বৃহস্পতিবার, ১১ জুলাই, ২০২৪ ০০:০০ টা

লক্ষ্য পূরণে ব্যর্থ গাড়ির ডিজিটাল নম্বর প্লেট

চুরি হলেও হয় না উদ্ধার - শনাক্ত করা যায় না অপরাধী

শামীম আহমেদ

যানজট এড়ানো এবং দুর্ঘটনার কারণ অনুসন্ধানসহ সামগ্রিকভাবে নাগরিক সেবার মান বাড়াতে ২০১২ সালে যানবাহনে ডিজিটাল নম্বর প্লেট ব্যবহার বাধ্যতামূলক করে বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষ (বিআরটিএ)। মনে করা হয়, গাড়ি চুরি রোধ, অটোমেটিক টোল আদায় ও অপরাধ দমনে যানবাহনে ডিজিটাল নম্বর প্লেট গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে। গত এক যুগে প্রায় ৪৪ লাখ ডিজিটাল নম্বর প্লেট দিয়ে প্রতিষ্ঠানটি যানবাহন মালিকদের পকেট থেকে নিয়েছে প্রায় দেড় হাজার কোটি টাকা। তবে বিপুল অর্থ ব্যয়ে বাস্তবায়িত প্রকল্পটি পূরণ করতে পারেনি কাক্সিক্ষত উদ্দেশ্য ও লক্ষ্য। ডিজিটাল নম্বর প্লেটের সুবিধা ব্যবহার করে চুরি হওয়া গাড়ি যেমন উদ্ধার হয়নি, তেমনি পাকড়াও করা যায়নি কোনো অপরাধীকেও।

কমানো যায়নি যানজট, অটোমেটিক টোল আদায়ও নেই অধিকাংশ টোল প্লাজায়। ডিএমপি সূত্র জানায়, যে কোনো অপরাধের ক্ষেত্রে অপরাধীরা যানবাহন ব্যবহার করে আসছে। চুরি ও ছিনতাইসহ হত্যার ঘটনায় অপরাধীরা প্রাইভেটকার ও মোটরসাইকেল প্রতিনিয়ত

ব্যবহার করছে। এসব অপরাধ দমনের জন্য গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে ডিজিটাল নম্বর প্লেট। তবে যে পরিকল্পনা নিয়ে এ প্রকল্পের কার্যক্রম শুরু হয়েছিল, তা সঠিকভাবে বাস্তবায়ন হচ্ছে না। এদিকে বাধ্যতামূলক করা ডিজিটাল নম্বর প্লেট কী কাজে আসে তা জানে না বেশির ভাগ যানবাহনের মালিক ও চালক। ১৬ বছর ধরে রাজধানীতে গাড়ি চালানো আবদুল মতিন এ ব্যাপারে বলেন, ডিজিটাল নম্বর প্লেট না থাকলে পুলিশ গাড়ি আটকে মামলা দেয়। এ জন্যই ডিজিটাল নম্বর প্লেট লাগান। চুরি যাওয়া গাড়ি উদ্ধার প্রসঙ্গে তিনি বলেন, গত দুই বছরে তার পরিচিত অনেকের গাড়ি ও  মোটরসাইকেল চুরি হয়েছে। একটাও উদ্ধার হয়নি। প্রতিদিন সারা দেশে শত শত গাড়ি চুরি হচ্ছে। প্রকাশ্যে যানবাহন ব্যবহার করে ছিনতাইসহ নানা অপরাধ হচ্ছে। আমার চোখের সামনেই এমন অনেক ঘটনা ঘটেছে। ডিজিটাল নম্বর প্লেট এসব অপরাধ দমনে কোনো কাজে আসছে বলে তো মনে হচ্ছে না।

