সোমবার, ৮ জুলাই, ২০২৪ ০০:০০ টা
ভাঙছে সড়ক বাড়ছে ক্ষয়ক্ষতি দুর্ভোগ

তলিয়ে যাচ্ছে নতুন নতুন এলাকা

প্রতিদিন ডেস্ক

তলিয়ে যাচ্ছে নতুন নতুন এলাকা

সিরাজগঞ্জে বন্যার পানি সামলে জীবনযাপন মানুষের -বাংলাদেশ প্রতিদিন

বন্যায় প্লাবিত হচ্ছে নতুন নতুন অঞ্চল। ভাঙছে কাঁচা-পাকা সড়ক। বাড়ছে ক্ষয়ক্ষতি ও মানুষের দুর্ভোগ। টাঙ্গাইলের ঝিনাই, ব্রহ্মপুত্র ও যমুনা নদীর পানি বিপৎসীমার ওপরে। সিরাজগঞ্জ হার্ড পয়েন্টে যমুনার পানি বিপৎসীমার ৬১ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। নদীভাঙনে নির্ঘুম রাত কাটছে তিস্তাপারের মানুষের। রংপুরে তিস্তার তীব্র স্রোতে গঙ্গাচড়ার মর্ণেয়া ইউনিয়ন লন্ডভন্ড হয়ে গেছে। দিনাজপুরে করতোয়া নদীর পানিও বিপৎসীমার ওপরে, তলিয়েছে নিম্নাঞ্চল। জামালপুরের মেলান্দহেও নতুন এলাকা প্লাবিত হয়েছে। গাইবান্ধা, কুড়িগ্রাম, জামালপুরের বন্যা পরিস্থিতি অপরিবর্তিত রয়েছে।

বন্যার সার্বিক পরিস্থিতি ও ক্ষয়ক্ষতি নিয়ে আমাদের প্রতিনিধিদের পাঠানো খবর-

আমাদের টাঙ্গাইল প্রতিনিধি জানান, অব্যাহত বৃষ্টিপাত ও উজান থেকে নেমে আসা ঢলের কারণে টাঙ্গাইল জেলার ওপর দিয়ে প্রবাহিত সবকটি নদীর পানি অস্বাভাবিক হারে বৃদ্ধি পাচ্ছে। গতকাল ঝিনাই নদীর পানি বিপৎসীমার ৯২ সেন্টিমিটার এবং ব্রহ্মপুত্র-যমুনা নদীর পানি বিপৎসীমার ২৮ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হয়েছে। বন্যার পানিতে তলিয়ে যাচ্ছে এসব উপজেলার নদী তীরবর্তী এলাকার বাড়িঘর ও ফসলি জমি। নদীর পানি দ্রুত বৃদ্ধি পাওয়ায় জেলার ভূঞাপুর, কালিহাতী ও সদর উপজেলার চরাঞ্চলের নিম্নাঞ্চল প্লাবিত হয়েছে। প্রবল স্রোতে ভূঞাপুরের ভালকুটিয়া কাঁচা সড়ক ভেঙে গেছে। এতে করে দুর্ভোগে পড়েছেন বন্যাপীড়িত এলাকার মানুষ। বন্যা মোকাবিলায় জেলা প্রশাসন ও উপজেলা প্রশাসন তৎপর রয়েছে।

