বুধবার, ১৪ আগস্ট, ২০২৪ ০০:০০ টা

ব্যাংকে চলছে অস্থিরতা

♦ আমানতকারীরা ভীত ♦ শৃঙ্খলা নিয়ে উৎকণ্ঠা বিনিয়োগকারীদের

নিজস্ব প্রতিবেদক

ব্যাংকে চলছে অস্থিরতা

সরকার পতনের পর ব্যাংকগুলোয় আন্দোলন, বিক্ষোভ, গোলাগুলির কারণে দেশের ব্যাংক খাতে নতুন অস্থিরতা তৈরি হয়েছে। এতে আমানতকারীরা ভীত। শৃঙ্খলা নিয়ে উৎকণ্ঠায় বিনিয়োগকারীরা। পরিস্থিতি মোকাবিলায় বাংলাদেশ ব্যাংকের সুশাসন নিশ্চিত করা ও তফসিলি ব্যাংকগুলোকে সঠিক সিদ্ধান্ত নেওয়ার পরামর্শ দিয়েছেন ব্যবসায়ীরা। ব্যাংকের মালিকানা পরিবর্তন, চাকরিচ্যুত কর্মকর্তাদের পুনরায় নিয়োগসহ বিভিন্ন দাবিতে চলমান এ আন্দোলন নিয়ে দুশ্চিন্তায় পড়েছেন আমানতকারীরা। অনেকেই ব্যাংক থেকে টাকা তুলে নিচ্ছেন। এটিএম বুথে টাকা না পাওয়া, চেকের মাধ্যমে ২ লাখ টাকার বেশি উত্তোলনে নিষেধাজ্ঞায় বিপাকে পড়েছেন ব্যবসায়ীরা। পরিস্থিতির দ্রুত উন্নতি না হলে সংকট বাড়ার আশঙ্কা করছেন সংশ্লিষ্টরা। সরকার পতনের পর থেকেই মালিকানা বদল ও পদবঞ্চিতদের দাবি আদায়ে আন্দোলন শুরু হয়েছে বেশ কয়েকটি ব্যাংকে। ইসলামী ব্যাংকের কর্মকর্তাদের দুই গ্রুপের মধ্যে সংঘর্ষ ঘটেছে। গত রবিবার ব্যাংকটির প্রধান কার্যালয়ের সামনে এ ঘটনায় অন্তত ছয়জন গুলিবিদ্ধ হন। সরকার পতনের পর থেকে ইসলামী ব্যাংকের কর্মকর্তারা ব্যাংকটির পর্ষদ পুনর্গঠনের মাধ্যমে ব্যাংক থেকে ‘লুটেরাদের’ বের করে দেওয়ার দাবি জানান। সোমবারও প্রধান কার্যালয়ের সামনে বিক্ষোভ সমাবেশ করেছেন ব্যাংকটির পুরনো কর্মীরা। ফলে ব্যাংকটিতে ২০১৭ সালের পর নিয়োগ পাওয়া কর্মকর্তারা কেউ প্রবেশ করতে পারেননি। পাশাপাশি তারা রবিবারের গুলির ঘটনার বিচার দাবি করেছেন। সোস্যাল ইসলামী ব্যাংকের প্রধান কার্যালয়ের সামনে মহড়া দিয়েছে একদল অস্ত্রধারী লোক। এতে আতঙ্কে সময় পার করছেন কর্মী ও ব্যাংকের গ্রাহকরা। আইএফআইসি ব্যাংকের চেয়ারম্যান সালমান এফ রহমান ও তার ছেলেসহ বেক্সিমকোর সব পরিচালকের পদত্যাগের দাবিতে বিক্ষোভ করেছেন ব্যাংকটির বর্তমান ও চাকরিচ্যুত কর্মকর্তা-কর্মচারীরা। ইউসিবির বর্তমান পর্ষদের বিরুদ্ধেও মানববন্ধন করেন শেয়ারহোল্ডারদের একটি অংশ। বেসরকারি খাতের ওয়ান, বাংলাদেশ কমার্সসহ কয়েকটি ব্যাংকে বিক্ষোভ হয়। সুযোগসুবিধা ও বিভিন্ন দাবিতে রাষ্ট্রীয় মালিকানার ব্যাংকেও বিক্ষোভ হয়েছে। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, ব্যাংকের মতো একটি স্পর্শকাতর প্রতিষ্ঠানে আন্দোলন-গোলাগুলি কোনোভাবেই কাম্য নয়। যৌক্তিক দাবিদাওয়া ব্যাংকের প্রচলিত নিয়ম মেনে দ্রুত সমাধান করা উচিত। না হলে আমানতকারীরা ব্যাংকের প্রতি আস্থা হারালে সংকট আরও দীর্ঘায়িত হবে। বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান পলিসি এক্সচেঞ্জের চেয়ারম্যান মাশরুর রিয়াজ বলেন, ‘ব্যাংকে বিক্ষোভ-বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি হচ্ছে। গত কয়েক বছরে কোনো কোনো ব্যাংকের একটি পক্ষ অন্য সব ব্যাংকের শেয়ারহোল্ডারদের কোণঠাসা করে একচ্ছত্র আধিপত্য বিস্তার করে ছিল। সেটার কারণে অনেক অনিয়মও হয়েছে। এ ধরনের ঘটনা যেখানে হয়েছে সেসব জায়গায় বিক্ষোভ হবে এটাই স্বাভাবিক। তবে বিক্ষোভ ব্যাংকের দরজায় না করে আলোচনার টেবিলে হওয়া উচিত। সেটা হতে হবে একটা নিয়মতান্ত্রিক পদ্ধতিতে। কর্মীদের অভিযোগ জানানোর একটা সঠিক প্ল্যাটফরম দিতে হবে। যারা বিক্ষোভ করছেন, ক্ষোভ প্রকাশ করছেন তাদের হয়তো ইস্যুগুলো যৌক্তিক। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের নেতৃত্বেও এ আলোচনাগুলো শুরু করে ব্যবস্থাপনা ও পর্ষদে পরিবর্তন আনা দরকার।’

