সরকারের বিভিন্ন সংস্থা এমনকি এনবিআরের মতো জায়গায়ও ব্যাপক জনবল ঘাটতি রয়েছে। প্রয়োজনীয় অর্থ বরাদ্দ না পাওয়ায় নতুন করে প্রয়োজনীয় সংখ্যক লোক নিয়োগ দিতে পারছে না সরকারের বিভিন্ন সংস্থা। বেসরকারি খাতের ব্যাংকসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানেও একই পরিস্থিতি বিরাজ করছে। কোথাও কোথাও নতুন নিয়োগ না দিয়ে উল্টো ছাঁটাই করা হয়েছে করোনা মহামারির সময়ে। সেই খালি পদগুলোও এখনো শূন্য পড়ে রয়েছে অনেক প্রতিষ্ঠানে।
গত ২০২০-২১ অর্থবছরের বাজেটে পরিকল্পনা করা হয়েছিল তিন বছরের মধ্যে ১ কোটি মানুষের কর্মসংস্থান করা হবে। তার কতটা বাস্তবায়ন হয়েছে তার সুনির্দিষ্ট কোনো তথ্য পরবর্তীতে বাজেটগুলোতে প্রকাশ করা হয়নি। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর তথ্যমতে, করোনা মহামারির কারণে গত প্রায় তিন বছর কর্মসংস্থানের চাকা স্থবির ছিল। এরপর তা সচল হতে শুরু করলেও অভ্যন্তরীণ আর্থিক সংকট ও রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের প্রভাবে আবারও সেটা বাধাগ্রস্ত হয়। যা এখনো চলমান। এদিকে চলতি অর্থবছরের বাজেটে কর্মসংস্থান বৃদ্ধির সুনির্দিষ্ট কোনো পরিকল্পনার কথা বলেনি সরকার। অন্যদিকে দেশে দেশি ও বিদেশি উভয় ধরনের বিনিয়োগেও মন্দা পরিস্থিতি বিরাজ করছে। আবার সংকট মোকাবিলায় সরকারও ব্যয় সংকোচন নীতি অনুসরণ করছে গত কয়েক বছর ধরে। ডলার সংকট ও উচ্চ মূল্যস্ফীতির কারণে বেসরকারি খাতও একই পথেই হাঁটছে। ফলে চাকরির বাজারে ভাটা পড়েছে।
দেশের চলমান অর্থনৈতিক সংকট দীর্ঘায়িতই হচ্ছে। নতুন ২০২৪-২৫ অর্থবছরের জন্য সংকোচনমূলক বাজেট ঘোষণা করা হয়েছে। যার বাস্তবায়নও ইতোমধ্যে শুরু হয়েছে। চলতি মাসের মাঝামাঝিতে বর্তমান বছরের দ্বিতীয়ার্ধের জন্য মুদ্রানীতি ঘোষণা করতে যাচ্ছে বাংলাদেশ ব্যাংক। এবারের মুদ্রানীতি জাতীয় বাজেটকেই অনুসরণ করা হবে। যার ফলে সংকোচন ও সংযত মুদ্রানীতিই ঘোষণা করা হবে। মূল্যস্ফীতির চাপ কমিয়ে আনতেই এমন উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। যার ফলে সরকারি-বেসরকারি উভয় খাতেরই বিনিয়োগ ও কর্মসংস্থান কমবে। যদিও গত আড়াই মাসের ব্যবধানে ঈদুল ফিতর ও ঈদুল আজহা উদযাপিত হওয়ায় মে মাসে বেসরকারি খাতের ঋণ প্রবৃদ্ধি কিছুটা বেড়েছিল। ওই মাসে ঋণ প্রবৃদ্ধি হয়েছিল ১০ দশমিক ৩৫ শতাংশ। যা টার্গেটের চেয়ে দশমিক ৩৫ শতাংশ। তবে জুন থেকেই আবার তা কমতে শুরু করেছে বলে জানিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংকের একাধিক সূত্র। কেননা মূল্যস্ফীতির লাগাম টানতে ঋণের সুদ হার বাড়ানো হয়েছে। এতে ব্যবসা-বাণিজ্যের ব্যয় বৃদ্ধি পেয়েছে। যার ফলে বিনিয়োগ কমছে। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) সর্বশেষ শ্রমশক্তি জরিপে পাওয়া তথ্য অনুযায়ী গত ২০২২-২৩ বছরের শেষ তিন মাসের তুলনায় সদ্য বিদায়ী ২০২৩-২৪ অর্থবছরের প্রথম তিন মাসে বেকার বেড়েছিল প্রায় আড়াই লাখ। বিবিএসের তথ্যমতে, দেশে মোট বেকারের ১২ শতাংশই উচ্চশিক্ষিত। বিশ্লেষকরা মনে করছেন, বাস্তবে বেকারের সংখ্যা অনেক বেশি।অথচ যাদের কোনো আনুষ্ঠানিক শিক্ষা নেই, তাদের বেকারত্বের হার মাত্র ১.০৭ শতাংশ। মানসম্মত শিক্ষার অভাবেই দেশে বেকারত্ব, বিশেষ করে শিক্ষিত বেকারের সংখ্যা বেশি বাড়ছে। শ্রমশক্তি জরিপ প্রতিবেদন অনুযায়ী তিন মাসের ব্যবধানে শ্রমশক্তিতে যুক্ত হওয়া মানুষের সংখ্যা বেড়েছে ২ লাখ ৯০ হাজার। জনগোষ্ঠী বাড়লেও সেই তুলনায় দেশে কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি হয়নি।
