রবিবার, ১১ আগস্ট, ২০২৪ ০০:০০ টা

সংখ্যালঘুদের ওপর হামলার প্রতিবাদে সারা দেশে বিক্ষোভ

প্রতিবাদ জাতিসংঘের সামনেও

নিজস্ব প্রতিবেদক

সংখ্যালঘুদের ওপর হামলার প্রতিবাদে সারা দেশে বিক্ষোভ

চট্টগ্রামে গতকাল বিশাল বিক্ষোভ সমাবেশ -বাংলাদেশ প্রতিদিন

সনাতন ধর্মাবলম্বীদের হত্যা, নির্যাতন এবং ঘরবাড়ি ও ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানে হামলা চালিয়ে ভাঙচুর-লুটপাটের প্রতিবাদে ফের উত্তাল হয়ে উঠছে দেশ। শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর দেশের বিভিন্ন এলাকায় হিন্দু সম্প্রদায়ের বাড়িঘর, ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান ও উপাসনালয়ে হামলার প্রতিবাদে গতকাল ঢাকার শাহবাগ অবরোধ করে দ্বিতীয় দিনের মতো সমাবেশ অনুষ্ঠিত হয়। সেখানে চার দফা দাবি জানান বিক্ষোভকারীরা।

বিকাল ৩টার পর শাহবাগ মোড়ে অবস্থান নেন বিক্ষুব্ধরা। এ সময় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকা থেকে শাহবাগ হয়ে ফার্মগেট, মৎস্য ভবন থেকে শাহবাগ হয়ে এলিফ্যান্ট রোড এবং হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টাল থেকে শাহবাগ হয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়মুখী যানবাহন চলাচল বন্ধ হয়ে যায়। আগের দিন শুক্রবারও প্রায় চার ঘণ্টা শাহবাগ মোড় অবরোধ করে বিক্ষোভ করা হয়েছিল।

বিক্ষোভে অংশগ্রহণকারীরা সংখ্যালঘুদের নিরাপত্তা ও চার দফা দাবি জানান বিভিন্ন প্ল্যাকার্ড-ব্যানার হাতে। ‘এ দেশে জন্ম আমার, দেশটা কোনো ধর্মের না’, ‘আমার ভাই মরল কেন-প্রশাসন জবাব চাই’, ‘উই ওয়ান্ট জাস্টিজ’, ‘বাংলাদেশ কারও বাপের না’সহ বিভিন্ন স্লোগান দিতে থাকেন তারা। বিক্ষোভে অংশ নেওয়া বাংলাদেশ সচেতন সনাতন নাগরিক সংগঠনের বিশ্বনাথ বলেন, ‘হিন্দুদের বাড়িঘর, মন্দির, ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানে হামলা-লুটপাট চালানো হচ্ছে। কয়েকটি স্থানে হত্যাকান্ড হয়েছে। আমরা তো এ দেশেই জন্মেছি, আমরা কোথায় যাবও? ক্ষমতায় যে-ই আসুক আমাদের নিরাপত্তা চাই। আমরা আমাদের বাসস্থান ও ধর্মীয় স্থাপনার নিরাপত্তা চাই।’ নয়ন চৌধুরী নামে এক বিক্ষোভকারী বলেন, ‘প্রতিটি রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে বাংলাদেশের সংখ্যালঘুদের ওপর যেভাবে অত্যাচার-নিপীড়নসহ মন্দির ভাঙচুর করা হয়, এর প্রতিবাদ জানানোর জন্যই আমরা আজ এখানে একত্র হয়েছি।’

