শুক্রবার, ২৬ জুলাই, ২০২৪ ০০:০০ টা
কারফিউ অব্যাহত, শিথিল সকাল ৮টা-বিকাল ৫টা

শিথিলে ফিরেছে প্রাণচাঞ্চল্য

চিরচেনা রূপে রাজধানী, ছেড়েছে গাড়ি চলেছে লঞ্চ, ঢাকার বাইরেও শান্ত পরিস্থিতি

নিজস্ব প্রতিবেদক

শিথিলে ফিরেছে প্রাণচাঞ্চল্য

গতকাল রাজধানীর সদরঘাট লঞ্চ টার্মিনালে ভিড় -বাংলাদেশ প্রতিদিন

চলমান পরিস্থিতির উন্নতি হওয়ায় কারফিউ শিথিলের সময়সীমা দুই ঘণ্টা বাড়িয়ে সকাল ৮টা থেকে বিকাল ৫টা করা হয়েছে। একই সঙ্গে আজ ও আগামীকাল (শুক্র-শনি) ঢাকা, নারায়ণগঞ্জ, নরসিংদী, গাজীপুরে কারফিউ অব্যাহত থাকবে বলে গতরাতে গণমাধ্যমকে জানিয়েছেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান।

এদিকে কারফিউর ষষ্ঠ দিনেও গতকাল রাজধানীতে ছিল কঠোর সেনা টহল। তবে শিথিল সময়ে অফিস-আদালত, বাজার-ঘাটে ফেরে কর্মচাঞ্চল্য। অবশ্য যে কোনো অপ্রীতিকর ঘটনা মোকাবিলায় সতর্ক অবস্থানে রয়েছে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। বিভিন্ন মোড়ে চলেছে চেকপোস্ট বসিয়ে তল্লাশির পাশাপাশি নিয়মিত টহল।

