সোমবার, ৮ জুলাই, ২০২৪ ০০:০০ টা

সেক্স ট্রেডে কামিয়েছেন শত কোটি টাকা

চিকিৎসা বাদ দিয়ে সাইবার অপরাধে দুই ভাই

সাখাওয়াত কাওসার

মেডিকেলের পড়াশোনা বাদ দিয়ে সেক্স ট্রেডে মজেছিলেন দুই ভাই। তা বাস্তবে এবং ভার্চুয়াল দুই জগতেই। ‘সুখের ঠিকানা’ ও ‘জনস্বার্থে আমরা’ এর মতো অ্যাডাল্ট টেলিগ্রাম অ্যাকাউন্ট  তৈরি করে তাতে আপলোড করতেন নানা কনটেন্ট। এক সময় ভুক্তভোগীদেরও আলাদা অ্যাকাউন্ট তৈরি করে দিতেন তারা। তবে নিয়ন্ত্রণ রাখতেন নিজেদের হাতে। সেখান থেকেও হাতিয়েছেন আলাদা কমিশন। অপরাধের মাধ্যমে অর্জিত অর্থে দেশের বিভিন্ন এলাকায় গড়েছেন বিপুল পরিমাণ সম্পদ। তবে বেশিরভাগই বিদেশে পাচার করেছেন নানা কায়দায়। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, মেডিকেল শিক্ষার্থী মো. মেহেদী হাসান ও শেখ জাহিদ বিন সুজন সম্পর্কে খালাতো ভাই। তারা আইন প্রয়োগকারী সংস্থার সদস্যদের দীর্ঘদিন ধরে বোকা বানিয়ে রেখেছিলেন। তবে পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ সিআইডির হাতে  গ্রেফতারের পর তারা কিছু অপরাধের বিষয়ে স্বীকার করেছেন বলে পুলিশ জানিয়েছে। জানা গেছে, এ চক্রের প্রধান মেহেদী হাসান টঙ্গীর ইন্টারন্যাশনাল মেডিকেল কলেজের শিক্ষার্থী। তার খালাতো ভাই শেখ জাহিদ বিন সুজন রাজধানীর কল্যাণপুরে ইবনে সিনা মেডিকেল কলেজের শেষ বর্ষের ছাত্র। তবে এরই মধ্যে তারা তিনবার ফেল করেছেন। তারা দুজন আরও কিছু সহযোগী নিয়ে তরুণীদের ফাঁদে ফেলে সাইবার কনটেন্ট তৈরি করতেন। অভিযোগ পেয়ে সিআইডির সাইবার বিভাগের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার জুয়েল চাকমা চাঞ্চল্যকর এ বিষয়টি নিয়ে কাজ করছেন। এরই মধ্যে একাধিক কর্মকর্তার সঙ্গে এ প্রতিবেদকের কথা হয়। তারা বলছিলেন, মেহেদী এবং সুজন অত্যন্ত মেধাবী ছাত্র। তবে সেক্স ট্রেডে নেমে কালো টাকার স্বাদে নিজেদের হারিয়ে ফেলেছেন। যশোর সদর উপজেলার নরেন্দ্রপুর গ্রামে বাড়ি মেহেদীর। বাবা একজন স্কুলশিক্ষক। সুজনের গ্রামের বাড়ি সাতক্ষীরার তালা উপজেলায়। গত ২৬ জুন সিআইডির সাইবার শাখা চক্রের মূলহোতা মেডিকেল শিক্ষার্থী মো. মেহেদী হাসান ও তার প্রধান সহযোগী খালাতো ভাই শেখ জাহিদ বিন সুজন এবং তাদের সহযোগী জাহিদ হাসান কাঁকন, তানভীর আহমেদ ওরফে দীপ্ত, সৈয়দ হাসিবুর রহমান, শাদাত আল মুইজ, সুস্মিতা আক্তার ওরফে পপি এবং নায়না ইসলামকে গ্রেফতার করে ঢাকা, সাতক্ষীরা, চাঁদপুর ও যশোরের বিভিন্ন জায়গা থেকে। জানা গেছে, চার মাস আগে মেহেদী যশোরের নরেন্দ্রপুর এলাকায় পেট্রল পাম্পের পাশে ৩০ লাখ টাকার জমি কিনেছেন। সাতক্ষীরায় তারা দুজন মিলে বেনামে অনেক ঘেরে বিনিয়োগ করেছেন। মেহেদীর বাবার অ্যাকাউন্টেও বিপুল পরিমাণ অর্থ লেনদেনের প্রমাণ পেয়েছেন গোয়েন্দারা। তবে তারা তাদের অর্জিত অর্থের বড় অংশই দেশের বাইরে পাচার করেছেন। টেলিগ্রামের অ্যাকাউন্ট আসা অর্থগুলো বিদেশি ব্যাংকের অ্যাকাউন্ট পেপাল এ জমিয়ে পরবর্তীতে তা অন্যের অ্যাকাউন্টে ট্রান্সফার করে ফেলতেন। চক্রটির নিয়ন্ত্রণে থাকা ১০টি টেলিগ্রাম গ্রুপের সন্ধান পেয়েছেন তারা। এসব টেলিগ্রাম গ্রুপে দেশি-বিদেশি গ্রাহকের সংখ্যা ৩ লাখের বেশি। একটি নির্দিষ্ট পরিমাণ অর্থ দিয়ে গ্রাহকরা ওই গ্রুপগুলোতে যুক্ত থাকেন। অর্থ লেনদেনের জন্য চক্রটি ব্যবহার করত মোবাইল ফিন্যান্সিয়াল সার্ভিস। এ ছাড়া ক্রিপ্টোকারেন্সিতেও তাদের হাজার হাজার ডলার লেনদেনের তথ্য পাওয়া গেছে। চক্রটি তরুণীদের সঙ্গে ভিডিও কলের সবকিছু গোপনে ধারণ করে রাখত। এরপর তাদের বাধ্য করা হতো যৌন সম্পর্ক স্থাপনে। এভাবেই চক্রটির হাতে আধুনিক যৌনদাসীতে পরিণত হন শত শত তরুণী।