সুজন দেবনাথ নামে আরেক বিক্ষোভকারী বলেন, ‘ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের হিন্দু শিক্ষার্থীরা বৈষম্য নিরসনে আন্দোলন করছে, আর শেখ হাসিনার পদত্যাগের পর তার গ্রামের বাড়িতেই লুটপাট চলছে। হিন্দু সম্প্রদায়ের মানুষের বাড়িঘরে অগ্নিসংযোগ করা হয়েছে, তাদের বিভিন্নভাবে নির্যাতন করা হয়েছে।’ বাংলাদেশ গীতা পরিষদ, সনাতন ছাত্রসমাজ, সাউথ এশিয়ান দলিত ফোরাম, বাংলাদেশ চ্যাপ্টারসহ বিভিন্ন সামাজিক ও ছাত্রসহ ধর্মীয় সংগঠন এ সমাবেশে যোগ দেয়। বিক্ষোভ সমাবেশে সংখ্যালঘু মন্ত্রণালয় গঠনসহ চার দফা দাবি তুলে ধরা হয়। এর মধ্যে রয়েছে- সংখ্যালঘু মন্ত্রণালয় গঠন, সংখ্যালঘু সুরক্ষা কমিশন গঠন, সংখ্যালঘুদের বিরুদ্ধে সংঘটিত সব হামলা প্রতিরোধে কঠোর আইন প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন এবং সংখ্যালঘুদের জন্য ১০ শতাংশ সংসদীয় আসন বরাদ্দ।

চট্টগ্রাম : সারা দেশে সংখ্যালঘুদের বাড়িঘর, মঠমন্দিরে অব্যাহত হামলা ও সর্বোপরি সাম্প্রদায়িক বৈষম্য ও নির্যাতনের প্রতিবাদে চট্টগ্রামে নজিরবিহীন বিক্ষোভ করেছে সনাতন সম্প্রদায়ের লোকজন। গতকাল চট্টগ্রামের চেরাগী পাহাড়কে কেন্দ্র করে জামালখান, আন্দরকিল্লা, ডিসি হিল পর্যন্ত এ বিক্ষোভ বিস্তৃত হয়। বিক্ষোভে ৫০ হাজারের বেশি মানুষের সমাগম হয়েছে বলে দাবি করেছেন অংশগ্রহণকারীরা। দেশে চলমান পরিস্থিতিতে সনাতন সম্প্রদায়ের ওপর বর্বরোচিত হামলা, নির্যাতন, মঠমন্দির, ঘরবাড়ি ভাঙচুর, অগ্নিসংযোগ ও জায়গাজমি দখলসহ সব অত্যাচারের বিরুদ্ধে বাংলাদেশ হিন্দু জাগরণ মঞ্চের উদ্যোগে এ বিক্ষোভের ডাক দেওয়া হয়। বিক্ষোভে হিন্দু সম্প্রদায়ের বিভিন্ন সংগঠন ছাড়াও প্রগতিশীল সংগঠন, সাংস্কৃতিক কর্মীসহ অনেক সাধারণ মানুষের অংশগ্রহণ ছিল চোখে পড়ার মতো।

বিক্ষোভ কেন্দ্র করে গতকাল বিকাল ৩টা থেকে সনাতন সম্প্রদায়ের নাগরিক দলে দলে চেরাগী পাহাড় মোড়ে জড়ো হতে থাকে। সময় বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে লোকারণ্য হয়ে ওঠে বিক্ষোভস্থল। চেরাগী পাহাড় কেন্দ্র করে উপস্থিত বিক্ষোভকারীদের সমাগম আশপাশের ১ কিলোমিটার এলাকায় ছড়িয়ে পড়ে। মুহুর্মুহু স্লোগানে উত্তাল হয়ে ওঠে পুরো এলাকা। ব্যানার, পোস্টার, ফেস্টুন, প্ল্যাকার্ড নিয়ে স্লোগান দিতে থাকেন বিক্ষোভকারীরা।

বিক্ষোভকারীরা ‘আমার মাটি আমার মা-স্বদেশ ছেড়ে যাব না, দেশটা কারও একার না-দেশ ছেড়ে যাব না, তুমি কে আমি কে-বাঙালি বাঙালি, জেগেছে রে জেগেছে-সনাতন জেগেছে, একাত্তরের হাতিয়ার-গর্জে উঠুক আরেকবার, আমার দেশ তোমার দেশ-বাংলাদেশ বাংলাদেশ, প্রীতিলতার চট্টগ্রাম-গর্জে উঠুক আরেকবার, সূর্যসেনের চট্টগ্রাম-গর্জে উঠুক আরেকবার’সহ বিভিন্ন স্লোগান দিতে থাকেন। এ সময় প্ল্যাকার্ডে ‘মুগ্ধ কই, মন্দিরে আগুন লেগেছে, পানি লাগবে, গণমাধ্যম হিন্দুদের ওপর হামলার খবর কেন চেপে যাচ্ছে, স্টপ টার্গেটিং হিন্দুজ, উই ওয়ান্ট সেফটি, দেশ যদি স্বাধীন হয়-আমার মন্দির পুড়ল কেন’সহ বিভিন্ন প্রশ্ন তোলেন বিক্ষোভে অংশ নেওয়া হাজারো হিন্দু।