বেসরকারি গবেষণা সংস্থা সাউফ এশিয়ার নেটওয়ার্ক অব ইকনোমিক মডেলিং-এর নির্বাহী পরিচালক ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক ড. সেলিম রায়হান বাজেট প্রতিক্রিয়ায় বলেছিলেন, এবারের বাজেট এবং মনিটারি পলিসির ভাষ্যমতে বাজেট হচ্ছে, সংকোচনমূলক বাজেট। এ রকম বাজেটে বিনিয়োগ কমই হয়। এ ছাড়া বিভিন্ন কারণে গত এক দশকে বেসরকারি খাতে বিনিয়োগ একটি স্থবির অবস্থার মধ্য দিয়েই যাচ্ছে। ব্যক্তি খাতে বিনিয়োগ না বাড়লে কর্মসংস্থানও বাড়বে না। এবারের বাজেট কর্মসংস্থান বাড়াবে বা বিনিয়োগ বাড়াবে- এমন কোনো পদক্ষেপ আমি দেখিনি। তাই এই বাজেটে বিনিয়োগ এবং কর্মসংস্থানের ব্যাপারে খুব একটা সুখবর নেই। বাজেটে যদিও একটি তুলনামূলক উজ্জ্বল সম্ভাবনার কথা বলা হচ্ছে কিন্তু আমি মনে করি, বাস্তবে এটা সম্ভব না। অর্থনীতিবিদেরা মনে করেন, দেশে প্রকৃত বেকারের সংখ্যা ১ কোটির বেশি। সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) নির্বাহী পরিচালক ফাহমিদা খাতুন বলেন, বেকারের সংখ্যা, বিনিয়োগসহ সরকারি যেসব পরিসংখ্যান রয়েছে, সেগুলোর বিশ্বাসযোগ্যতা নিয়ে সব সময় প্রশ্ন রয়েছে। তার মতে, ডলার-সংকট, ব্যবসা-বাণিজ্যে মন্দা ও নতুন বিনিয়োগ না হওয়াকে বেকারত্ব বাড়ার কারণ হিসেবে চিহ্নিত করেছেন। দুই বছর ধরে দেশ করোনা সংকটের মধ্যে ছিল। এরপর রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ অর্থনীতির ওপর বাড়তি চাপ সৃষ্টি করেছে। ফলে দেশে বেসরকারি বিনিয়োগও কমেছে। ডলার-সংকটের কারণে অর্থনীতির যে মূল চালিকাশক্তি গ্যাস-বিদ্যুৎ সরবরাহেও মারাত্মক ঘাটতি দেখা দিয়েছে। এ অবস্থায় বেকারত্ব বাড়ছে- এটাই স্বাভাবিক। আবার এই পরিস্থিতি থেকে উত্তরণের জন্য বাস্তবভিত্তিক কোনো পরিকল্পনাই সরকার নেয়নি বলে মনে করেন এই অর্থনীতিবিদ। বিবিএসের পরিসংখ্যান অনুযায়ী, বছরে কমপক্ষে ২০ লাখ মানুষ চাকরির বাজারে প্রবেশ করেন। তাদের ১৩-১৪ লাখের দেশের অভ্যন্তরে কর্মসংস্থান হয়। বাকিটা দেশের বাইরে প্রবাসে যান। তাই দুই দশক ধরে বেকারের সংখ্যা ২৪ থেকে ২৮ লাখের মধ্যে আছে। বিশ্লেষকরা বলছেন, দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে আওয়ামী লীগের নির্বাচনি ইশতেহারে কর্মসংস্থান বাড়ানোর কথা বলা হয়েছে। কিন্তু এ ক্ষেত্রে দৃশ্যমান কোনো কর্মপরিকল্পনা দেখা যায়নি। অতএব সরকার যদি বেকারত্ব কমাতে চায়, নতুন নতুন কর্মসংস্থান সৃষ্টি করতে চায়, তাহলে প্রথমে ব্যাংকিং খাত নিয়ে ভাবতে হবে। বিনিয়োগের পরিবেশ তৈরি করতে হবে। সে রকম কার্যকর কোনো পদক্ষেপ গত এক দশকে চোখে পড়েনি বলে মনে করেন সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা ড. হোসেন জিল্লুর রহমান। তিনি বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, কর্মসংস্থান বাড়ছে না। এটি খুব সহজেই বোঝা যায়। কারণ আপনি একটা সার্কুলার দিলেই দেখবেন সেখানে যদি তিনটা পদ থাকে তার বিপরীতে ৩০০-এর বেশি দরখাস্ত জমা পড়ে। আবার এসএসসি পাস পদের জন্য স্নাতক পাস এমনকি স্নাতকোত্তররাও দরখাস্ত করেন। এমন ঘটনা তো সরকারি-বেসরকারি উভয় খাতেই ঘটছে। ফলে কর্মসংস্থানের বাজারে তেমন কোনো সুখবর আমরা গত এক দশকে দেখতে পাইনি।