শনিবার, ১৩ জুলাই, ২০২৪ ০০:০০ টা

সাক্ষ্যে আটকা পুলিশ পরিদর্শক হত্যার বিচার

মিনহাজুল ইসলাম

সাক্ষ্যে আটকা পুলিশ পরিদর্শক হত্যার বিচার

দুবাইয়ের আলোচিত স্বর্ণ ব্যবসায়ী রবিউল ইসলাম ওরফে আরাভ খানের ফ্ল্যাটে পুলিশ পরিদর্শক মামুন এমরান খান হত্যার ঘটনায় ২০১৮ সালের ১০ জুলাই ঢাকার বনানী থানায় মামলা করেন তার ভাই জাহাঙ্গীর আলম খান। মামলা দায়েরের অর্ধযুগ পূর্ণ হয়েছে। এখনো শেষ হয়নি মামলাটির সাক্ষ্য গ্রহণ। অভিযোগপত্রভুক্ত ৩৮ জন সাক্ষীর মধ্যে এখন পর্যন্ত ২৪ জনের সাক্ষ্য শেষ হয়েছে। আগামী ২১ জুলাই মামলার পরবর্তী সাক্ষ্য গ্রহণের জন্য দিন ধার্য রয়েছে। মামলাটি ঢাকার প্রথম অতিরিক্ত মহানগর দায়রা জজ ফয়সল আতিক বিন কাদেরের আদালতে বিচারাধীন। সাক্ষ্য সমাপ্তির পর আইন অনুযায়ী সাফাই সাক্ষ্য, আত্মপক্ষ সমর্থন ও যুক্তিতর্ক উপস্থাপন অনুষ্ঠিত হবে। 

এরপর ঘোষণা করা হবে মামলার রায়।

জানা যায়, এ মামলাটি তদন্ত শেষে ডিবি পুলিশের পরিদর্শক শেখ মাহবুবুর রহমান ২০১৯ সালের ৮ এপ্রিল আদালতে অভিযোগপত্র দাখিল করেন। এরপর ২০২১ সালের ২৫ নভেম্বর আসামিদের বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠন করে আনুষ্ঠানিক বিচার শুরু করেন আদালত। মামলায় আরাভ খান বাদে মামলার অন্য আসামিরা হলেন- আরাভের স্ত্রী সুরাইয়া আক্তার কেয়া, নিহত মামুনের বন্ধু রহমত উল্লাহ, স্বপন সরকার, মিজান শেখ, আতিক হাসান, সারোয়ার হাসান ও দিদার পাঠান। এর মধ্যে রবিউল ইসলাম ওরফে আরাভ খান ও সুরাইয়া আক্তার কেয়া জামিনে পলাতক। বাকি ছয় আসামি কারাগারে আছেন। এ ছাড়াও কারাগারে থাকা অন্য দুই অপ্রাপ্ত বয়স্ক আসামি হলেন, মেহেরুন্নেছা স্বর্ণা ওরফে আফরিন ওরফে আন্নাফী ও মোছা. ফারিয়া বিনতে মিম। তারা পরস্পরে দুই বোন। তাদের বিরুদ্ধে ভিন্ন দোষীপত্র দাখিল করা হয়। তাদের বিচার শিশু আদালতে চলমান। আসামিদের মধ্যে কেয়া, আতিক, দিদার, স্বপন, মিজান, স্বর্ণা ও ফারিয়া এ মামলায় আদালতে দোষ স্বীকার করে জবানবন্দি দেন। মামলার অভিযোগপত্রে উল্লেখ করা হয়, আসামিরা সংঘবদ্ধ অপরাধ চক্রের সক্রিয় সদস্য। তারা বিত্তবান লোকদের নানাভাবে নিমন্ত্রণ করে এবং পরে সহযোগী মেয়েদের মাধ্যমে বিভিন্ন ধরনের অসামাজিক কাজ করে ফাঁদে ফেলে অর্থ আদায় করে আসছিল। মূলত আরাভ খান বনানীর ঘটনাস্থলে বাসা ভাড়া নিয়ে আসামি মেহেরুন্নেছা স্বর্ণা ওরফে আফরিনসহ অন্যদের দিয়ে বিত্তবানদের দাওয়াত করে এনে নারী দিয়ে প্রতারণার ফাঁদে ফেলে টাকা আদায় করতেন।

