বুধবার, ২৪ জুলাই, ২০২৪ ০০:০০ টা

স্থবির অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড

♦ ধ্বংসাত্মক কর্মকাণ্ড থেকে সরে আসার আহ্বান ব্যবসায়ী ও অর্থনীতিবিদদের ♦ ব্যাংক ও আর্থিক লেনদেন বন্ধ থাকায় ভোগান্তি চরমে, ব্যবসাবাণিজ্যের অপূরণীয় ক্ষতি

মানিক মুনতাসির

সরকারি চাকরিতে কোটা সংস্কার আন্দোলনকে কেন্দ্র করে টানা কয়েক দিনের ধ্বংসাত্মক কর্মকাণ্ডের ফলে দেশে সব ধরনের অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড  স্থবির হয়ে পড়ে। ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানসহ প্রায় সব ধরনের আর্থিক লেনদেন বন্ধ ছিল নিরাপত্তা ও নেটওয়ার্ক জটিলতার কারণে। পরিস্থিতি কিছুটা উন্নতি হওয়ায় কারফিউর সময়সীমা কমিয়ে আনা হয়েছে। টানা প্রায় এক সপ্তাহ বন্ধ থাকার পর আজ স্বল্প সময়ের জন্য খুলছে দোকানপাট, শপিংমল, ব্যবসা প্রতিষ্ঠান। উ™ভূত পরিস্থিতিতে সারা দেশে টানা তিন দিনের সাধারণ ছুটি শেষে আজ সীমিত পরিসরে খুলেছে সরকারি-বেসরকারি অফিস ও ব্যাংক-বীমা, শেয়ারবাজার। অবশ্য শুধুমাত্র বন্দর এলাকায় সীমিত পরিসরে লেনদেন চালু ছিল। তবে তা আমদানি-রপ্তানি প্রক্রিয়ার জন্য যথেষ্ট ছিল না। একই সঙ্গে ইন্টারনেট সংযোগ না থাকায় বন্ধ ছিল মোবাইল ব্যাংকিং ফিন্যান্সিয়াল সার্ভিসসহ সব ধরনের অনলাইন লেনদেনও। যা আজ থেকে স্বল্প পরিসরে চালু হচ্ছে। সারা দেশে ব্যাংকের এটিএম বুথগুলোতেও লেনদেনে জটিলতার সৃষ্টি হয়েছিল। বিদ্যুৎ ও গ্যাসের প্রি-পেইড মিটার রিচার্জ করা নিয়েও দুর্ভোগ পোহাতে হয়েছে গ্রাহকদের। ফলে সব ধরনের ব্যবসা-বাণিজ্য ও অর্থনৈতিক কর্মকা  মুখ থুবড়ে পড়ে। এটাকে আবার পুনরায় সচল করাও সরকারের জন্য এক ধরনের চ্যালেঞ্জ বলে মনে করেন সংশ্লিষ্টরা।