সিরাজগঞ্জ প্রতিনিধি : যমুনা নদীর পানি সিরাজগঞ্জ হার্ড পয়েন্টে বিপৎসীমার ৬১ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। এতে জেলা সদর, কাজিপুর, চৌহালী, শাহজাদপুর ও বেলকুচি উপজেলার ৩৪টি ইউনিয়ন বন্যাকবলিত হয়ে পড়েছে। এসব অঞ্চলের লক্ষাধিক মানুষ পানিববন্দি রয়েছে। পানি বাড়ায় ৫টি উপজেলার যমুনার অরক্ষিত অঞ্চলে তীব্র ভাঙন শুরু হওয়ায় প্রতিদিন বসতভিটা ও ফসলি জমি বিলীন হয়ে যাচ্ছে। প্রতিদিন মানুষ ফসল ও বসতভিটা হারিয়ে নিঃস্ব হয়ে পড়েছে। বন্যায় সাড়ে ৬ হাজার হেক্টর ফসলি জমি তলিয়ে যাওয়ায় কৃষকরা চরম ক্ষতির মধ্যে পড়েছে। সহস্রাধিক তাঁত কারখানা তলিয়ে যাওয়ায় মালিক ও শ্রমিক বেকার হয়ে পড়েছেন। পানি বৃদ্ধিতে যমুনার অরক্ষিত অঞ্চলে তীব্র ভাঙন শুরু হয়েছে। বন্যার কারণে জেলায় প্রায় অর্ধশতাধিক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ রয়েছে। এতে ছাত্রছাত্রীদের পড়াশোনার ব্যাঘাত ঘটছে। পানিবন্দি মানুষের খাদ্যসংকট ও বিশুদ্ধ পানির সংকট দেখা দিয়েছে। শিশুদের শুকনো খাবারের সংকট দেখা দিয়েছে। বন্যাকবলিতদের মাঝে এখনো কোনো সহায়তা না পৌঁছায় তাদের মধ্যে তীব্র ক্ষোভ বিরাজ করছে। তবে জেলা ত্রাণ ও পুনর্বাসন কর্মকর্তা বলছেন, বন্যাকবলিত ৫টি উপজেলার মধ্যে কয়েকটি উপজেলায় বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে।

স্থানীয়দের অভিযোগ, ভাঙন রোধে পানি উন্নয়ন বোর্ড কোনো ব্যবস্থা গ্রহণ করছে না। কাওয়াকোলা ইউনিয়নের সাবেক চেয়ারম্যান শাহাদত হোসেন ঠান্ডু জানান, একদিকে বসতবাড়িতে পানি উঠেছে, অন্যদিকে নদীর তীর ভাঙছে। এতে কাওয়াকোলা ইউনিয়নের মানুষ দুর্বিষহ অবস্থার মধ্যে জীবনযাপন করছেন। ইতোমধ্যে ইউনিয়নের অর্ধেকাংশ জায়গাসহ ৩ থেকে ৪ শতাধিক বসতভিটা নদীগর্ভে বিলীন হয়েছে। ছোট ভাইয়ের বসতবাড়িও নদীগর্ভে বিলীন হয়েছে। চরাঞ্চল হওয়ায় পাউবো ভাঙনরোধে কোনো ব্যবস্থা গ্রহণ করছে না। কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের উপপরিচালক বাবলু কুমার সূত্রধর জানান, বন্যায় প্রায় সাড়ে ৬ হাজার হেক্টর জমির পাট, সবজি, আউশসহ কৃষকের নানা ধরনের ফসল তলিয়ে গেছে। জেলা ত্রাণ ও পুনর্বাসন কর্মকর্তা আখতারুজ্জামান জানান, বন্যার্তদের সহায়তার জন্য ৯৫ টন চাল ও ৫ লাখ টাকা বরাদ্দ পাওয়া গেছে। এর মধ্যে প্রায় ৪০ টন চাল বিতরণের জন্য উপজেলা পর্যায়ে দেওয়া হয়েছে।

মেলান্দহ (জামালপুর) প্রতিনিধি : জামালপুরের মেলান্দহে নতুন নতুন এলাকা প্লাবিত হচ্ছে। সাদিপাটি-পচাবহেলা এলাকায় নদীভাঙন শুরু হয়েছে। মেলান্দহ-মাহমুদপুর সড়ক যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছে। মেলান্দহ থেকে মাদারগঞ্জ-মহিষবাথান-নইলের ঘাট সড়কও তলিয়ে গেছে। পুকুরের মাছসহ ফসলাদির ক্ষতি হয়েছে। গো-খাদ্যের সংকট দেখা দিয়েছে। পিআইও আবদুর রাজ্জাক জানিয়েছেন, জেলা প্রশাসন থেকে ৩০০ বস্তার ফুড প্যাকেট বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে।

