বৃহস্পতিবার, ৪ জুলাই, ২০২৪ ০০:০০ টা

জেল সুপার-জেলার দ্বন্দ্বের সুযোগে চার আসামি পালায়

আবদুর রহমান টুলু, বগুড়া

বগুড়ার জেল সুপার ও জেলারের দ্বন্দ্বের সুযোগ নিয়ে কারাগারের ছাদ ফুটো করে পালিয়েছিলেন মৃত্যুদন্ডের সাজাপ্রাপ্ত ভয়ংকর চার কয়েদি। দুই কর্মকর্তার মধ্যে চেইন অব কমান্ড না থাকায় এ ঘটনা ঘটে। এ ছাড়া কারাগারের অবকাঠামো দুর্বল হওয়ায় নির্বিঘ্নে পালিয়েছিলেন তারা।

এদিকে গ্রেফতারের পর গতকাল চার কয়েদিকে আদালতে হাজির করে দুই দিনের রিমান্ডে নিয়েছে পুলিশ। তারা হলেন- কুড়িগ্রামের ভূরুঙ্গামারী উপজেলার দিয়াডাঙ্গা এলাকার নজরুল ইসলাম ওরফে মজনু, নরসিংদীর মাধবদী উপজেলার ফজরকান্দি এলাকার আমির হোসেন, বগুড়ার কাহালু পৌরসভার মেয়র ও বিএনপি নেতা আবদুল মান্নানের ছেলে মো. জাকারিয়া ও বগুড়ার কুটুরবাড়ি পশ্চিমপাড়া এলাকার ফরিদ শেখ। কারাভ্যন্তরের কয়েকটি সূত্র জানায়, বগুড়া কারাগারের দায়িত্বে থাকা জেলার মোহাম্মদ ফরিদুর রহমান জেল সুপার মো. আনোয়ার হোসেনের কোনো কমান্ড মানতেন না। জেল সুপারের পক্ষ থেকে কোনো নির্দেশনা দিলে সেটি সঠিকভাবে পালন করতেন না জেলার। কারাগারে দায়িত্বে থাকা কারারক্ষীসহ অন্য কর্মকর্তারাও একে অন্যের কমান্ড মানতেন না। দায়িত্বে অবহেলার অভিযোগও রয়েছে অনেকের বিরুদ্ধে। কারাগারে প্রতিদিন সকালে কারাবন্দিদের হাজিরা এবং কারারক্ষীদের কুচকাওয়াজের সময় যেসব নির্দেশনা জেল সুপার দিতেন সেগুলো পালন করতেন না জেলার ফরিদুর রহমান। জেল সুপার নিজেও তার গাফিলতির কথা স্বীকার করেছেন। এমন তথ্য বাংলাদেশ প্রতিদিনকে জানিয়েছেন বগুড়া কারাগারে কর্তব্যরত কয়েকজন কর্মকর্তা।

এদিকে ১৪১ বছরের পুরনো এই কারাগার নির্মাণে লোহার রড ব্যবহার করা হয়নি। ছাদ নির্মাণে চুন ও সুরকি ব্যবহার করা হয়েছে। বগুড়া কারাগারের চারটি কনডেম সেলের ছাদ চুন ও সুরকির তৈরি। এই কনডেম সেলগুলোর কার্যক্ষমতা কমে গেছে। যে কারণে সহজেই ছাদ ফুটো করে মৃত্যুদন্ডপ্রাপ্ত চার আসামি পালানোর সুযোগ পেয়েছেন। কয়েকবার কারাগারটি মূল শহর থেকে সরিয়ে অন্যত্র নেওয়ার দাবি তুললেও সেটি আর বাস্তবায়ন হয়নি। বগুড়া কারাগার সূত্রে জানা যায়, কারাগারের চারটি সেলের ছাদের একই অবস্থা। অন্য তিনটি সেলে ছিল ভয়ংকর জঙ্গিসহ ফাঁসির সাজাপ্রাপ্ত আরও কয়েদি। বগুড়া কারাগারের ধারণক্ষমতা ৭০০ জন। বর্তমানে বন্দি রয়েছেন ২ হাজার ২০০ জন। হাজতি ও কয়েদিদের গাদাগাদি করে থাকতে হচ্ছে। তাদের নিরাপত্তা নিয়ে শঙ্কা রয়েছে। এ কারণে মৃত্যুদন্ড ও যাবজ্জীবন সাজাপ্রাপ্ত কয়েদি, জঙ্গি মামলায় অভিযুক্ত জেএমবির আসামিদের অন্য কারাগারে সরিয়ে নেওয়া হয়। তবে কারাগার থেকে আর কোনো আসামি যাতে পালাতে না পারে সে জন্য নিরাপত্তা বাড়ানোসহ সার্বিক বিষয়কে গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। এখানে জনবল বাড়ানো হয়েছে ২৮ জন। সেই সঙ্গে কারাগারের দেয়ালের বাইরে ২৪ ঘণ্টা ১২ জন কারারক্ষী দায়িত্ব পালন করছেন।