বিক্ষোভকারীদের মধ্যে প্রকৌশলী সৌমেন দাশ বলেন, ‘যতবারই বাংলাদেশে সরকার পরিবর্তন হয়, ততবারই হিন্দুদের বাড়িঘর, মন্দিরে হামলা হয়। হামলার পরবর্তী সময়ে অনেকেই দেশ ছেড়ে ভারত ও অন্যান্য দেশে আশ্রয় নিতে বাধ্য হন। অথচ মুক্তিযুদ্ধ থেকে শুরু করে সব প্রগতিশীল আন্দোলনে আমাদের অংশগ্রহণ ছিল। এ দেশটা সবার হওয়ার কথা। কিন্তু বারবার এ ধরনের হামলা, নির্যাতন কী বার্তা দেয়?’

রুবেল দাশগুপ্ত নামে একজন ব্যবসায়ী বলেন ‘বলা হচ্ছে দেশ স্বাধীন হয়েছে। দেশ যদি স্বাধীন হয়, তাহলে হিন্দুদের দোষ কী? হিন্দু শিক্ষার্থীরা কি আন্দোলনে ছিল না? তাদের কি কোনো অবদান নেই? আর যদি অবদান না-ও থাকে, এ দেশ তো কেবল আন্দোলনের পক্ষের লোকের না। যারা নিরপেক্ষ, এমনকি যারা বিপক্ষের-এ দেশ তো তাদেরও।’ সদরঘাট পূজা উদ্যাপন পরিষদের সভাপতি রাজীব নন্দী বাবু বলেন, ‘তিন-চার দিন ধরে প্রশাসন নেই, পুলিশ নেই। যার যা খুশি তা করছে। বাড়িঘর, মন্দির, ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান কিছুই হামলা থেকে বাদ যাচ্ছে না। ছাত্ররা করছে না, বিএনপি করছে না, জামায়াত করছে না। তাহলে করছেটা কে? এর দায় কে নেবে? এর বিচার কে করবে? আমরা অবিলম্বে সব সাম্প্রদায়িক হামলা, নির্যাতনের সঙ্গে জড়িতদের বিচার দাবি করছি। একই সঙ্গে হামলা বন্ধে কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণের দাবি জানাচ্ছি।’

রাজশাহী : রাজশাহীতে বিক্ষোভ মিছিল ও সমাবেশ করেছেন সনাতন ধর্মাবলম্বীরা। গতকাল বিকালে নগরীর ধর্মসভা থেকে বিক্ষোভ মিছিলটি বের হয়। এরপর বিভিন্ন সড়ক ঘুরে গণকপাড়া মন্ডপে গিয়ে শেষ হয়। সমাবেশে সনাতন ধর্মাবলম্বীরা বলেন, আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর পরই বিভিন্ন বাড়িঘরে হামলা ও লুটপাট ঘটছে। সনাতন ধর্মাবলম্বীদের বাড়িতে হামলা চালিয়ে লুটপাট ও ভাঙচুর করা হচ্ছে। বাড়িতে না থাকতে হুমকি দেওয়া হচ্ছে। ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানও বাদ যায়নি হামলা থেকে। কোনো প্রতিকার না পেয়ে তারা মাঠে নেমেছেন। সমাবেশে বক্তব্য দেন প্রশান্ত দেবনাথ, দেবাশিস সাহা, স্বপন কুমার রায়, রতন সরকার, সনৎ সাহা প্রমুখ।

