শুক্রবার, ৫ জুলাই, ২০২৪ ০০:০০ টা

কোটিপতি ২২৭ উপজেলা চেয়ারম্যান

নিজস্ব প্রতিবেদক

কোটিপতি ২২৭ উপজেলা চেয়ারম্যান

সদ্যসমাপ্ত ষষ্ঠ উপজেলা পরিষদ নির্বাচনে বিজয়ী ৪৭০ জন চেয়ারম্যানের মধ্যে ২২৭ জনের রয়েছে কোটি টাকার বেশি সম্পদ। শতকরা হিসাবে যা ৪৮.৩০ শতাংশ। আরও ৭২ জন ৫০ লাখ থেকে ১ কোটি টাকার সম্পদের মালিক। এ ছাড়া বিজয়ী চেয়ারম্যানদের মধ্যে শীর্ষ ১০ সম্পদশালীর তালিকায় যারা রয়েছেন তাদের সম্পদের পরিমাণ ২৮ কোটি থেকে ১৮৬ কোটি টাকার মধ্যে। গতকাল সকালে জাতীয় প্রেস ক্লাবে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে এসব তথ্য জানায় সুজন-সুশাসনের জন্য নাগরিক। 

উপজেলা পরিষদ নির্বাচনে বিজয়ী প্রার্থীদের তথ্যের বিশ্লেষণ উপস্থাপন এবং নির্বাচন মূল্যায়ন শীর্ষক এ সংবাদ সম্মেলনে বক্তব্য দেন সুজন স¤পাদক ড. বদিউল আলম মজুমদার, সুজনের নির্বাহী সদস্য ও পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের নির্বাহী পরিচালক ড. আহসান এইচ মনসুর, সুজনের জাতীয় কমিটির সদস্য একরাম হোসেন। মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন সুজনের কেন্দ্রীয় সমন্বয়কারী দিলীপ কুমার সরকার।

সংবাদ সম্মেলনে ড. বদিউল আলম মজুমদার বলেন, উপজেলা পরিষদ নির্বাচন ছিল একতরফা নির্বাচন। ভোটের হারও ছিল কম। নির্বাচনে ভোটদানে অনীহা ও রাজনৈতিক                 দলগুলোর নির্বাচন বর্জন একই সূত্রে গাথা। নির্বাচনি ব্যবস্থা ও নির্বাচন কমিশনের প্রতি জনঅনাস্থাই এর কারণ। জনগণের মধ্যে এই ধারণা তৈরি হয়েছে, যাকেই ভোট দেওয়া হোক না কেন ক্ষমতাসীন দলের প্রার্থীরাই বিজয়ী হবেন। সরকার ধারণা করেছিল ভোটের হার বাড়লে নির্বাচন গ্রহণযোগ্যতা পাবে। কিন্তু ভোটের হার ছিল নিম্নমুখী। তিনি বলেন, উপজেলা নির্বাচনে বেশি সংখ্যায় ব্যবসায়ী নির্বাচিত হওয়া প্রমযণ করে যে, রাজনীতি ক্রমাগতভাবে ব্যবসায়ে পরিণত হয়ে গেছে। ফলে গণতন্ত্র হয়ে পড়েছে ‘বেস্ট ডেমোক্রেসি মানি ক্যান বাই’, অর্থাৎ টাকা দিয়ে কেনা উত্তম গণতন্ত্র। ড. বদিউল আলম মজুমদার বলেন, নিজ এলাকার উন্নয়নে এমপিদের জন্য ২৫ কোটি টাকা করে বরাদ্দ দেওয়া আমাদের সংবিধান ও ক্ষমতার পৃথকীকরণ নীতির সুস্পষ্ট লঙ্ঘন। উপজেলা পরিষদসহ বিভিন্ন স্থানীয় নির্বাচনে নারীর প্রতিনিধিত্ব বৃদ্ধির ঘুর্ণায়মান পদ্ধতি প্রবর্তন করা দরকার বলেও মন্তব্য করেন তিনি। ভোটার উপস্থিতির হার নিয়ে প্রশ্ন তুলে তিনি বলেন, ‘যা দেখানো হয়েছে তা নিয়ে সন্দেহ আছে, প্রশ্ন আছে, তাও সন্তোষজনক না। ৫০ শতাংশ পার হয়নি।

ড. আহসান এইচ মনসুর বলেন, গণতন্ত্র চর্চা না করলে এবং গণতন্ত্র প্রাতিষ্ঠানিক রূপ না পেলে আমরা সামনে এগোতে পারব না। যেভাবেই হোক উপজেলা নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছে। এখন সরকারের কাজ হবে এই পরিষদকে শক্তিশালী করা। তিনি বলেন, মন্ত্রণালয়ের আদেশে নয়, বরং কারও বিরুদ্ধে দুর্নীতি বা অন্য কোনো গুরুতর অভিযোগ থাকলে বিচারিক প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়েই জনপ্রতিনিধিদের বহিষ্কার করা উচিত।