এ ছাড়া নিরাপত্তাজনিত অনিশ্চয়তা ও চলমান কারফিউর কারণেও দিনের বেশির ভাগ সময় সব ধরনের মার্কেট, ব্যবসা প্রতিষ্ঠান বন্ধ থেকেছে। গার্মেন্টসহ সকল প্রকার কারখানায়ও উৎপাদন বন্ধ হয়ে পড়ে। যদিও পরীক্ষামূলকভাবে গতকাল বন্দরনগরী চট্টগ্রাম এলাকার পোশাক কারখানাগুলো খোলা হয়েছে। অর্ডার বাতিল এড়াতে চট্টগ্রাম বন্দরে সীমিত পরিসরে পণ্য জাহাজীকরণ ও খালাস শুরু হয়েছে ম্যানুয়াল পদ্ধতিতে। কারফিউ শিথিলের সময়সীমাও বাড়ানো হয়েছে। আজ সকাল ১০ থেকে বিকাল ৫টা পর্যন্ত শিথিল রাখা হয়েছে কারফিউ। কার্যত রাস্তাঘাট, মার্কেট, বাজার, আমদানি-রপ্তানিসহ ব্যাংক এবং আর্থিক লেনদেন বন্ধ থাকায় চরম ভোগান্তি পোহাতে হয়েছে সাধারণ মানুষকে। এতে দেশের সামষ্টিক অর্থনীতি ও ব্যবসা-বাণিজ্যের অপূরণীয় ক্ষতিসাধন হয়েছে। এ জন্য ভবিষ্যতে এ ধরনের ধ্বংসাত্মক কর্মকা  থেকে সবাইকে সরে আসার আহ্বান জানিয়েছেন ব্যবসায়ী ও অর্থনীতিবিদরা। এদিকে দেশের অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড  সচল রাখতে এফবিসিসিআই, বিজিএমইএ, বিকেএমইএ, বিসিআই, ডিসিসিআই, সার্ক চেম্বার, এমসিসিআইসহ প্রায় সবগুলো চেম্বার থেকে যুক্ত বিবৃতি দেওয়া হয়েছে। সেখানে কোটা আন্দোলনের ফলে অর্থনীতির অপূরণীয় ক্ষতিতে গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করা হয়েছে। আন্দোলনের নামে এ রকম অরাজকতা চলতে থাকলে তা অর্থনীতির অগ্রযাত্রাকে ব্যাহত করতে এবং দেশের শিল্পায়ন ও কর্মসংস্থানকে আরও সংকুচিত করবে বলে জানিয়েছেন ব্যবসায়ীরা।

সামগ্রিক পরিস্থিতি সম্পর্কে জানাতে ও দ্রুত করণীয় নির্ধারণে সব পর্যায়ের শীর্ষ ব্যবসায়ীদের সঙ্গে গত সোমবার নিজ কার্যালয়ে মতবিনিময় করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। সে সভায় ব্যবসায়ীরা এ ধরনের কর্মকাে র পুনরাবৃত্তি যেন না ঘটে সে জন্য সরকারকে কঠোর হস্তে দুষ্কৃতকারীদের দমনের দাবি জানান। তারা বলেন, এ ধরনের কর্মকা  দেশের উন্নয়ন ও অগ্রযাত্রাকে বাধাগ্রস্ত করে। সামষ্টিক অর্থনীতিকে ধ্বংস করে। যা কোনোভাবেই কাম্য নয়। এ প্রসঙ্গে এফবিসিসিআই সভাপতি মাহবুবুল আলম বলেছেন, আমাদের ব্যবসায়ীদের হৃদয়ে রক্তক্ষরণ হচ্ছে। আমরা হৃদয়কে মানাতে পারছি না, আজকে আমাদের অর্থনীতিকে ধ্বংস করে যাচ্ছে, অথচ তারাও আমাদের দেশের মানুষ।

এ প্রসঙ্গে ঢাকা চেম্বার অব কমার্সের সাবেক সভাপতি আবুল কাশেম খান বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, যে কোনো দাবি আদায় কেন্দ্র করে কোনো প্রকার ভাঙচুর, অরাজক পরিস্থিতি সৃষ্টি করা এটা কোনোভাবেই সমর্থনযোগ্য নয়। এতে দেশের সামগ্রিক ব্যবসা-বাণিজ্য ও অর্থনীতির অপূরণীয় ক্ষতি হয়। যা দেশের অগ্রযাত্রাকে ব্যাহত করে। এ জন্য ধ্বংসাত্মক কর্মকা  থেকে সবাইকে সরে আসার আহ্বান জানান এই ব্যবসায়ী নেতা। এদিকে ছাত্র আন্দোলনের জেরে সৃষ্ট অরাজকতার কারণে গত কয়েক দিন ধরে দেশের খুচরা ও পাইকারি সব ধরনের বাজারেও চলছে অচলাবস্থা। টানা ছয় দিন পর গতকাল সীমিত পরিসরে চালু হয়েছে ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কে যান চলাচল। খাতুনগঞ্জ, চাক্তাই, কারওয়ানবাজার, ইসলামপুরসহ সব পাইকারি বাজার এখনো পুরোদমে চালু করা সম্ভব হয়নি। ফলে পণ্যের সরবরাহ চেইন লন্ডভন্ড হয়ে গেছে। যার প্রভাব পড়েছে ভোক্তা পর্যায়ে। বিভিন্ন পর্যায়ে বেড়েছে পণ্যের দাম। 