বরিশাল : দেশজুড়ে লুটপাট, অগ্নিসংযোগ, শিল্পীদের ওপর হামলা ও সংখ্যালঘুদের ওপর নিপীড়নের প্রতিবাদে সমাবেশ হয়েছে। গতকাল দুপু?রে নিপীড়নবিরোধী মঞ্চ বরিশালের ব্যানারে নগরীর সদর রোডে অশ্বিনী কুমার হলের সামনে সমাবেশ হয়। এতে বিভিন্ন মন্দির ক?মি?টির সদস?্যসহ নানা শ্রেণি-পেশার মানুষ অংশ নেয়। সমাবেশের এক পর্যায়ে সড়ক অবরোধ করে স্লোগান দেন অংশগ্রহণকারীরা। সভাপতিত্ব করেন নিপীড়নবিরোধী মঞ্চ বরিশালের সমন্বয়ক কাজল দাস। উপস্থিত ছিলেন পূজা উদ্যাপন পরিষদ বরিশাল মহানগর সভাপতি ভানুলাল দে, সহসভাপতি বিশ্ব?জিৎ ঘোষ বিশু, বাংলাদেশের সমাজতান্ত্রিক দল (বাসদ) বরিশাল জেলা শাখার সমন্বয়ক ডা. মনীষা চক্রবর্তী, কমিউনিস্ট পার্টি ব?রিশ?াল জেলা সভাপতি এ কে আজাদ, বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের চেয়ারম্যান উন্মেষ রায় প্রমুখ।

বক্তারা বলেন, সরকার পতনের পর থেকে সারা দেশের মতো ব?রিশা?লেও হিন্দুু সম্প্রদায়ের ওপর হামলা হচ্ছে। তাদের ঘরবাড়ি ভাঙচুর হচ্ছে। ম?ন্দির ভাঙচুর হ?চ্ছে, ধর্ষণ করা হ?য়ে?ছে হিন্দু মে?য়ে?দের। সমাবেশ থেকে তারা অন্তর্বর্তী সরকারের কাছে যারা এ ধরনের কাজে জড়িত তাদের বিচার দাবি করেন। সমাবেশ শেষে একটি মিছিল নগরীর প্রধান প্রধান সড়ক প্রদক্ষিণ করে পুনরায় অশ্বিনী কুমার হলে গিয়ে শেষ হয়।

কুষ্টিয়া : ‘আমার মাটি আমার মা, দেশ ছেড়ে যাব না’, ‘বদলা নয়, বদল চাই’; এই বাংলায় শান্তি চাই’ স্লোগানে কুষ্টিয়ায় সংখ্যালঘুদের জন্য মিছিল-সমাবেশ করেছেন শিক্ষার্থীরা। গতকাল বিকাল ৫টার দিকে মিছিলটি কুষ্টিয়া শহরের গোপীনাথ জিউর মন্দির থেকে শুরু হয়ে পৌরসভার বিজয় উল্লাসে পৌঁছায়। পরে সেখানে একটি সংক্ষিপ্ত সমাবেশ করেন সব ধর্মবর্ণের মানুষ।

সমাবেশে বক্তারা বলেন, আমরা বাঙালি ও বাংলাদেশি। আমরা বাংলাদেশি হয়ে কীভাবে অন্য বাঙালির গায়ে আঘাত করি? ঘরে ঘরে দুর্গ গড়ে না তুলে, আত্মা দিয়ে আত্মীয়তা গড়ে তুলুন।

‘আমার মাটি আমার মা, দেশ ছেড়ে যাব না’, ‘বদলা নয়, বদল চাই; এই বাংলায় শান্তি চাই’ স্লোগানে মুখরিত হয়ে ওঠে পৌরসভা চত্বর। সমাবেশে অংশ নেওয়া গণেশ বলেন, কিছু দুষ্কৃতকারী হিন্দুদের বাড়িঘর দখল ও সুন্দরী মেয়েদের ধর্ষণের লালসা চরিতার্থ করার পরিকল্পনা করছে। তারই প্রতিবাদে আজকের এই সমাবেশ। সমাবেশে সব ধর্মের মানুষ অংশ নিয়ে হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের পাশে থাকার প্রত্যয় ব্যক্ত করা হয়।