এদিকে বিআরটিএ বলছে, ডিজিটাল নম্বর প্লেটের মাধ্যমে যানবাহন ট্রাকিংয়ের সুযোগ নেই। তবে আরএফআইডি স্টেশনের (রেডিও ফ্রিকোয়েন্সি আইডেনটিফিকেশন) কাছ দিয়ে গেলে যানবাহনটি শনাক্ত করা সম্ভব। এজন্য ঢাকার বড় বড় সড়কে আরএফআইডি স্টেশন করা হয়েছে। তবে পুলিশ বলছে, এই স্টেশনগুলোর তথ্যে পুলিশের প্রবেশাধিকার নেই। তাই অপরাধী গাড়ি নিয়ে স্টেশনগুলোর কাছ দিয়ে গেলেও পুলিশের কিছু করার থাকে না। অন্যদিকে বিআরটিএ থেকে তথ্য নিয়ে রাজধানীর কয়েকটি আরএফআইডি স্টেশনে গিয়ে দেখা যায় বেশির ভাগ সিসি ক্যামেরা উধাও। যন্ত্রপাতিও নষ্ট। আবার নথিতে থাকলেও বাস্তবে আরএফআইডি স্টেশনের খোঁজ মেলেনি কয়েকটি সড়কে। শুধু বনানী চেয়ারম্যানবাড়ি বিআরটিএ প্রধান কার্যালয়ের সামনে ফুটওভার ব্রিজে আরএফআইডি স্টেশনে বিভিন্ন সরঞ্জাম মোটামুটি অক্ষত দেখা যায়। সায়েন্সল্যাব মোড়ে গিয়ে স্টেশনের দেখা মিললেও নেই সিসি ক্যামেরা, যে কোনো সময় সড়কে খুলে পড়তে পারে ডিভাইস। কাকরাইলের উইলস লিটল ফ্লাওয়ার স্কুলের সামনে ফুটওভার ব্রিজে স্টেশন পাওয়া গেলেও যন্ত্রপাতি উধাও। একই অবস্থা জিরো পয়েন্টে। এ ছাড়া রাজধানীতে কিছু স্টেশন বসানো হলেও দেশের অন্যত্র নেই।

ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) ট্রাফিক তেজগাঁও বিভাগের উপপুলিশ কমিশনার (ডিসি) মোস্তাক আহম্মেদ বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, সবকিছু পুরোপুরি অটোমেশনে চলে এলে ডিজিটাল নম্বর প্লেট বা আরএফআইডি স্টিকার কাজে আসবে। তবে এই মুহূর্তে চোরাই গাড়ি উদ্ধার, অপরাধ দমন বা ট্রাফিক নিয়ন্ত্রণে ডিজিটাল নম্বর প্লেট পুলিশের কোনো কাজে আসছে না। এই স্টিকার বা নম্বর প্লেট স্ক্যান করার মতো কোনো ডিভাইস আমাদের দেওয়া হয়নি। আমরা মূলত এখনো গাড়ির নম্বর দিয়েই মালিকের তথ্য যাচাই করি। চোরাই গাড়ি বা অপরাধের সঙ্গে জড়িত কোনো গাড়ি আরএফআইডি স্টেশনের কাছ দিয়ে গেলে জানা যায় সেটা কোন দিকে গেছে। তবে এই স্টেশনের এক্সেস (প্রবেশাধিকার) আমাদের নেই। বিআরটিএর পরিচালক  (রোড সেফটি) মোহাম্মদ মাহবুব-ই-রব্বানী বলেন, ডিজিটাল নম্বর প্লেট দিয়ে সব যানবাহনকে একটা ইউনিফর্মের মধ্যে নিয়ে আসা হয়েছে। এটার অনেক সুবিধা আছে। এ ছাড়া কেউ গাড়ি চুরি করে বা অপরাধ করে আরএফআইডি স্টেশনের কাছ দিয়ে গেলে তাকে শনাক্ত করা যায়। তবে কতগুলো আরএফআইডি স্টেশন আছে বা কতগুলো ঠিক আছে তা ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগ বলতে পারবে। এ ব্যাপারে কথা বলতে বিআরটিএর পরিচালক (ইঞ্জিনিয়ারিং) শীতাংশু শেখর বিশ্বাসকে ফোন করে পাওয়া যায়নি।

২০১২ সালে ডিজিটাল নম্বর প্লেট বাধ্যতামূলক করা হয়। একই বছরের অক্টোবর থেকে শুরু হয় ডিজিটাল নম্বর প্লেট ও আরএফআইডি স্টিকার বিতরণ। এজন্য যানবাহন ভেদে ৪ হাজার ৬২৮ থেকে ২ হাজার ২৬০ টাকা আদায় করছে বিআরটিএ। এজন্য এক যুগের বেশি সময়ে গ্রাহকদের পকেট থেকে বেরিয়ে গেছে দেড় হাজার কোটি টাকার বেশি। শুধু স্টিকার বিতরণ ও নম্বর প্লেট লাগিয়ে দিয়েই দায় সেরেছে বিআরটিএ। আধুনিক এ প্রযুক্তির প্রকৃত সুফল পায়নি গ্রাহকরা।

সর্বশেষ খবর