সোমবার, ২২ জুলাই, ২০২৪ ০০:০০ টা

ইন্টারনেট ছাড়া অন্যরকম পারিবারিক জীবন

জিন্নাতুন নূর

ইন্টারনেট ছাড়া অন্যরকম পারিবারিক জীবন

দেশজুড়ে চলমান কারফিউ ও সহিংসতার কারণে গত চার দিন ধরে মানুষ পুরোপুরি ইন্টারনেটের সুযোগ-সুবিধা থেকে বঞ্চিত। অথচ ইন্টারনেট ছাড়া এখনকার মানুষ এক মুহূর্তের কথাও চিন্তা করতে পারে না। যোগাযোগ, তথ্যপ্রাপ্তি, জরুরি নাগরিক সেবা সবকিছুই হচ্ছে ইন্টারনেটের মাধ্যমে। বিশেষ করে তরুণ প্রজন্ম ইন্টারনেট ছাড়া যেন কিছুই বোঝে না। অথচ একটা সময় ছিল যখন মানুষ তার পরিবারের সঙ্গে খাবার টেবিলে খেতে বসে বা পারিবারিক আড্ডায় ঘণ্টার পর ঘণ্টা সুন্দর সময় গল্পে কাটাতেন। একসঙ্গে বসে সিনেমা উপভোগ করতেন। অনেকেই তাদের প্রিয় লেখকের বই পড়তেন। পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে ক্যারম বোর্ড, লুডু খেলতেন। কিন্তু ইন্টারনেটের যুগে বিভিন্ন সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম, অনলাইন গেম, নেটফ্লিক্সের মতো বিভিন্ন বিনোদন প্ল্যাটফরমে মানুষ এতই আসক্ত যে, তারা তাদের অবসর সময়ের পুরোটাই পরিবার বা প্রিয়জনকে না দিয়ে ইন্টারনেট দুনিয়ায় বুঁদ হয়ে থাকেন। এবার চার দিন ইন্টারনেট সুবিধা না থাকায় বহুদিন পর দেশের মানুষ তার পরিবারের সঙ্গে একান্তে কিছুটা পারিবারিক সময় উপভোগ করছেন। স্বস্তির বিষয় হচ্ছে- শিশু-কিশোররা মোবাইল ফোন ছেড়ে পরিবারের বড়দের সঙ্গে গল্প ও খুনসুটিতে মেতেছে। সব মিলিয়ে ইন্টারনেট ছাড়া এক অন্যরকম পারিবারিক জীবন কাটাচ্ছেন এখন দেশের মানুষ।

কারফিউ এবং সাধারণ ছুটি ঘোষণা করায় স্কুল-কলেজ ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ। বিশেষ প্রয়োজন ছাড়া কেউ ঘরের বাইরে তেমন বের হচ্ছেন না। করোনা মহামারির সেই গৃহবন্দির সময় মানুষ ঘরে থাকলেও ইন্টারনেট দিয়ে ঘরের বাইরের দুনিয়ার সঙ্গে যোগাযোগ করতেন, অফিস করতেন, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ক্লাসও অনলাইনে ছিল। তবে এবার গৃহবন্দি মানুষের কাছে ইন্টারনেট না থাকায় পরিস্থিতি ভিন্ন। ইন্টারনেট সংযোগ না থাকায় বেশ কিছু জরুরি সেবা ও দেশের বাইরে যোগাযোগ বন্ধ থাকলেও পরিবারের সঙ্গে মানুষ একান্ত উপভোগ্য কিছু সময় কাটাচ্ছেন। এমনই একটি পরিবারের গৃহিণী রাজধানীর রূপনগরের একটি বিদ্যালয়ের স্কুলশিক্ষক জাকিয়া সুলতানা গতকাল বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ে মোবাইল আসক্তির কারণে সন্তানরা এখন পরিবারের কারও দিকে ফিরেও তাকায় না। এই কয়েকদিন ইন্টারনেট ছাড়া আমার বাচ্চারা একটু অস্থির হয়ে থাকলেও এ সময়ে পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে তাদের এক ধরনের একাত্মতা তৈরি হয়েছে। তিনি জানান, গত শনিবার রাতে আমি ও আমার স্বামী আমাদের টিনএজ দুই ছেলের সঙ্গে গভীর রাত পর্যন্ত লুডু খেলেছি। বড় ছেলেটি একপর্যায়ে তার ছোটবেলার স্মৃতি মনে করে হাসি-আড্ডায় আমাদের সবাইকে মাতিয়ে রাখে। ঘরের মধ্যে এরকম পরিবেশ বহুদিন বাদে উপভোগ করতে পেরেছি।