দিনাজপুর : দিনাজপুরে মানববন্ধন ও গণঅবস্থান কর্মসূচি ও প্রধান প্রধান সড়কে বিক্ষোভ প্রদর্শন করেন সনাতন ধর্মাবলম্বীরা। সেখানে তারা চার দফা দাবি জানান। দাবিগুলো হলো- সংখ্যালঘু মন্ত্রণালয়, সংখ্যালঘুদের সুরক্ষা কমিশন গঠন, সংখ্যালঘুদের বিরুদ্ধে সংঘটিত সব ধরনের হামলা প্রতিরোধে কঠোর আইন প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন, সংখ্যালঘুদের জন্য ১০ শতাংশ সংসদীয় আসন বরাদ্দ। গতকাল দাবি আদায়ের লক্ষ্যে দিনাজপুরে বাংলাদেশ সচেতন সনাতনী নাগরিকদের আয়োজনে দিনাজপুর প্রেস ক্লাবের সম্মুখ সড়কে মানববন্ধন ও গণঅবস্থান কর্মসূচি পালন করা হয়। পরে একটি মিছিল শহরের প্রধান প্রধান সড়কে বিক্ষোভ প্রদর্শন শেষে প্রেস ক্লাবের সামনে গিয়ে শেষ হয়। ‘বৈষম্যমুক্ত বাংলাদেশ, স্বস্তিতে বাঁচতে চাই’- এই স্লোগানকে সামনে রেখে সনাতনী ধর্মীয় সম্প্রদায়ের জনগণের পক্ষে বক্তব্য রাখেন সুনীল চক্রবর্তী, উত্তম কুমার রায়, রতন সিং, ডা. ডিসি রায়, আহম্মেদ শফি রুবেল, কবি জলিল আহম্মেদ, নিখিল চন্দ্র রায়, রণজিৎ কুমার সিংহ, সত্য ঘোষ, সনদ চক্রবর্তী লিটু, প্রফেসর ড. বিকাশ, তপু রায়, মিনতি দাস, মল্লিকা দাস, জয়ন্ত মিশ্র, সঞ্জিত কুমার রায়, গৌরাঙ্গ রায়সহ বিভিন্ন উপজেলা, ইউনিয়ন, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান থেকে ছাত্র-ছাত্রীসহ স্থানীয় সনাতনী সম্প্রদায়ের নেতা-কর্মীরা।

বক্তারা বলেন, বাংলাদেশের সনাতনী হিন্দু সম্প্রদায় ঘোষণা দেওয়ায় চার দফা দাবি বাস্তবায়নের লক্ষ্যে আমরা রাজপথে নেমেছি। যতক্ষণ পর্যন্ত সরকার সংখ্যালঘুদের নিরাপত্তা নিশ্চিত না করছে তত দিন পর্যন্ত আমরা রাজপথ ছাড়ব না।

নীলফামারী : দেশের বিভিন্ন স্থানে বাড়িঘর ও মন্দিরে হামলা ভাঙচুর অগ্নিসংযোগ এবং সাম্প্রদায়িক আক্রমণকারীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির দাবিতে নীলফামারীতে বিক্ষোভ মিছিল ও মানববন্ধন অনুষ্ঠিত হয়েছে। গতকাল দুপুরে শহরের শিবমন্দির থেকে বের হয়ে বিক্ষোভ মিছিলটি ডালপট্টি থেকে ঘুরে চৌরঙ্গী মোড়ে ফিরে মানববন্ধনে মিলিত হয়। বাংলাদেশ জাতীয় হিন্দু মহাজোটের ব্যানারে এই কর্মসূচি পালিত হয়। নীলফামারীর সংগলশী ইউনিয়নের সাবেক চেয়ারম্যান টিকেন্দ্রজিৎ রায় মিরু বলেন, আমরা এই দেশেরই নাগরিক। আমাদের ওপর হামলা হবে কেন? বাড়িঘরে হামলা অগ্নিসংযোগ হবে কেন? মন্দিরে হামলা কেন? বাংলাদেশ অসাম্প্রদায়িক দেশ। এখানে আমরা একে অন্যের পরিপূরক।

