলো শুধরে নিতে আলটিমেটাম দিয়েছি। সুষ্ঠু ও মানসম্পন্ন সেবা নিশ্চিতে সারা দেশে অনুমোদনহীন, মানহীন ক্লিনিকের বিরুদ্ধে আমাদের অভিযান চলমান রয়েছে।’

ফেব্রুয়ারি-মে পর্যন্ত চট্টগ্রাম, ঝিনাইদহ, সিলেট ও কুমিল্লার কয়েকটি হাসপাতালে মাতৃমৃত্যুর ঘটনা ঘটেছে। এসব মৃত্যু হয়েছে অস্ত্রোপচারে শিশু জন্মের পর। ওজিএসবি, অ্যানেসথেসিওলজিস্ট এবং স্বাস্থ্য অধিদফতরের কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, অধিকাংশ মৃত্যুর ক্ষেত্রে অস্ত্রোপচারের কয়েক ঘণ্টা পর প্রসূতিদের প্রস্রাব কমে যেতে থাকে। একপর্যায়ে প্রস্রাব বন্ধ হয়ে যায়, রক্তচাপ কমতে থাকে, কিডনি অকেজো হয়ে পড়ে, শ্বাসকষ্ট দেখা দেয়, হার্ট ফেল করে। প্রাথমিক পর্যবেক্ষণে মোটামুটি এসব লক্ষণ ধরা পড়েছে।

জনস্বাস্থ্যবিদ ও মাতৃস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা বলেন, জটিলতার ঝুঁকি থাকে এমন সন্তান প্রসবের ক্ষেত্রে অস্ত্রোপচার প্রয়োজন হয়। সন্তান জন্মদানে অস্ত্রোপচার একটি জীবনদায়ী ব্যবস্থা। অস্ত্রোপচারের কিছু পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া থাকতে পারে। তবে অস্ত্রোপচারের পর মাতৃমৃত্যুর ঘটনা অস্বাভাবিক। চট্টগ্রাম থেকে রেজা মুজাম্মেল জানান, চট্টগ্রামে সিজার পরবর্তী ১১ প্রসূতি একক কারণে মৃত্যু হয়নি। চট্টগ্রামে সিজার পরবর্তী ১১ প্রসূতির মৃত্যুর ঘটনায় গঠিত ডেথ রিভিউ কমিটির তদন্ত প্রতিবেদনে এসব তথ্য উঠে আসে। ডেথ রিভিউ কমিটির সভাপতি ও চমেকের অধ্যক্ষ ডা. শাহেনা আক্তার বলেন, ‘প্রসব পরবর্তী ১১ মৃত্যুর বিষয়ে সরেজমিন পরিদর্শন, সংশ্লিষ্ট সবার সঙ্গে কথা বলা এবং ওষুধ প্রশাসনের সংগৃহীত স্যাম্পলের রিপোর্টের পরিপ্রেক্ষিতে কিছু কারণ নির্ধারণ করে একটি পর্যবেক্ষণ প্রতিবেদন প্রস্তুত করা হয়েছে। এ ব্যাপারে কিছু সুপারিশও করা হয়েছে। প্রতিবেদনে প্রসব পরবর্তী অতিরিক্ত রক্তক্ষরণ, ক্রনিক ডিজিজ ও হৃদরোগে আক্রান্ত হওয়ার বিষয়টি ওঠে আসে। অধিদফতর বিষয়গুলো নিয়ে মাঠ পর্যায়ের হাসপাতালে বাস্তবায়নে পরবর্তী করণীয় নির্ধারণ করবে।’

ডেথ রিভিউ প্রতিবেদনের সুপারিশের মধ্যে ছিল- ‘গর্ভকালীন স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করা, গর্ভাবস্থায় ও প্রসবকালীন সেবার তত্ত্বাবধান জোরদার করা, রুটিন পরীক্ষার সংখ্যা বৃদ্ধি করা, যেমন-হার্ট-কিডনি-লিভার ও রক্তের জমাট বাঁধাজনিত কোনো অসুবিধা আছে কি না, যা সাধারণ অপারেশনে করা হয়। অপারেশনের আগে-পরে অ্যানেসথেসিয়া সেবা নিশ্চিত করা, রোগীর ফলোআপ জোরদার করা, সরকারি-বেসরকারি সব হাসপাতালে জনবল বৃদ্ধি করা, পর্যাপ্ত সংখ্যক দক্ষ নার্স-মিডওয়াইফ থাকা, রোগীর তথ্য যথাযথ সংরক্ষণ করা ও রোগীর সামগ্রিক অবস্থার বিষয়ে স্বজনদের অবগত থাকা।’ গত ফেব্রুয়ারি ও মার্চ মাসে চট্টগ্রামের তিনটি হাসপাতালে অস্বাভাবিকভাবে ১১ জন প্রসূতির মৃত্যু হয়।