সূত্র বলছে, গ্রেফতার দুই ভাইয়ের কাছ থেকে ১২টি মোবাইল ফোন, ২০টি সিম কার্ড এবং একটি ল্যাপটপ উদ্ধার করে সিআইডি। সেগুলো ফরেনসিক করে কর্মকর্তারা জানতে পেরেছেন, বিদেশি একটি চক্রের সঙ্গে যোগাযোগ করে তারা নারী পাচারের পরিকল্পনাও করেছিলেন। অন্তত: সাড়ে সাত’শ তরুণী-নারীর সঙ্গে তাদের যোগাযোগের তথ্য পাওয়া গেছে। তবে সুখের ঠিকানা ও ‘জনস্বার্থে আমরা’ দুটি টেলিগ্রাম অ্যাকাউন্ট অ্যাডাল্ট কনটেন্ট, ভার্চুয়াল সেক্স এবং স্কট সার্ভিসের জন্য দেশি-বিদেশি গ্রাহক এই অ্যাকাউন্টে ক্লিক করে সেবা নিতেন। গোয়েন্দাদের ধারণা, অতিমাত্রায় মেধাবী এ দুই মেডিকেল ছাত্র ডার্ক ওয়েবেও নানা অপরাধের সঙ্গে যুক্ত। ইতোমধ্যে তারা কিছু গুরুত্বপূর্ণ তথ্য ও পেয়েছেন।

যেভাবে কাজ করত চক্রটি : শুরুতে ফেসবুক ও অন্যান্য সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে চাকরির বিজ্ঞাপন, কখনো মডেল তৈরি, কখনো বা ‘ট্যালেন্ট হান্ট’ শীর্ষক প্রতিযোগিতার প্রমো প্রচার করত। এতে যারা সাড়া দিতেন তাদের নিয়ে টেলিগ্রামে গ্রুপ খুলত। এরপর সুসম্পর্ক গড়ে তুলে বিদেশি বায়ারদের কাছে পাঠানোর কথা বলে মেয়েদের আপত্তিকর ছবি হাতিয়ে নিত চক্রটি। হাতিয়ে নেওয়া সেসব অর্ধনগ্ন ছবি ভাইরাল করে দেওয়ার ভয় দেখিয়ে নগ্ন হয়ে ভিডিও কল বা সরাসরি অসামাজিক কাজে বাধ্য করত।

চক্রটির টেলিগ্রাম গ্রুপে হাজার হাজার সাবস্ক্রাইবার রয়েছে। যারা একটি নির্দিষ্ট অর্থ দিয়ে ওই গ্রুপ গুলোতে যুক্ত থাকত। চক্রটি ভিডিও কলের সবকিছু গোপনে ধারণ করে রাখত। পরবর্তীতে ভুক্তভোগীদের যৌন সম্পর্ক স্থাপনে বাধ্য করতো। এভাবেই তাদের হাতে আধুনিক যৌনদাসীতে পরিণত হন শত শত তরুণী। এরা শত শত মোবাইল সিম ব্যবহার করলেও তাদের কোনোটিই প্রকৃত ন্যাশনাল আইডি দিয়ে নিবন্ধন করা নয়। এক্ষেত্রে তারা নিম্নআয়ের মানুষের অজ্ঞতার সুযোগ নিত। সামান্য অর্থ দিয়ে তোলা হতো সিম কার্ড।

কনটেন্ট আদান-প্রদান এবং সাবস্ক্রিপশনের জন্য ছিল টেলিগ্রাম প্রিমিয়াম অ্যাকাউন্ট এবং বিভিন্ন পেইড ক্লাউড সার্ভিস।

সর্বশেষ খবর