বাংলাদেশ হিন্দু মহাজোটের জেলা সভাপতি জুয়েল রায় বলেন, শেখ হাসিনার সরকার পতনের পরপরই দেশের বিভিন্ন স্থানে হিন্দুদের বাড়িঘর ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগ শুরু করে দুর্বৃত্তরা। নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছে সনাতন ধর্মাবলম্বীরা। অনেকে বাড়ি ছেড়ে পালিয়ে গেছেন। আমরা এই আতঙ্ক থেকে মুক্তি চাই এবং এই ঘটনার সঙ্গে জড়িতদের আইনের আওতায় এনে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি চাই। বাংলাদেশ হিন্দু মহাজোটের জেলা সভাপতি জুয়েল রায়ের সভাপতিত্বে ও সাধারণ সম্পাদক বিপুল রায়ের সঞ্চালনায় মানববন্ধন সমাবেশে সাংগঠনিক সম্পাদক সঞ্জয় কুমার সাহা, বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সমন্বয়ক বর্ষা রায়, আলিফ সিদ্দিকী প্রান্ত, মাহমুদ হাসান ও অরন্দিম রায় নির্লয় বক্তব্য রাখেন। এতে বিভিন্ন সংগঠন অংশগ্রহণ করে।

ঠাকুরগাঁও : জেলার রাণীশংকৈল উপজেলায় বিক্ষোভ করেছে ছাত্রসহ বিভিন্ন হিন্দু সম্প্রদায়ের কয়েক হাজার নাগরিক। বিভিন্ন স্থানে হিন্দুদের বাড়িঘর মন্দির ভাঙচুর, অগ্নিসংযোগ ও লুটপাটের প্রতিবাদে এই বিক্ষোভ কর্মসূচি পালন করা হয়। হিন্দুদের ওপর নিপীড়ন বন্ধের দ্রুত ব্যবস্থা না নিলে নাগরিক আন্দোলন কর্মসূচি ঘোষণার হুঁশিয়ারি দিয়েছেন বিক্ষোভকারীরা।

গতকাল পৌর শহরের ডিগ্রি কলেজ মাঠে জমায়েত হন ১০-১৫ হাজার হিন্দু সম্প্রদায়ের মানুষ। পরে শহরের প্রধান প্রধান সড়ক প্রদক্ষিণ করে বিভিন্ন ব্যানার-ফেস্টুন নিয়ে একটি বিক্ষোভ মিছিল বের করা হয়। শেষে বক্তব্য রাখেন উপজেলা নির্বাহী কমকর্তা রাকিবুল হাসান, সহকারী পুলিশ সুপার সার্কেল ফারুক হোসেন, ক্যাপ্টেন মুহতাশিন, হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদের সভাপতি প্রাণগোবিন্দ সাহা বাচ্চু, পূজা উদযাপন পরিষদের সভাপতি ছবি কান্ত দেব, সাধারণ সম্পাদক সাধন কুমার বসাক প্রমুখ। এ সময় সাধন কুমার বসাক বলেন, বাংলাদেশের বিভিন্ন স্থানে মন্দির, প্রতিমা, হিন্দুদের বাড়িঘর, ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানে ভাঙচুর, লুটপাট ও অগ্নিসংযোগ করা হয়। বিভিন্ন জায়গায় হিন্দু মা-বোনদের ধর্ষণ করা হয়। দেশত্যাগের হুমকি দেওয়া হয়। রাতের আঁধারে পিটিয়ে ও শ্বাসরোধে হত্যা করা হয়। বিগত দিনে হওয়া হিন্দু নির্যাতনের কোনো বিচার না হওয়ায় নির্দ্বিধায় এই নারকীয় কর্মকান্ড চলছে। এর বিরুদ্ধে দ্রুত ব্যবস্থা নিতে হবে। ছবি কান্ত দেব বলেন, প্রতিটি রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে বাংলাদেশের সংখ্যালঘুদের ওপর যেভাবে অত্যাচার-নিপীড়নসহ মন্দির ভাঙচুর করা হয়, এটার প্রতিবাদ জানানোর জন্যই আমরা আজকে এখানে একত্রিত হয়েছি। বিভিন্ন স্থানে মন্দির, প্রতিমা, হিন্দুদের বাড়িঘর, ব্যবসা প্রতিষ্ঠান ভাঙচুর, লুটপাট ও অগ্নিসংযোগের অভিযোগ করেন তিনি।