দিনাজপুর প্রতিনিধি : টানা বৃষ্টি ও উজান থেকে নেমে আসা ঢলে দিনাজপুরে করতোয়া নদীর পানি বিপৎসীমার ১৩৩ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। ফলে নদী তীরবর্তী নিম্নাঞ্চল খানসামার ভাবকী ইউপির চাকিনিয়া গ্রামের বগুড়াপাড়া প্লাবিত হয়েছে। গত শনিবারের চেয়ে ৪০ সেন্টিমিটার পানি বৃদ্ধি পেয়েছে। নিম্ন এলাকা পানিতে নিমজ্জিত হয়েছে। দিনাজপুর পানি উন্নয়ন বোর্ড জানিয়েছে, গতকাল বিকাল ৬টায় আত্রাই নদীর পানি বিপৎসীমার ১৭৩ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। নদীর এই অংশে বিপৎসীমা ৪৩ দশমিক ৭০ মিটারের বিপরীতে প্রবাহিত হচ্ছে ৪৫ দশমিক ৪৭ মিটারে। দিনাজপুরের ওপর দিয়ে প্রবাহিত অন্যান্য নদীর পানি বাড়ছে দ্রুত। দিনাজপুরে ৩৩ দশমিক ৯০ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত হয়েছে। গতকাল পানিবন্দি পরিবারের মাঝে নগদ অর্থ ও শুকনো খাবার বিতরণ করেন খানসামা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মো. তাজ উদ্দিন। এ সময় ইউপি চেয়ারম্যান রবিউল ইসলাম তুহিনসহ ইউপি সদস্যরা উপস্থিত ছিলেন।

জামালপুর প্রতিনিধি : টানা বর্ষণ আর উজান থেকে নেমে আসা পাহাড়ি ঢলে জামালপুরের যমুনা, ব্রহ্মপুত্রসহ অন্যান্য নদনদীর পানি নতুন করে না বাড়লেও সার্বিক বন্যা পরিস্থিতি এখনো অপরিবর্তিত রয়েছে। গতকাল বিকাল পর্যন্ত দেওয়ানগঞ্জের বাহাদুরাবাদঘাট পয়েন্টে যমুনা নদীর পানি ৭ সেন্টিমিটার কমে বিপৎসীমার ৮৩ সেন্টিমিটার এবং সরিষাবাড়ীর জগন্নাথগঞ্জঘাট পয়েন্টে ২ সেন্টিমিটার কমে বিপৎসীমার ১১৭ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। বিস্তীর্ণ এলাকায় পানি ছড়িয়ে পড়ায় নতুন নতুন এলাকা বন্যাপ্লাবিত হয়েছে। এতে করে বিস্তীর্ণ জনপদে বন্যার পানি ছড়িয়ে পড়ায় ইতোমধ্যে জেলার ইসলামপুর, দেওয়ানগঞ্জ, বকশীগঞ্জ, মাদারগঞ্জ, মেলান্দহ ও সরিষাবাড়ী উপজেলার ৩৪ ইউনিয়নের অন্তত ৭০টি গ্রামের দেড়  লক্ষাধিক মানুষ পানিবন্দি হয়ে পড়েছে। বিস্তীর্ণ এলাকায় প্রতিনিয়ত বন্যার পানি ছড়িয়ে পড়ায় তলিয়ে গেছে বসতভিটা, রাস্তাঘাট, হাট-বাজার, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানসহ জমি ও মাছের ঘের। এ ছাড়া বন্যার পানির কারণে জেলার ১৫১টি প্রাথমিক বিদ্যালয় এবং ৬৩টি মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের পাঠদান ক্রার্যক্রম বন্ধ রয়েছে। পানিবন্দি পরিবারগুলো গবাদিপশু নিয়ে আশ্রয় কেন্দ্র ছাড়াও উঁচু সড়ক, বাঁধ এবং স্টেশনের প্লাটফরমে আশ্রয় নিয়েছে।