মূল প্রবন্ধে দিলীপ কুমার সরকার বলেন, উপজেলা পরিষদ নির্বাচনে ১৮৮৯ জন প্রার্থী চেয়ারম্যান পদে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেন। চেয়ারম্যান পদে নারী প্রার্থীর সংখ্যা ছিল ৬২ জন; বিজয়ী হয়েছেন ১০ জন। তিনি বলেন, ৪৭০ জন বিজয়ী উপজেলা চেয়ারম্যানের মধ্যে ১০৩ জনের (২১.৯১%) শিক্ষাগত যোগ্যতা ¯œাতকোত্তর, ১৬৫ জনের (৩৫.১১%) ¯œাতক, ৮৩ জনের (১৭.৬৬%) এইচএসসি এবং ৫১ জনের (১০.৮৫%) এসএসসি। প্রার্থীদের মধ্যে এসএসসির নিচে রয়েছেন ৬৭ জন (১৪.২৫%)।

তিনি বলেন, বিজয়ী উপজেলা চেয়ারম্যানের মধ্যে ৩৬০ জন (৭৬.৬০%) ব্যবসায়ী, ৪৮ জন (১০.২১%) কৃষিজীবী, সাতজন (১.৪৯%) চাকরিজীবী এবং ১৯ জন (৪.০৪%) আইনজীবী। এ ছাড়া একজন (০.২১%) গৃহিণী এবং ২৮ জন (৫.৯৬%) অন্যান্য পেশার সঙ্গে জড়িত। সাতজন (১.৪৯%) পেশার ঘর পূরণ করেননি। অন্য পেশাজীবীদের মধ্যে ১৫ জন (৩.১৯%) রয়েছেন শিক্ষক। বিশ্লেষণে দেখা যায়, ব্যবসায়ীদের নির্বাচিত হওয়ার হার বেশি। ষষ্ঠ উপজেলা পরিষদ নির্বাচনে ৬৭.৬৬% ব্যবসায়ী প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেছিলেন। নির্বাচিতদের মধ্যে এই হার ৭৬.৬০%। এর অর্থ অন্যান্য পেশার তুলনায় ভোটাররা ব্যবসায়ীদের বেছে নিয়েছেন বেশি। বিজয়ী চেয়ারম্যান প্রার্থীদের বিরুদ্ধে মামলা সম্পর্কে তিনি বলেন, ৪৭০ জন বিজয়ী উপজেলা চেয়ারম্যানের মধ্যে ১১৪ জনের (২৪.২৬%) বিরুদ্ধে বর্তমানে ও ১৮২ জনের (৩৮.৭২%) বিরুদ্ধে অতীতে মামলা ছিল। ৭৫ জনের (১৫.৯৬%) অতীতে এবং বর্তমানেও আছে। ৩০২ ধারার মামলার ক্ষেত্রে ২৫ জনের (৫.৩২%) বিরুদ্ধে বর্তমানে, ৩৬ জনের (৭.৬৬%) বিরুদ্ধে অতীতে মামলা ছিল। চারজনের (০.৮৫%) অতীতে ছিল এবং বর্তমানেও মামলা আছে। বিশ্লেষণে দেখা যায়, প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থীর তুলনায় বিজয়ীদের মামলা সংশ্লিষ্টতার হার বেশি। বিজয়ী চেয়ারম্যান প্রার্থীদের বার্ষিক আয় সম্পর্কে তিনি বলেন, ৪৭০ জন প্রার্থীর মধ্যে আটজনের (১.৭০%) বার্ষিক আয় ২ লাখ টাকার কম, ১২৪ জনের (২৬.৩৮%) ২ লাখ ১ টাকা থেকে ৫ লাখ টাকা, ২০৪ জনের (৪৩.৪০%) ৫ লাখ ১ টাকা থেকে ২৫ লাখ টাকা, ৫১ জনের (১০.৮৫%) ২৫ লাখ ১ টাকা থেকে ৫০ লাখ টাকা, ৩৬ জনের (৭.৬৬%) ৫০ লাখ ১ টাকা থেকে ১ কোটি টাকা এবং ৪২ জনের (৮.৯৪%) ১ কোটি টাকার বেশি। পাঁচজন (১.০৬%) প্রার্থী আয়ের ঘর পূরণ করেননি। বিশ্লেষণে দেখা যায়, বছরে ৫ লাখ টাকার কম আয়কারী ৪৬.২৯% প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেছিলেন। নির্বাচিতদের মধ্যে এই হার ২৯.১৫%। অপরদিকে বছরে ৫০ লাখ টাকার বেশি আয়কারী ৮.৫৯% প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেছিলেন। নির্বাচিতদের মধ্যে এই হার ১৬.৬০%। কোটি টাকার বেশি আয়কারীদের মধ্যে এই হার যথাক্রমে ৪.০৬% ও ৮.৯৪%।