মামলাটি তদন্তকালে জানা যায়, আসামি রহমত উল্লাহ এবং নিহত পুলিশ পরিদর্শক মামুন এমরান খান টেলিভিশনে ক্রাইম ফিকশন নামক অনুষ্ঠানে অভিনয় করত। সে সুবাদে তাদের দুজনের পরিচয় ও বন্ধুত্ব হয়। আসামি মেহেরুন্নেছা স্বর্ণা বেশ কিছুদিন পূর্বে এ অনুষ্ঠানে অভিনয় করত। সেই সময় আসামি রহমত উল্লাহর সঙ্গে স্বর্ণার পরিচয় হয়। পরিচয় সূত্রে মাঝে মাঝে তাদের সঙ্গে মোবাইল ও ফেসবুকে কথা হতো। এরই ধারাবাহিকতায় স্বর্ণা আরাভ খানের স্ত্রী কেয়াকে জানায়, রহমত উল্লাহ ইঞ্জিনিয়ার ও ব্যবসায়ী, তার অনেক টাকা আছে। তাকে এনে ব্ল্যাকমেলিং করতে পারলে অনেক টাকা পাওয়া যাবে। কেয়া বিষয়টি তার স্বামী আরাভ খানকে বলে। এরপর আরাভের পরামর্শে স্বর্ণা রহমতকে ফোন করে বনানীতে তার বান্ধবীর জন্মদিনের অনুষ্ঠানে দাওয়াত দেয়। রহমত স্বর্ণার দাওয়াত গ্রহণ করে এবং নিহত পুলিশ পরিদর্শক মামুন তার ঘনিষ্ঠ বন্ধু হওয়ায় তাকে নিয়ে ২০১৮ সালের ৭ জুলাই সেখানে যান। সেখানে গেলে স্বর্ণা ঘটনাস্থলের ফ্ল্যাটের একটি কক্ষে নিয়ে যায়। এরপর সেখানে আত্মগোপনে থাকা আসামি স্বপন, দিদার, আতিক, সারোয়ার, মিজান ওই কক্ষে প্রবেশ করে ভিকটিম মামুন এমরান খাঁন ও রহমত উল্লাহকে বলে যে, ‘‘তোরা কারা, এখানে কেনো এসেছিস?’’ এ কথা শুনে ভিকটিম মামুন এমরান খাঁন পুলিশের পরিচয় দিলে উল্লেখিত আসামিরা বলে যে, ‘‘তোরা এখানে খারাপ কাজ করতে এসেছিস।’’ এ সময় ভিকটিম মামুন প্রতিবাদ করলে আসামিদের সঙ্গে হাতাহাতি হয়। পরে আসামিরা রহমত ও মামুনকে বেঁধে তাদের কাছে থাকা ডেবিট কার্ড, টাকা-পয়সা ছিনিয়ে নেয়। একপর্যায়ে তারা মামুনকে মারতে শুরু করে। এতে মামুন অজ্ঞান হয়ে পড়েন। রাত ১০টার দিকে আসামি কেয়া (আরাভের স্ত্রী), স্বর্ণা ও মীম বাসা থেকে চলে যান। রাতের কোনো একসময় সেখান থেকে চলে যান আরাভ খানও। সেখানে থাকা আসামিরা ভোরবেলায় তারা নিশ্চিত হন, মামুন মারা গেছেন। মামুন মারা যাওয়ার পর রহমত উল্লাহ সবাইকে বলেন, লাশ গুম না করলে তারা সবাই বিপদে পড়ে যাবেন। কারণ, মামুন তার বন্ধু। তিনি মামুনকে ফোন করে ডেকে এনেছেন।

এরপর আরাভ খানের সহায়তা ও পরামর্শে রহমত উল্লাহর ব্যক্তিগত গাড়ি ব্যবহার করে অন্য আসামিরা ফ্ল্যাট থেকে লাশ বস্তায় ভরে সরিয়ে ফেলে। পরে উলুখোলা থেকে আবদুল্লাহপুর যাওয়ার পথে একটি বাঁশবাগানে পেট্রল ঢেলে মামুনের লাশ পুড়িয়ে দেওয়া হয়। আসামিদের পেট্রল সরবরাহ করেন আরাভ খান। এরপর গাড়ি নিয়ে সবাই ঢাকায় ফিরে আসেন। এ ঘটনার পর ৯ জুলাই নিহত মামুনের লাশ উদ্ধার করে পুলিশ। পরদিনই বনানী থানায় হত্যা মামলা হয়। ভাই হত্যার কেমন বিচার চান এমন প্রশ্নের উত্তরে মামলার বাদী জাহাঙ্গীর আলম খান বলেন, এমপি আনার হত্যার আসামিদের বিভিন্ন জায়গা থেকে ধরা হচ্ছে। অথচ, আরাভ খানকে দেশে ফেরানোর কোনো চেষ্টা করা হচ্ছে না। আমি আমার ভাইয়ের হত্যাকারীদের মৃত্যুদন্ড চাই।

এ মামলাটির বিচারকাজে অগ্রগতির বিষয়ে জানতে চাইলে ঢাকা মহানগর দায়রা জজ আদালতের অতিরিক্ত পাবলিক প্রসিকিউটর (রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবী) আবদুস সাত্তার দুলাল বলেন, সাক্ষ্য গ্রহণ শেষ পর্যায়ে রয়েছে। আর কিছু সাক্ষীর সাক্ষ্য হলেই মামলার সাক্ষ্য গ্রহণ সমাপ্তির দিকে যাবে। আমরা আশা করছি ন্যায়বিচার হলে সব আসামিই সর্বোচ্চ শাস্তি তথা মৃত্যুদন্ডে দন্ডিত হবেন।

সর্বশেষ খবর