নিজস্ব প্রতিবেদক, রংপুর জানান, ভারী বৃষ্টি ও উজানের পাহাড়ি ঢলে ভয়ংকররূপ ধারণ করেছে তিস্ত নদী। তীব্র স্রোতে ঘরবাড়ি, ফসলি জমি, রাস্তা, ব্রিজ-কালভার্ট ভেসে গেছে। মর্ণেয়া ইউনিয়নের শেখপাড়া-তালপট্টি সড়ক ও গঙ্গাচড়া-ভাঙ্গাগড়া সড়ক ভেঙে গেছে। শেখপাড়া ও ভাঙ্গাগড়ায় দেড় শতাধিক ঘরবাড়ি ভাঙনের শিকার হয়েছে। ভাঙ্গাগড়া গ্রামে প্রায় ৫০ মিটার পাকা রাস্তা পানির তোড়ে ভেসে গেছে। ফলে এই দুটি সড়কে যোগাযোগব্যবস্থা বন্ধ হয়ে গেছে। যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে অনেক স্থানে। ভাঙনে মর্ণেয়া ইউনিয়ন লন্ডভন্ড হয়ে গেছে। এলাকায় দেখা দিয়েছে বিশুদ্ধ পানির সংকট। বিপাকে পড়েছেন এইচএসসি পরীক্ষার্থীরা। রংপুর পানি উন্নয়ন বোর্ড সূত্রে জানা গেছে, গতকাল সন্ধ্যা ৬টায় কাউনিয়া পয়েন্টে তিস্তা নদীর পানি বিপৎসীমার ১৬ সেন্টিমিটার নিচ দিয়ে প্রবাহিত হয়েছে। এতে করে গঙ্গাচড়া উপজেলার নোহালী, আলমবিদিতর, কোলকোন্দ, লক্ষ্মীটারী, গজঘণ্টা ও মর্ণেয়া ইউনিয়নের সাড়ে ৩ হাজার মানুষ পানিবন্দি হয়ে পড়েছে। অপরদিকে কাউনিয়া উপজেলার বালাপাড়া, টেপামধুপুর ইউনিয়ন এবং পীরগাছা উপজেলার তাম্বুলপুর ইউনিয়নের তিস্তা তীরবর্তী নিম্নাঞ্চল, চর ও দ্বীপচরের কিছু পরিবার পানিবন্দি হয়ে পড়েছে।

কুড়িগ্রাম প্রতিনিধি :  কুড়িগ্রামে ব্রহ্মপুত্র নদের তিনটি পয়েন্টে পানি কমলেও বিপৎসীমার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছিল। গতকাল সকালে নাগেশ্বরীতে দুধকুমার নদীর বেড়িবাঁধ ভেঙে লোকালয়ে পানি প্রবেশ করে। এতে নতুন করে আরও অন্তত ১৫টি গ্রাম প্লাবিত হয়ে পড়ে। উপজেলার বামনডাঙ্গা ইউনিয়নের মিয়াপাড়া এলাকার পুরাতন বেড়িবাঁধটির দুটি স্থানে প্রায় ১০০ মিটার এলাকা ভেঙে যায়। ফলে ভাঙা অংশ দিয়ে প্রবল স্রোতে পানি প্রবেশ করে একের পর এক গ্রাম প্লাবিত হতে থাকে। পানি আরও বৃদ্ধি পেলে নাগেশ্বরী পৌর শহর পানিতে নিমজ্জিত হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। ওই বাঁধটি ভেঙে যাওয়ায় বামনডাঙ্গা ইউনিয়নের মিয়াপাড়া, মালিয়ানি, সেনপাড়া, তেলিয়ানী, পাটেশ্বরী, বোয়ালের ডারা, অন্তাইপাড়, ধনিটারী, বিধবাটারী, বড়মানী, বামনডাঙ্গা, নাগেশ্বরী পৌরসভার ৩ নম্বর ওয়ার্ডের সাঞ্জুয়ার ভিটা, ভুষিটারী, ফকিরটারী গ্রাম প্লাবিত হয়ে পড়ে। বামনডাঙ্গা ইউপি চেয়ারম্যান আসাদুজ্জামান রনি জানান, শুক্রবার রাত থেকে তার ইউনিয়নের ৭ নম্বর ওয়ার্ড বন্যাকবলিত হয়।