মিরপুর শ্যামলী এলাকার বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া শিক্ষার্থী শোভন রহমান বলেন, আগে পাড়ার বাল্যকালের বন্ধুরা সবাই ইন্টারনেটে ব্যস্ত থাকায় একসঙ্গে গল্প করার সুযোগ মিলত না। কিন্তু ইন্টারনেট না থাকায় গত কয়েকদিন তারা ছোটবেলার মতো আমার বাসায় ছাদে এসে আড্ডা দিচ্ছে। এই শিক্ষার্থী বলেন, গত এক বছরে যাদের কাছে পাইনি তারাও এখন সময় কাটাতে না পেরে গল্প করতে বাসায় আসছেন।

রাজধানীর শেওড়াপাড়ার সাবেক এক স্কুলশিক্ষক মো. মোস্তফা কামাল বলেন, ইন্টারনেটের অতিরিক্ত আসক্তির কারণে আমাদের পরিবারগুলোর মধ্যে এখন এক ধরনের বিচ্ছিন্নতা চলে এসেছে। আমাদের তরুণ এবং কিশোর ছেলেমেয়েরা এখন নিজের রুমে দরজা আটকে ইন্টারনেটে মগ্ন থাকে। তারা আর অভিভাবকের সঙ্গে মন খুলে কথা বলে না। আমরা বড়রা কোথাও বেড়াতে গেলে তারা আমাদের সঙ্গে যেতে চায় না। আমাদের শৈশবে এমন ছিল না। ছেলেমেয়েরা বেশির ভাগ সময় বিভিন্ন সামাজিক মাধ্যমে ডুবে থাকে।

রিসার্চ অ্যান্ড ম্যানেজমেন্ট কনসালটেন্সি লি.-এর একজন গবেষক তাহসিন শার্মিলা রাইসা বলেন, আমার ছোট দুই ভাগ্নি ইন্টারনেট না থাকায় ইউটিউব দেখতে পারছে না। কিন্তু তারা এখন আগের থেকে বড়দের সঙ্গে  বেশি কথা বলছে। যা আগে তুলনামূলক কম হতো। আগে ইউটিউবে কার্টুন না দেখে তারা খেতে চাইত না। কিন্তু এখন সেই বাচ্চারাই আমাদের কথা শুনছে। আমাদের সঙ্গে গল্প ও খুনসুটি করছে। ইন্টারনেট ছাড়াও যে পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে কথা বলে ভালো সময় কাটানো যায় তা এই বাচ্চারা এখন বুঝতে পারছে।

বেসরকারি ব্যাংকে কর্মরত চাকরিজীবী মো. জিসান বলেন, একসময় ছিল যখন রাতে নিয়মিত গল্পের বই পড়ে ঘুমাতে যেতাম। ইন্টারনেটে আসক্তি তৈরি হওয়ায় সেই অভ্যাস চলে গিয়েছিল। গত কয়েকদিন ইন্টারনেট না থাকায় পুরনো গল্পের বইগুলো আবার বের করে পড়া শুরু করেছি।

অভিভাবকরা বলেন, ইন্টারনেট ছাড়া আমরা অচল এটা ঠিক। আমরাও চাই শিশু-কিশোররা ইন্টারনেটের অতিরিক্ত আসক্তি থেকে বের হয়ে আসুক। সরকারের পক্ষ থেকে ১৮ বছরের নিচে ইন্টারনেট ব্যবহারের ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি করা উচিত। কিংবা সপ্তাহে দুই দিন স্কুল-কলেজের শিক্ষার্থীদের ক্ষেত্রে ইন্টারনেট ব্যবহারে লাগাম টানা উচিত। বিশেষ ক্ষেত্রে ইন্টারনেট ব্যবহারের সুযোগ দিলেও বাসাবাড়িতে ইন্টারনেট না দিলেও হবে। তরুণ প্রজন্মকে রক্ষা করতে ইন্টারনেটের ব্যবহার কমিয়ে আনা উচিত বলে তারা মনে করেন।

সর্বশেষ খবর