গতকাল সকাল ১০টা থেকে কারফিউ শিথিলের পর চিরচেনা চেহারায় ফেরে রাজধানী। তবে বাইরে বেরিয়েই ভোগান্তিতে পড়েছেন অনেকে। কিছু সড়কে চলাচল বন্ধ ও যানবাহন সংকটই ছিল এর বড় কারণ। এদিন রাজধানী থেকে বিভিন্ন গন্তব্যে ছেড়ে গেছে দূরপাল্লার গাড়িও। আসা-যাওয়া করছে পণ্যবাহী ট্রাক ও পিকআপ। সরেজমিনে দেখা গেছে, সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত রাজধানীর কোথাও কোনো সংঘাত-সহিংসতা ঘটেনি। সার্বিক পরিস্থিতি ছিল স্বাভাবিক। অফিস খুলে দেওয়ায় সড়কে বিপুলসংখ্যক যানবাহন চলেছে। সার্বিক পরিবেশ শান্ত ছিল। তবে বিকাল ৫টার পর কিছুটা বিপত্তি ঘটে। যানজটে পড়ে তখনো সড়কে অনেক যানবাহন আটকা ছিল। রাজধানীর ভাটারা থানার সামনে কিছুটা অস্বস্তি তৈরি হয়। এ সময় প্রায় সব গাড়ি ঘুরিয়ে দেওয়া হয়। এদিকে গত কয়েক দিনের ধ্বংসযজ্ঞের ক্ষতচিহ্ন ক্রমে স্পষ্ট হতে শুরু করেছে। সড়ক থেকে সরানো হয়েছে বেশির ভাগ ধ্বংসস্তূপ। খোলা ছিল বেশির ভাগ ফুটপাতের দোকান। সাধারণ মানুষ অনেকটা ভয়হীন ও স্বাভাবিকভাবে চলাফেরা করেছেন। কারফিউ বলবৎ থাকায় সেনাবাহিনীকে বিভিন্ন এলাকায় টহল দিতে দেখা গেছে। সব মিলে বেশির ভাগ এলাকা ছিল শান্তিপূর্ণ। আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে সড়কে র‌্যাব-পুলিশের পাশাপাশি সেনাবাহিনী, বিমানবাহিনী, নৌবাহিনী, বিজিবি ও আনসার সদস্যদের টহল রয়েছে। কয়েক দিন যেখানে সুনসান নীরবতায় আচ্ছন্ন ছিল, সেসব এলাকায় গতকাল ছিল ব্যাপক ব্যস্ততা। গাড়ির হুইসেল-হর্ন আর মানুষের কোলাহলে মুখর ছিল চারপাশ। অফিস খোলার দ্বিতীয় এ দিন সকাল থেকেই সড়কে বাড়তে থাকে মানুষের উপস্থিতি। জীবন-জীবিকার টানে ঘরবন্দিত্ব ছেড়ে কর্মস্থলের উদ্দেশে বের হন রাজধানীবাসী। সড়কে বাড়ে যানবাহনের সংখ্যাও। ঢাকার প্রধান সড়ক থেকে শুরু করে অলিগলিতেও সকাল ১০টার পর থেকেই শুরু হয় যানজট। বেলা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে অন্যসব স্বাভাবিক দিনের মতোই প্রাণ ফিরতে শুরু করে ঢাকায়। বিকাল ৩টায় অফিস ছুটি হওয়ার পর ঘরমুখো মানুষের সমাগমে আবার যানজট বেড়ে যায়। কয়েক দিন বন্ধ থাকার পর বাসা থেকে বের হতে পেরে স্বস্তির কথা জানান মিরপুরের বেসরকারি চাকরিজীবী সাজ্জাদ হোসেন। তিনি বলেন, কয়েক দিনের বন্ধে হাঁপিয়ে উঠেছি। বিদ্যুৎ-গ্যাসের বিলও দিতে পারিনি। সে জন্য ব্যাংকে গিয়ে বিল জমা দিয়ে এসেছি। মিরপুর, আগারগাঁও, মহাখালী, কাকরাইল, মালিবাগ, রামপুরা, পল্টন, তোপখানা রোড এলাকা ঘুরে সড়কে মানুষের ভিড় দেখা গেছে। রিকশা, মোটরসাইকেল, অটোরিকশা, ব্যক্তিগত বাহনের পাশাপাশি গণপরিবহনও চলতে দেখা গেছে। রাস্তায় নামা যাত্রীরা বলেন, একদিকে বন্ধ মেট্রোরেল, অন্যদিকে বন্ধ এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে। তার মধ্যে রাস্তার বিভিন্ন স্থানে চেকপোস্ট স্থাপন করার কারণে সড়কে প্রচ- যানজট দেখা দিয়েছে। গণপরিবহনের অভাবে মূল সড়কেও দেখা যায় রিকশা, ব্যাটারিচালিত অটোরিকশা ও সিএনজিচালিত অটোরিকশার আধিক্য। ছিল ব্যক্তিগত গাড়িও। গণপরিবহন না পাওয়ায় এবং যানজটের কারণে অফিসগামী যাত্রীরা সকালেই পড়েন ভোগান্তিতে। 

পুলিশ সদস্যরা জানান, নাশকতায় ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ায় মেট্রোরেল বন্ধ, অন্যদিকে নিরাপত্তার কারণে বন্ধ গণভবনের সামনের সড়ক। সংগত কারণে কল্যাণপুর, মিরপুর, গাবতলী ও শ্যামলীর সব গাড়ি আসছে আগারগাঁও রুটে। তাই প্রচুর চাপ ছিল সড়কে। এ ছাড়া নতুনবাজার থেকে গুলশান যাওয়া-আসার সড়কটিও বন্ধ, যে কারণে পথচারী ও গাড়ি ঘুরে আসতে হচ্ছে। এর ফলে শাহজাদপুর ও উত্তর বাড্ডায় গাড়ির প্রচুর চাপ ছিল।

রাজশাহীর সড়কে মানুষের ঢল : বিভাগীয় শহর রাজশাহীর গতকালের পরিস্থিতি ছিল স্বাভাবিক। শহরের প্রধান প্রধান সড়ক ও অলিগলিতে বেড়েছে মানুষের উপস্থিতি। রাস্তায় পর্যাপ্ত রিকশা-অটোরিকশা ও মোটরসাইকেল চলাচল করেছে। অফিস, আদালত ও ব্যাংকগুলোতেও ছিল স্বাভাবিক উপস্থিতি। চলাচল করেছে দূরপাল্লার বাস। তবে এদিন দুটি ট্রেন ছাড়ার কথা থাকলেও সেটি ছাড়েনি।