রবিবার সন্ধ্যা ৬টায় স্থানীয় পানি উন্নয়ন বোর্ড জানায়, গত ২৪ ঘণ্টায় ব্রহ্মপুত্র নদের হাতিয়া পয়েন্টে পানি অপরিবতির্ত থেকে বিপৎসীমার ৫৩ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে ব্রহ্মপুত্র নদের নুনখাওয়া পয়েন্টে বিপৎসীমার ৪৯ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে এবং চিলমারী পয়েন্টে বিপৎসীমার ৬৩ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছিল। ধরলা নদীর সেতু পয়েন্টে পানি অপরিবর্তিত থেকে বিপৎসীমার ৩২ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে এবং ধরলার শিমুলবাড়ি পয়েন্টে বিপৎসীমার ৩৮ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে এবং দুধকুমার নদের পাটেশ্বরী পয়েন্টে  বিপৎসীমার ৫০ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে সন্ধ্যা ৬টায়ও প্রবাহিত হচ্ছিল। ফলে জেলার বন্যার সার্বিক পরিস্থিতির কোনো উন্নতি হয়নি। বানভাসি প্রায় দেড় লক্ষাধিক মানুষের কষ্ট ও দুর্ভোগ চরমে পৌঁছেছে। সরকারিভাবে ত্রাণ সহায়তা প্রদান করা হলেও দুর্গম চরের বাসিন্দাদের ভাগ্যে তা জোটেনি বলে বানভাসিদের অভিযোগ। এ ছাড়াও বন্যাদুর্গত এলাকায় দেখা দিয়েছে চরম খাদ্য ও গোখাদ্য সংকট। সেই সঙ্গে বিশুদ্ধ পানি সংকট প্রকট আকার ধারণ করায় ডায়রিয়া ও পানিবাহিত রোগের সৃষ্টি হয়েছে।

লালমনিরহাট প্রতিনিধি : টানা বৃষ্টি ও উজান থেকে নেমে আসা ঢলে তিস্তা ও ধরলার পানি বৃদ্ধি পেয়ে নদীতীরবর্তী নিম্নাঞ্চলে প্রবেশ করেছে। পানিবন্দি হয়ে পড়েছে জেলার পাঁচ উপজেলার অন্তত ১০ হাজার পরিবার। এসব এলাকায় তলিয়ে গেছে ফসলের ক্ষেত, রাস্তাঘাট। বিদ্যালয়গুলোতে পানি থাকায় বন্ধ রয়েছে শিক্ষা কার্যক্রমও। এ ছাড়া বাড়িঘরে পানি থাকায় চরম দুর্ভোগে রয়েছেন পানিবন্দি মানুষজন। দফায় দফায় তিস্তার পানি হ্রাস-বৃদ্ধি অব্যাহত থাকায় আতংকে নির্ঘুম রাত কাটছে নদী তীরবর্তী বাসিন্দাদের। এ নিয়ে এ বছর দুবার স্বল্প মেয়াদি বন্যার ভোগান্তিতে পড়ল তিস্তাপাড়ের বাসিন্দারা।

গতকাল দুপুর ১২টায় তিস্তার ডালিয়া ব্যারাজ পয়েন্টে পানি রেকর্ড করা হয় ৫১.৯১ মিটার। যা বিপৎসীমা মাত্র ২৪ সেন্টিমিটার নিচ দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে।