লক্ষ্মীপুর : জেলায় মানববন্ধন ও বিক্ষোভ কর্মসূচি পালন করছেন হিন্দু সম্প্রদায়। এ সময় নিরাপত্তার দাবিতে বিভিন্ন স্লোগান দিতে থাকেন তারা। গতকাল বিকালে শহরের প্রেস ক্লাবের সামনে ঘণ্টাব্যাপী এই কর্মসূচি পালন করা হয়। পরে বিক্ষোভ মিছিল বের হয়ে বাজারের প্রধান সড়ক প্রদক্ষিণ করে। এ সময় আন্দোলনকারীরা সংখ্যালঘু মন্ত্রণালয়, সংখ্যালঘু সুরক্ষা কমিশন, সংখ্যালঘুদের বিরুদ্ধে সংঘটিত সব ধরনের হামলা প্রতিরোধে কঠোর আইন প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন এবং তাদের জন্য ১০ শতাংশ সংসদীয় আসন বরাদ্দের দাবি জানান।

সমাবেশে উপস্থিত ছিলেন শহর জামায়াতের আমির আবুল ফারাহ্ নিশান, জেলা হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদের সভাপতি শংকর মজুমদার, সাধারণ সম্পাদক মিলন মন্ডল, জেলা পূজা উদযাপন পরিষদের সভাপতি স্বপন দেবনাথ, বাংলাদেশ যুব ঐক্য পরিষদের কেন্দ্রীয় কমিটির সভাপতি শিমুল সাহা, জেলা যুব ঐক্য পরিষদের সভাপতি রাজ বিজয় চক্রবর্তী, সাধারণ সম্পাদক ঝুটন কুরীসহ অন্যরা।

এ সময় বক্তারা বলেন, জন্মসূত্রে এই দেশ আমাদের সবার। এখানে আমাদের নিরাপত্তা চাই। দেশে যে সরকারই ক্ষমতায় আসুক আমাদের সমস্যা নেই। কিন্তু আমাদের বাসস্থান ও ধর্মীয় স্থাপনার নিরাপত্তা চাই।

হিন্দু নির্যাতন বন্ধের দাবিতে জাতিসংঘের সামনে বিক্ষোভ : নিউইয়র্কে জাতিসংঘ সদর দপ্তরের অদূরে হামার্সজন্ট পার্কে শুক্রবার অনুষ্ঠিত বিক্ষোভ সমাবেশে বক্তারা হিন্দুদের ওপর নির্যাতন বন্ধ করতে বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকারকে ৪৮ ঘণ্টার আল্টিমেটাম দিয়েছেন। সমাবেশের আয়োজক ইউনাইটেড হিন্দুজ অব ইউএসএ। সমাবেশে অংশগ্রহণকারীরা আমার ভাই মরল কেন-জবাব চাই, সংখ্যালঘুদের হত্যা কেন-জবাব চাই জবাব চাই, জাগো জাগো বাঙালি জাগো, জাগো জাগো হিন্দু জাগো, আমার বাড়ি জ্বলল কেন-সেনাপতি জবাব চাই, আমার মন্দির জ্বলল কেন-জবাব চাই জবাব চাই, তোমার আমার ঠিকানা-পদ্মা মেঘনা পদ্মা, উই ওয়ান্ট জাস্টিস ইত্যাদি স্লোগানে সমাবেশস্থল প্রকম্পিত হয়। বক্তারা বলেন, তাঁদের দাবি পূরণ না করলে নিউইয়র্কে শুরু হওয়া এ আন্দোলন ছড়িয়ে দেওয়া হবে সারা বিশ্বে। ইউনাইটেড হিন্দুজ অব ইউএসএ তাদের দাবির বিষয়ে জাতিসংঘ মহাসচিবের কাছে স্মারকলিপিও দিয়েছে। স্মারকলিপিতে বলা হয়, শেখ হাসিনা পদত্যাগের পর দেশ ছাড়ার সঙ্গে সঙ্গে সুপরিকল্পিতভাবে সারা বাংলাদেশে হিন্দু সম্প্রদায়ের ওপর আক্রমণ শুরু হয়েছে। আগুন দেওয়া হয় ব্যবসা-বাড়িঘরে। ভেঙে চুরমার করা হয়েছে মন্দির। তরুণী-নারীর সম্ভ্রমহানির পর অনেককে হত্যা এবং মোটা অঙ্কের চাঁদা না দেওয়ায় অনেক হিন্দুকে অকথ্য নির্যাতনের পর পুড়িয়ে মারা হয়েছে।