গতকাল সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত নগরীর সাহেববাজার জিরোপয়েন্ট, সোনাদীঘি, মালোপাড়া, কাদিরগঞ্জ, রেলগেট, রাণীবাজার, কুমারপাড়া, আলুপট্টি, তালাইমারী, ভদ্রা, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়-সংলগ্ন কাজলা, বিনোদপুর, চৌদ্দপাই এবং কাটাখালী এলাকায় মানুষের চলাচল বেড়েছে। রিকশা-অটোরিকশাও পর্যাপ্ত চলাচল করেছে। দোকানপাটও খুলেছে। মোড়ে মোড়ে পুলিশ মোতায়েন আছে।

বরিশালে খুলেছে অফিস, দোকানপাট : গত দুই দিনের তুলনায় বরিশাল নগরীর বাসিন্দাদের মাঝে কর্মতৎপরতা বেড়েছে কয়েক গুণ। ব্যাংক-বিমা, অফিস আদালত, পাইকারি ও খুচরাসহ সব দোকানপাট খোলা হয়েছে। বরিশাল নগরীতে এখন সকাল ৬টা থেকে সন্ধ্যা ৬টা পর্যন্ত ১২ ঘণ্টা কারফিউ শিথিল থাকছে। এ সময়ের মধ্যে খেটে খাওয়া শ্রমজীবী মানুষের মধ্যে কর্মচাঞ্চল্য দেখা গেছে। গতকাল সকাল ৯টা থেকে নগরীর পাইকারি বাজার, অফিসপাড়া ও ব্যাংক বিমা প্রতিষ্ঠান ঘুরে দেখা গেছে স্বাভাবিক কর্মকান্ড। তবে ইন্টারনেট গতি কম থাকায় কাজকর্মে একটু ধীরগতি লক্ষ্য করা গেছে। বরিশালের অভ্যন্তরীণ লঞ্চ চলাচল অব্যাহত থাকলেও বরিশাল-ঢাকা লঞ্চ চলাচল পরবর্তী নির্দেশ না পাওয়া পর্যন্ত বন্ধ থাকবে বলে জানিয়েছেন বরিশাল নৌ-বন্দরের কর্মকর্তা আবদুর রাজ্জাক। বরিশালের পুলিশ কমিশনার জিহাদুল কবির বলেন, ব্যাবসায়ীদের দাবির পরিপ্রেক্ষিতে প্রায় ১২ ঘণ্টা কারফিউ শিথিল করা হয়েছে। আমরাও সার্বক্ষণিক পরিস্থিতি পর্যালোচনা করছি। যে কোনো সময় বরিশাল থেকে কারফিউ তুলে নেওয়া হবে।

টানা আট দিন পর প্রাণ ফিরেছে বগুড়ায় : টানা আট দিন পর প্রাণ ফিরেছে বগুড়ায়। কারফিউ শিথিলের সুযোগে আবারও যানজটে পরিণত হয়েছে শহর। সরকারি-বেসরকারি অফিস, ব্যবসা প্রতিষ্ঠান খোলার দ্বিতীয় দিন গতকাল শহরে স্বাভাবিক অবস্থা ফিরে আসে। একই সঙ্গে বেড়ে যায় যানজট। প্রয়োজনীয় কাজ সারতে মানুষ ঘর থেকে বের হয়ে আসেন। সকাল থেকে বগুড়া শহরের ব্যস্ত সাতমাথাসহ সব কটি সড়কে রিকশা-অটোরিকশা, ইজিবাইক, যাত্রীবাহী বাস আর ব্যক্তিগত গাড়ির দীর্ঘ লাইন চোখে পড়ে। প্রচ- রোদে যানজটে আটকে থেকে পথচারী ও যাত্রীরা পড়েন ভোগান্তিতে। কারফিউ শিথিলকালে অফিস-আদালত, ব্যাংক, বিমা, মার্কেট, দোকান ও ব্যবসা প্রতিষ্ঠানসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান খোলা হয়। চলাচল করে বাস-কোচসহ সব ধরনের যানবাহন। বগুড়া থেকে বিভিন্ন সড়কে চলাচল করে দূরপাল্লার বাস। বগুড়ার পুলিশ সুপার জাকির হাসান জানান, বুধবার থেকে কারফিউ শিথিল হলেও শহরে যানজট নিরসনে ট্রাফিকের কোনো সদস্য ছিলেন না। সবাই মানুষের জানমালের নিরাপত্তার দায়িত্বে ছিলেন।