বিজয়ী চেয়ারম্যান প্রার্থীদের সম্পদ সম্পর্কে তিনি বলেন, ‘৪৭০ জন প্রার্থীর মধ্যে ১৫ জনের (৩.১৫%) স¤পদ ৫ লাখ টাকার কম, ৯৭ জনের (২০.৬৪%) ৫ লাখ ১ টাকা থেকে ২৫ লাখ টাকা, ৫৮ জনের (১২.৩৪%) ২৫ লাখ ১ টাকা থেকে ৫০ লাখ টাকা, ৭২ জনের (১৫.৩২%) ৫০ লাখ ১ টাকা থেকে ১ কোটি টাকা, ১৫৮ জনের (৩৩.৬২%) ১ কোটি ১ টাকা থেকে ৫ কোটি টাকা এবং ৬৯ জনের (১৪.৬৮%) ৫ কোটি টাকার বেশি। একজন (০.২১%) প্রার্থী স¤পদের ঘর পূরণ করেননি।

বিজয়ী চেয়ারম্যানদের মধ্যে শীর্ষ ১০ সম্পদশালীর নামও প্রকাশ করেছে সুজন। এই তালিকায় প্রথম স্থানে রয়েছেন নরসিংদীর শিবপুর উপজেলা চেয়ারম্যান ফেরদৌসী ইসলাম। তার সম্পদের পরিমাণ ১৮৬ কোটি ৭০ লাখ টাকার বেশি। এর পরে রয়েছেন যথাক্রমে পিরোজপুরের ভান্ডারিয়া উপজেলা চেয়ারম্যান মো. মিরাজুল ইসলাম (৮১ কোটি ৯৬ লাখ), কুমিল্লার হোমনা উপজেলার চেয়ারম্যান রেহানা বেগম (৭৩ কোটি ৩৩ লাখ), হবিগঞ্জের মাধবপুর উপজেলার চেয়ারম্যান এস এফ এ এম শাহজাহান (৪২ কোটি ৫৩ লাখ), চট্টগ্রামের বোয়ালখালী উপজেলা চেয়ারম্যান মো. জাহেদুল হক (৩৭ কোটি ৭০ লাখ), নোয়াখালীর সুবর্ণচর উপজেলা চেয়ারম্যান আতাহার ইসরাক শাবাব চৌধুরী (৩৫ কোটি ৯০ লাখ), ফেনীর ছাগলনাইয়া উপজেলা চেয়ারম্যান মো. মিজানুর রহমান মজুমদার (৩৪ কোটি ৮২ লাখ), শরীয়তপুরের জাজিরা উপজেলার চেয়ারম্যান মো. ইদ্রিস ফরাজী (৩৩ কোটি ১৬ লাখ), ঝালকাঠি সদর উপজেলার চেয়ারম্যান খান আরিফুর রহমান (২৮ কোটি ৪৪ লাখ), নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জ উপজেলা চেয়ারম্যান মো. হাবিবুর রহমান (২৮ কোটি ৮ লাখ)। তিনি বলেন, ৪৭০ জন প্রার্থীর মধ্যে আয়কর প্রদান করেন ৩৭৪ জন (৭৯.৫৭%)। ৮৩ জন (১৭.৬৬%) আয়কর প্রদানকারী ৫ হাজার টাকার নিচে কর প্রদান করে। ১ লাখ টাকার বেশি আয়কর প্রদান করেন ১৫৮ জন (৩৩.৬২%)। ৪৭০ জন প্রার্থীর মধ্যে ১৫৭ জন (৩৩.৪৪%) ঋণগ্রহীতা।  তিনি বলেন, ক্ষমতাসীন দলের প্রার্থীদের দ্বন্দ্বে নির্বাচনি সহিংসতায় প্রাণহানি ঘটেছে সাতজনের এবং আহত হয়েছে সহস্রাধিক। ৪৭০টি উপজেলার ফলাফলে দেখা যায়, ৪১৯টি বা ৮৯.১৫% উপজেলাতেই আওয়ামী লীগের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট চেয়ারম্যান প্রার্থীরা বিজয়ী হয়েছেন। এ ছাড়া ১৯টিতে বিএনপির বহিষ্কৃত স্বতন্ত্র প্রার্থী, সাতটিতে জাতীয় প্রার্থী (চারটি উপজেলায় দলীয় প্রতীকে এবং তিনটি উপজেলায় স্বতন্ত্র হিসেবে), চারটিতে জনসংহতি সমিতির প্রার্থী, তিনটিতে ইউপিডিএফ-এর প্রার্থী, একটিতে বাংলাদেশ জাসদের স্বতন্ত্র প্রার্থী, একটিতে কৃষক শ্রমিক জনতা লীগের স্বতন্ত্র প্রার্থী, একটিতে জাতীয় পার্টি-জেপির স্বতন্ত্র প্রার্থী, একটিতে ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের বহিষ্কৃত স্বতন্ত্র প্রার্থী, একটিতে আঞ্জুমানে আল ইসলাম এবং ১৩টিতে নির্দলীয় স্বতন্ত্র প্রার্থীরা বিজয়ী হয়েছেন।

সর্বশেষ খবর