টানা কয়েক দিন ধরে ব্যবসা-বাণিজ্য ও ব্যাংক লেনদেন বন্ধ থাকায় চরম ভোগান্তিতে পড়েছেন সাধারণ মানুষ। দৈনন্দিন প্রয়োজন মেটানোর মতো মানুষের হাতে থাকা নগদ টাকাও ফুরিয়ে যায়। অনেককে কেনাকাটায় হিমশিম খেতে হয়। কেননা গত প্রায় এক দশক ধরে রাজধানীসহ সারা দেশের মানুষ আর্থিক লেনদেনের ক্ষেত্রে অনলাইন নির্ভর হয়ে পড়েছিলেন। হঠাৎ করে এতে ছন্দপতন হওয়ায় ভোগান্তিতে পড়েন। ইন্টারনেট না থাকায় ডেবিট ও ক্রেডিট কার্ডেও লেনদেন করা সম্ভব হয়নি। যা আজ থেকে পুনরায় চালু হয়েছে। 

বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. সালেহ উদ্দিন আহমেদ বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, কোনো ধরনের ধ্বংসাত্মক কর্মকা  কোনোভাবেই কাম্য নয়। ছাত্র আন্দোলনের জেরে যে অরাজক পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে দ্রুত এর একটা সমাধান হওয়া জরুরি। এখন অন্তত সব পক্ষকে শান্ত হয়ে নিজ নিজ কাজে ফেরা উচিত। এ আন্দোলনকে কেন্দ্র করে অর্থনীতিতে যেসব ক্ষতি ইতোমধ্যে হয়ে গেছে সেগুলো কাটিয়ে ওঠার জন্য কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়ারও আহ্বান জানিয়েছেন এই অর্থনীতিবিদ। বেসরকারি চাকরিজীবি আবুল খায়ের খান জানান, তিনি গ্রাফিক্স ডিজানিংসহ আউটসোর্সিংয়ের কাজ করেন। টানা কয়েকদিন ধরে ইন্টারনেট না থাকায় পেশাগত কাজের ব্যাপক ক্ষতি হচ্ছে। একই সঙ্গে আর্থিক লেনদেন করতে না পারায় তিনিও ভোগান্তিতে পড়েছেন। এ পরিস্থিতিতে  নগদ টাকার সংকটে পড়ে বাজার করে খাওয়ার মতো অবস্থাও ছিল না বলে তিনি জানান। এ প্রসঙ্গে ডিজিটাল মার্কেটিং বিশেষজ্ঞ ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মার্কেটিং বিভাগের অধ্যাপক ড. রাফিউদ্দীন আহমেদ বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, গত এক দশকেরও বেশি সময় ধরে দেশের মানুষ বিশেষ করে শহরবাসী অনলাইন লেনদেন ও অনলাইন কেনাকাটায় নির্ভর হয়ে পড়েছিলেন। এ জন্য হাতে ক্যাশ রাখা কমিয়ে দিয়েছেন। হঠাৎ করে ছাত্র আন্দোলনকে কেন্দ্র করে ইন্টারনেট জটিলতা সৃষ্টি হওয়ায় এতে দৈনন্দিক জীবনে ছন্দপতন ঘটেছে। এর জন্য আমরা কেউই প্রস্তুত ছিলাম না। এ ছাড়া ব্যাংক লেনদেনও বন্ধ ছিল নিরাপত্তাজনিত কারণে। এতে করে আমাদের আমদানি-রপ্তানিও বাধাগ্রস্ত হয়েছে। যার রেশ এখনো শেষ হয়নি। এর একটা বড় প্রভাব পড়ছে সামগ্রিক অর্থনীতিতে। এ অবস্থা থেকে দ্রুত উত্তরণ ঘটাতে না পারলে দেশের সামষ্টিক অর্থনীতি আরও বেশি ক্ষতির মুখে পড়বে বলে তিনি মনে করেন।

সর্বশেষ খবর