মৌলভীবাজার প্রতিনিধি : মৌলভীবাজারের কুলাউড়ায় চলমান বন্যা পরিস্থিতি নিয়ে গতকাল দুপুরে সংবাদ সম্মেলন করেছেন পৌরসভার মেয়র অধ্যক্ষ সিপার উদ্দিন আহমদ। এতে মেয়র বলেন, গত ১৭ জুন থেকে উপজেলার অধিকাংশসহ পৌরসভার বড় একটি অংশ বন্যায় প্লাবিত হয়ে এখন পর্যন্ত একই অবস্থায় রয়েছে। তাৎক্ষণিকভাবে রাবেয়া আদর্শ সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় ও ইয়াকুব-তাজুল মহিলা ডিগ্রি কলেজে দুটি এবং পরবর্তীতে সি-বার্ড কেজি স্কুল ও বিএইচ সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে আরও দুটি আশ্রয় কেন্দ্র খোলা হয়েছে। এতে ১১৯টি পরিবারের ৪০০ জন মানুষ আশ্রয় নিয়েছেন। এ ছাড়াও পৌর এলাকার আরও ১০ হাজার মানুষ পানিবন্দি হয়ে পড়েন। একটানা ২১ দিন থেকে মানুষ মানবেতর জীবনযাপন করছে। তিনি জানান, বন্যায় পৌরসভার ৯টি ওয়ার্ডের অসংখ্য ঘরবাড়ি, রাস্তাঘাট, ড্রেন, কালভার্ট, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, মসজিদ, মাদরাসা ও গবাদি পশুর খামার ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এই ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ প্রায় ৫০ কোটি টাকা। একটানা দীর্ঘদিন পানিবন্দি মানুষকে খাদ্যসহায়তা প্রদান

গাইবান্ধা প্রতিনিধি : গাইবান্ধা সদর, সুন্দরগঞ্জ, ফুলছড়ি ও সাঘাটাসহ চার উপজেলার সার্বিক বন্যা পরিস্থিতি অপরিবর্তিত রয়েছে। ব্রহ্মপুত্র ও ঘাঘট নদীর পানি কিছুটা কমলেও এখনো রয়েছে বিপৎসীমার ওপরে। অন্যদিকে তিস্তার পানি বাড়লেও তা বিপৎসীমার নিচে রয়েছে। জেলায় বন্যার পানিতে তলিয়ে গেছে বীজতলাসহ ২ হাজার ৫০০ হেক্টরের অধিক জমির ফসল। ভেসে গেছে পুকুর ও মাছের ঘের। পানি ওঠায় বন্ধ ঘোষণা করা হয়েছে ৮০টি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। এসব এলাকায় বাড়িঘর তলিয়ে যাওয়ায় অনেকেই আশ্রয় নিয়েছেন উঁচু জায়গা ও বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধসহ আশ্রয় কেন্দ্রে।

গতকাল বিকাল ৩টায় গাইবান্ধার পানি উন্নয়ন বোর্ড (পাউবো) জানায়, ব্রহ্মপুত্র নদের পানি ১৩ সেমি হ্রাসের পরও বিপৎসীমার ৭১ সেমি ও ঘাঘট নদীর পানি ১১ সেমি হ্রাস পেয়ে বিপৎসীমার ২৩ সেমি ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। এদিকে করতোয়া নদীর পানি ১৪ সেমি হ্রাস পেয়ে বিপৎসীমার ১৫৯ সেমি নিচে ও তিস্তার নদীর পানি ১২ সেমি বৃদ্ধি পেয়ে বিপৎসীমার ১৪ সেমি নিচ দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। এসব নদ-নদীর তীরবর্তী নিম্নাঞ্চলের রাস্তা-ঘাট, ঘরবাড়ি ও আবাদি জমি প্লাবিত হয়েছে।