টাঙ্গাইলের সড়কে সড়কে মানুষের ভিড় : কারফিউ শিথিল করার পর টাঙ্গাইলে দ্বিতীয় দিনের মতো সরকারি অফিস-আদালত এবং ব্যাংকের স্বাভাবিকভাবে কার্যক্রম চলছে। গতকাল সকাল থেকে ব্যাংকে এবং সরকারি অফিসগুলোতে মানুষের ভিড় দেখা গেছে। শহরের দোকানপাট এবং বিপণিবিতানগুলোও খুলেছে। মানুষের যাতায়াত আগের তুলনায় বেড়েছে। এতে জীবনযাত্রা স্বাভাবিক হয়ে উঠছে। অন্যদিকে গতকাল সকাল থেকেই নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটের নেতৃত্বে সেনাবাহিনীকে বিভিন্ন স্থানে টহল কার্যক্রম পরিচালনা করতে দেখা গেছে। এ ছাড়া শহরের মোড়ে মোড়ে পুলিশের চেকপোস্ট এবং বিজিবির টহল অব্যাহত রয়েছে।

স্বাভাবিক হয়ে আসছে ময়মনসিংহ : ১০ ঘণ্টা কারফিউ শিথিল থাকার পর থেকে স্বাভাবিক হয়ে আসছে ময়মনসিংহের মানুষের জীবনযাত্রা।

গতকাল সকাল ৮টা থেকে সন্ধ্যা ৬টা পর্যন্ত কারফিউ শিথিল থাকায় যানবাহন চলাচল শুরু হয়েছে পুরোদমে। বিভিন্ন জেলা ও উপজেলায় দূরপাল্লার যানবাহন চলাচল করছে। ব্যবসা প্রতিষ্ঠান, দোকানপাট, অফিস-আদালত, ব্যাংক-বিমা খোলা থাকায় মানুষের মাঝে প্রাণচাঞ্চল্য বিরাজ করছে। নগরীর মেছুয়া বাজারসহ অন্যান্য কাঁচাবাজারগুলোতেও ক্রেতাদের ভিড় ছিল চোখে পড়ার মতো। ব্যাংকগুলোতে লেনদেন হওয়ায় মানুষ নগদ টাকা তুলতে পেরে সংকট অনেকটাই কেটে গেছে। তবে কারফিউ শিথিল থাকার পরও নগরীর মোড়ে মোড়ে বিজিবি, র‌্যাব, পুলিশসহ আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর টহল ছিল।

স্বস্তি ফিরেছে সৈয়দপুরে : কারফিউ শিথিল করায় নীলফামারীর সৈয়দপুরে জীবনযাত্রায় ফিরেছে স্বস্তি। সহিংসতা ও কারফিউ জারির কারণে জনজীবনে যে স্থবিরতা সৃষ্টি হয়েছিল তা কাটতে শুরু করেছে। গতকাল সকাল থেকে লোকজন নানা কাজে ঘর থেকে বের হন। শহরের সব মার্কেটের ব্যবসায়ীদের দোকানপাট খুলে বেচাকেনা করতে দেখা যায়। তবে ক্রেতাদের আনাগোনা ছিল কম। ব্যবসায়ীরা আশা করছেন পরিস্থিতি স্বাভাবিক হলে আগের মতো ব্যবসা জমে উঠবে।

এদিকে গত মঙ্গলবার সকাল থেকে বিকাল পর্যন্ত কারফিউ শিথিল করা হয়। কারফিউ শিথিল করায় শহরের পরিস্থিতি আগের তুলনায় স্বাভাবিক হয়েছে। এতে করে ব্যবসা প্রতিষ্ঠান ও দোকান খুলছে। যানবাহন ও লোকজনের আনাগোনা অনেক বেড়েছে। গতকাল সরেজমিনে শহরের প্রধান প্রধান সড়কে অবস্থিত ব্যবসা প্রতিষ্ঠান, সবজি বাজার, মুদি বাজার, মাছ বাজার, চাল মার্কেট, কাপড় মার্কেট, প্লাজা মার্কেট, রেলওয়ে গেট বাজার ও বাস টার্মিনাল ঘুরে দেখা যায়, বেশির ভাগ দোকান খোলা, সব দোকানে ক্রেতাদের পণ্য কিনতে কমবেশি ভিড়। বিশেষ করে কাঁচাবাজার ও মাছের বাজারে ভিড় ছিল বেশি। মুদি বাজারেও ক্রেতাদের আনাগোনা দেখা যায়।

সর্বশেষ খবর