বিক্ষোভকারীরা যেসব প্ল্যাকার্ড বহন করেন তাতে লেখা ‘সেভ হিন্দুজ ইন বাংলাদেশ’, ‘বাংলাদেশে হিন্দু নির্যাতন বন্ধ করুন’, ‘সেভ হিন্দু টেম্পল’, ‘উই নিড জাস্টিস’, ‘স্টপ রেপস অ্যান্ড সেক্সুয়াল ভায়োলেন্স অ্যাগেইনস্ট হিন্দু উইমেন’, ‘স্টপ হিন্দু জেনোসাইড’ ইত্যাদি।

ইউনাইটেড হিন্দুজ অব ইউএসএর সেক্রেটারি রামদাস ঘরামির সঞ্চালনায় সংগঠনের সভাপতি ভজন সরকার বলেন, ‘বাংলাদেশে সরকার পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিধারণকারী সব স্থাপনা ভেঙে ফেলা হয়েছে। পাশাপাশি চলছে হিন্দুদের ওপর আক্রমণ।’ তিনি বলেন, ‘আমরা হিন্দুরা কী অপরাধ করলাম! বারবার সরকার পরিবর্তন হয়, নির্বাচন আসে, পূজা আসে আর হিন্দুদের ওপর হামলা হয়। পূজাপার্বণের সময়ও হিন্দুরা আক্রান্ত হয়। এ সমস্যার একটা স্থায়ী সমাধান চাই।’ এজন্য তিনি পাঁচ-দশটি জেলার সমন্বয়ে হিন্দুদের বাস করার জন্য সুরক্ষিত একটি এলাকা গঠনের প্রস্তাব করেন।

সংগঠনের চেয়ারম্যান ডা. প্রভাত সরকার, মানবাধিকার সংগঠক ও লেখক শিতাংশু গুহ, মূলধারার রাজনীতিক (ডেমোক্র্যাট) ড. দীলিপ নাথ, ঐক্য পরিষদের নেতা অধ্যাপক ড. দ্বীজের ভট্টাচার্য, সুশীল সাহা, সুশীল সিনহা তাঁদের বক্তৃতায় অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. ইউনূসের কাছে অবিলম্বে হিন্দু নির্যাতনকারীদের গ্রেপ্তার ও দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির দাবি জানান।

জাতিসংঘের সামনে সমাবেশ শেষে সবাই মিছিল করে টাইমস স্কোয়ারে যায়। সেখানকার সমাবেশ পরিচালনা করেন নতুন প্রজন্মের সদস্যরা। সেখানে জানানো হয়, ১১ আগস্ট রবিবার বিকাল ৫টায় নিউইয়র্ক সিটির জ্যাকসন হাইটসে ডাইভারসিটি প্লাজায় বাংলাদেশে হিন্দু নির্যাতনের প্রতিবাদে সমাবেশ হবে ‘হিন্দু কোয়ালিশন ইউএসএ’র উদ্যোগে। নিউইয়র্ক সিটির ইউনিয়ন স্কোয়ারে বড় ধরনের আরেকটি সমাবেশ হবে ১৭ আগস্ট বিকাল ৫টায়।

কোটালীপাড়ায় শপথ : শেখ হাসিনাকে দেশে ফিরিয়ে আনতে কোটালিপাড়ায় গতকাল মানুষ কাফনের কাপড় পড়ে সমাবেশ করেছেন। এই সমাবেশ থেকে তারা শপথ নিয়েছেন, যে কোনো মূল্যে শেখ হাসিনাকে দেশে ফিরিয়ে আনা হবে।

সর্বশেষ খবর