তিস্তা প্রকল্পে সহায়তা করতে চায় চীন-ভারত : ত্রাণ প্রতিমন্ত্রী

দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ প্রতিমন্ত্রী মো. মুহিববুর রহমান বলেছেন, তিস্তা প্রকল্পে ভারত এবং চীন উভয় দেশই সহযোগিতা করতে চায়। গতকাল সচিবালয়ে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের সভাকক্ষে দেশের বন্যা পরিস্থিতি নিয়ে আন্তমন্ত্রণালয় সভা শেষে এ কথা বলেন প্রতিমন্ত্রী। প্রতিমন্ত্রী বলেন, চলমান বন্যায় দেশের ১৮ জেলায় ২০ লাখ মানুষ ক্ষতির শিকার হয়েছেন। বন্যাদুর্গতদের জন্য ৩ হাজার আশ্রয় কেন্দ্র খোলা হয়েছে। আশ্রয় কেন্দ্রে প্রায় ৪০ হাজার মানুষ আশ্রয় নিয়েছেন। এক প্রশ্নের জবাবে প্রতিমন্ত্রী বলেন, তিস্তা প্রকল্পে চীন সম্ভাব্যতা যাচাই করেছে। এ প্রকল্পে ভারত এবং চীন দুই দেশই ফান্ড দিতে চাচ্ছে।

আমাদের ভালো খবর হলো, ভারত এবং চীন এ প্রকল্পে একত্রে কাজ করতে রাজি হয়েছে। প্রধানমন্ত্রী পরিষ্কারভাবে বলেছেন, যার কাছ থেকে অর্থ নিলে দেশ উপকৃত হবে, বাংলাদেশের স্বার্থ অক্ষুণœ থাকবে, তার থেকেই আমরা অর্থ নেব। এটাই হলো সবচেয়ে বড় দেশপ্রেমের কথা। তিনি বলেন, বন্যার পানি এলেই দ্রুত সেটা ড্রেজিং করে বঙ্গোপসাগরে নিয়ে যেতে হবে। এই তিস্তা ব্যারাজ কিন্তু এই প্রকল্পের একটি অংশ। উজান থেকে পানি এলে তো আমাদের করার কিছুই নেই। বন্যার যাতে দ্রুত নিষ্কাশন করা যায় সে বিষয়ে বর্তমান সরকার কাজ করছে। তিনি আরও বলেন, পানি ওঠার সঙ্গে সঙ্গেই যাতে বন্যার পানি নিষ্কাশন হয় সে বিষয়ে আমরা ব্যবস্থা নিয়েছি। এ বিষয়ে বরাদ্দকৃত অর্থ থেকে ডিসিদের আঞ্চলিকভাবে ব্যবহারের ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে। তারা চাইলে এ অর্থ ব্যয় করে তাৎক্ষণিক সমস্যা মোকাবিলা করতে পদক্ষেপ নিতে পারবেন।

আন্তমন্ত্রণালয় বৈঠক সম্পর্কে প্রতিমন্ত্রী বলেন, এখানে সংশ্লিষ্ট সব মন্ত্রণালয় তাদের প্রস্তুতি সম্পর্কে অবগত হয়েছে। সে পরিপ্রেক্ষিতে বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত এলাকাগুলোতে কীভাবে ত্রাণ কার্যক্রম পরিচালনা করা যায়, সে সম্পর্কে আলোচনা হয়েছে। পাশাপাশি ক্ষয়ক্ষতি নিরূপণের কাজ চলছে। আমরা ত্রাণ কার্যক্রম স্বচ্ছতার সঙ্গে চালিয়ে যাচ্ছি। শেখ হাসিনা সরকারের আমলে একজন মানুষও দুর্ভোগের শিকার হয়ে মানবেতর জীবনযাপন করবেন না।

ত্রাণ প্রতিমন্ত্রী জানান, বন্যাদুর্গতদের জন্য ১৮ জেলায় ২১ হাজার ৭০০ টন চাল, নগদ ৫ কোটি ৪৭ লাখ টাকা, ৬৫ হাজার ৫০০ প্যাকেট শুকনো ও অন্যান্য খাবার, গো-খাদ্য বাবদ ৪০ লাখ টাকা এবং শিশু খাদ্যের জন্য ৪০ লাখ টাকা বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। এ ছাড়া সিলেট-৩, সুনামগঞ্জ-১ ও মৌলভীবাজার-২ সংসদীয় আসনে আড়াই হাজার প্যাকেট শুকনো ও অন্যান্য খাবার বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে বলে জানান প্রতিমন্ত্রী।

সর্বশেষ খবর