কনডেম সেলের ছাদ ফুটো করে চার কয়েদি পালিয়ে যাওয়ার ঘটনায় আলোচনায় আসা বগুড়া জেলা কারাগারের নিরাপত্তাব্যবস্থা দুর্বলতার পাশাপাশি নানা অপরাধ ও অনিয়মের তথ্য পাওয়া গেছে। কারাগারের ভিতরে একটি চক্র মাদক সরবরাহ করছে বলে অভিযোগ রয়েছে। এই কারাগারের নিরাপত্তা নিয়ে বিভিন্ন সময় প্রশ্ন উঠলেও কার্যকর কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। শুধু তাই নয়, অনেক কারারক্ষী সরাসরি মাদক সরবরাহের সঙ্গে যুক্ত।

এদিকে বগুড়া জেলা কারাগারের জাফলং সেলের ২ নম্বর ওয়ার্ডের (কনডেম সেল) ছাদ ফুটো করে মৃত্যুদন্ডপ্রাপ্ত চার কয়েদি পালানোর ঘটনায় জেলার মোহাম্মদ ফরিদুর রহমানকে প্রত্যাহার করে রাজশাহী ডিআইজি প্রিজনের কার্যালয়ে সংযুক্ত করা হয়েছে।

বগুড়া কারাগারের জেল সুপার আনোয়ার হোসেন জানান, দায়িত্বে অবহেলার বিষয় উঠে আসায় বগুড়া কারাগারের ডেপুটি জেলার হোসেনুজ্জামান, প্রধান কারারক্ষী আবদুল মতিনসহ পাঁচজনকে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়। এ ছাড়া আরও তিনজনের বিরুদ্ধে বিভাগীয় মামলা হয়েছে। ঘটনা তদন্তে একটি কমিটি গঠন করেছে জেলা প্রশাসন। এর পাশাপাশি কারা কর্তৃপক্ষসহ মোট তিনটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়। কারা অধিদফতরের উপমহাপরিদর্শক (সদর দফতর) মনির আহমেদ বাংলাদেশ প্রতিদিনকে জানান, আমরা বগুড়া কারাগার থেকে চার কয়েদি পালানোর ঘটনার পর তদন্তে গিয়েছিলাম। এই মুহূর্তে আমাদের কাছে যেসব তথ্য আছে তা জানানো সম্ভব না। তবে জেল সুপার ও জেলারের মধ্যে চেইন অব কমান্ডের অভাব লক্ষ্য করা গেছে। খুব শিগগিরই আমরা তদন্তের প্রতিবেদনটি গণমাধ্যমকে জানাব। মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা পুলিশ পরিদর্শক মো. সুজন মিয়া জানান, চার কয়েদিকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য আদালতে সাত দিনের রিমান্ড আবেদন করা হয়। রিমান্ড আবেদনের শুনানি শেষে আদালত প্রত্যেকের দুই দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেন। উল্লেখ্য, ২৬ জুন রাতে বগুড়া কারাগারের জাফলং সেলে থাকা মৃত্যুদ প্রাপ্ত চার কয়েদি ছাদ ফুটো করে পালিয়ে যায়। পরে তাদের পুলিশ গ্রেফতার করে। এ ঘটনায় দায়েরকৃত মামলায় তাদের গতকাল আদালতে নেওয়া হয়।

সর্বশেষ খবর