ঝিনাইদহ প্রতিনিধি শেখ রুহুল আমিন জানান, ঝিনাইদহে গত দুই মাসে ৯ প্রসূতির মৃত্যু হয়েছে। জানা গেছে, গত ২৬ মার্চ শৈলকুপা উপজেলার মির্জাপুর গ্রামের শারমিন বেগম শহরের আরাপপুর এলাকার রাবেয়া হাসপাতালে ভর্তি হন। সিজার পরবর্তী সময়ে রক্তক্ষরণ শুরু হয়। এক পর্যায়ে ওই হাসপাতাল  থেকে তাকে উন্নত চিকিৎসার জন্য যশোরে নিয়ে যেতে বলেন চিকিৎসক। তার স্বামী আল-আমিন জানান, তার স্ত্রীকে যশোরের একটি হাসপাতালে চার দিন আইসিইউতে রাখার পর মারা যান। হরিণাকুন্ডু উপজেলার পার্বতীপুর গ্রামের হালিমা খাতুনকে গত ৪ এপ্রিল শহরের প্রিন্স হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। সিজারের পর প্রচুর রক্তক্ষরণ শুরু হয়। এর কিছু সময় পর মারা যান হালিমা। গত ৩০ মার্চ হরিণাকুন্ডু উপজেলার তৈলটুপি গ্রামের এনামুল কবিরের স্ত্রী লাভলী বেগমকে কালীগঞ্জের দারুস-শেফা হাসপাতালে সিজার করা হয়। সিজারের পর মা ও শিশু সুস্থ ছিল। এরপর অতিরিক্ত রক্তক্ষরণে একইভাবে মারা যান লাভলী। গত ১২ এপ্রিল সদর উপজেলার ভবিতপুর গ্রামের রিনা খাতুন ও একই কারণে মারা যান। ১৬ এপ্রিল শামীমা ক্লিনিকে শৈলকুপা উপজেলার চাঁদপুর গ্রামের লিপি খাতুনের সিজারিয়ান করা হয়। সিজারের কয়েক ঘণ্টা পর কিডনি ও লিভার অচল হয়ে মারা যান লিপি। ২৫ এপ্রিল শহরের হাসানুজ্জামান ক্লিনিকে সিজারের পর আকলিমা খাতুন নামে এক প্রসূতির মৃত্যু হয়। এ ঘটনার পর হাসানুজ্জামান ক্লিনিকের সবাই গা-ঢাকা দেয়। গত ৭ মে শহরের তাছলিম ক্লিনিকে সিজারের পর নাসরিন খাতুন নামে এক প্রসূতির মৃত্যু হয়। শৈলকুপার মালিথিয়া গ্রামের কৃষক জাহিদুল ইসলামের স্ত্রী ফাতেমা খাতুনের প্রসব বেদনা শুরু হলে তাকে শহরের কবিরপুরে খন্দকার (প্রাইভেট) হাসপাতাল অ্যান্ড ডায়াগনস্টিক সেন্টারে ভর্তি করা হয়। সেখানে সিজারের পরপরই মারা যান প্রসূতি ফাতেমা খাতুন। তিনি এক কন্যা সন্তানের জন্ম দেন। তার মৃত্যুর পরও স্বজনদের ভুল বুঝিয়ে বেঁচে আছেন জানিয়ে দ্রুত একটি অ্যাম্বুলেন্সে কুষ্টিয়া মেডিকেলে পাঠিয়ে দেওয়া হয়। সেখান থেকে জানানো হয় আগেই প্রসূতির মৃত্যু ঘটে। বিষয়টি নিয়ে জেলা সচেতন নাগরিক সমাজের প্রতিনিধি বীর মুক্তিযোদ্ধা লিয়াকত হোসেন বলেন, ‘এভাবে মৃত্যু একেবারে কাম্য নয়। একজনের মৃত্যু মানে একটি পরিবার শেষ। ঘটনায় স্বাস্থ্য বিভাগের উদাসীনতা লক্ষ্য করা যাচ্ছে। নইলে অভিযুক্ত চিকিৎসক ও ক্লিনিক মালিকদের বিরুদ্ধে যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণ করে ওই সব ক্লিনিক বন্ধ করে দিত।’ এ বিষয়ে সিভিল সার্জন ডা. শুভ্রা রানী দেবনাথ বলেন, ‘ক্লিনিকগুলোতে মৃত্যুর ঘটনায় তদন্ত করেছি এবং এসব ক্লিনিকের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিচ্ছি। ইতোমধ্যে পোস্ট-অপারেটিভ কেয়ার ছাড়া অপারেশন করা যাবে না বলেও ক্লিনিক মালিকদের জানিয়ে দিয়েছি।’

সর্বশেষ খবর