২ লাখ টাকার বেশি তোলা যাবে না এমন নির্দেশনায় নগদ টাকার অভাবে দেশের ব্যবসায়ীরা এক ধরনের সংকটে পড়েছেন। গত শনিবার কেন্দ্রীয় ব্যাংক তফসিলি ব্যাংকগুলোকে জানিয়েছে, প্রতিটি অ্যাকাউন্ট থেকে দৈনিক ২ লাখ টাকার বেশি তোলা যাবে না। এ পরিমাণ বাড়ানোর আগে কেন্দ্রীয় ব্যাংক বৃহস্পতিবার দৈনিক নগদ ১ লাখ টাকা তোলায় সীমিত করেছিল। ব্যবসায়ীরা বলছেন, যদি নগদ টাকার সংকট বাড়তে থাকে এবং আগামী সপ্তাহেও বিধিনিষেধ চলতে থাকে তবে তারা আরও কঠিন পরিস্থিতিতে পড়বেন।

ব্যাংক থেকে টাকা তোলার ক্ষেত্রে সীমা আরোপ করা হয়েছে (২ লাখ) এবং সেই সঙ্গে এটিএম বুথে টাকা পাওয়া যাচ্ছে না। এর ফলে মানুষ বিপাকে পড়েছে। এ পরিস্থিতি কত দিন চলবে-সাংবাদিকদের এমন প্রশ্নের জবাবে অর্থ ও পরিকল্পনা উপদেষ্টা সালেহউদ্দিন আহমেদ বলেন, ‘টাকা নেই, তা নয়। এটা করা হয়েছে নিরাপত্তাহীনতার কারণে। বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে ব্যাংকাররা প্রতিদিন বড় ট্রাংকে করে টাকা নিয়ে যান। কিন্তু এখন রাস্তা দিয়ে সেই টাকা পরিবহন করা বিপজ্জনক। এটিএম বুথেও হামলা হয়েছে, সেজন্য শঙ্কা ছিল। অর্থসচিব বিষয়টি দ্রুততার সঙ্গে দেখবেন।’ ইসলামী ব্যাংকের দখল নিয়ে সংঘাত ও গোলাগুলিতে যারা জড়িত, তাদের শিগগির আইনের আওতায় আনা হবে বলে জানিয়েছেন অর্থ উপদেষ্টা সালেহউদ্দিন আহমেদ। তিনি বলেন, ‘কেউ আইনের বাইরে নয়। জড়িতদের বিরুদ্ধে দ্রুত ব্যবস্থা নেওয়া হবে। আমি নিজেও এককালে ম্যাজিস্ট্রেট ছিলাম। এসব ধরপাকড় কম করিনি।’

 

ব্যাংকের বাইরে ২ লাখ ৬১ হাজার ১৯৫ কোটি টাকা

এদিকে ব্যাংক খাতের অস্থিরতায় মানুষের হাতে নগদ অর্থের পরিমাণ বেড়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের সর্বশেষ প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২০২৪ সালের মার্চ শেষে ব্যাংক খাতের বাইরে বা মানুষের হাতে নগদ অর্থের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ২ লাখ ৬১ হাজার ১৯৫ কোটি টাকায়। কিন্তু এক মাস আগেও এর পরিমাণ ছিল ২ লাখ ৫৭ হাজার ৫৭৪ কোটি টাকা, ২০২৩ সালের মার্চে যা ছিল ২ লাখ ৫৪ হাজার ৬৬৮ কোটি। ব্যাংক খাত সংশ্লিষ্টরা বলছেন, সাধারণ আমানতকারীরা ব্যাংক থেকে টাকা তুললেও ব্যাংকে নতুন করে তেমন জমা দিচ্ছেন না। এতে ক্রমে বাড়ছে ব্যাংকবহির্ভূত টাকার পরিমাণ। অন্যদিকে আমানত প্রবৃদ্ধিতে নেতিবাচক চিত্র দেখা যাচ্ছে। বেসরকারি ব্যাংক নির্বাহীদের সংগঠন অ্যাসোসিয়েশন অব ব্যাংকার্স বাংলাদেশের (এবিবি) সাবেক চেয়ারম্যান মোহাম্মদ নুরুল আমিন বলেন, ‘ব্যাংক খাতে যে সংকট তৈরি হয়েছে তা নিরসনে আর দেরি করা উচিত হবে না। যে ব্যাংকগুলোয় সংকট চলছে সেগুলো শুরুর সময় ভালো প্রতিষ্ঠান ছিল। মালিকানা বদলের পর এগুলোকে খারাপ করা হয়েছে। এখানে পরিবর্তন আনতে হলে ম্যানেজমেন্টে পরিবর্তন আনতে হবে। বোর্ডের কাঠামোও পরিবর্তন করতে হবে। যদি কোনো ব্যাংকে বোর্ড পরিবর্তন করা না যায় তাহলে কার্যপরিধি সীমিত করতে হবে। গোলাগুলির কারণ বের করে সঙ্গে সঙ্গে থামানোর ব্যবস্থা নিতে হবে, বিতর্কিতদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে হবে। সুশাসনের অভাব, খেলাপি ঋণের মতো অন্য যে সমস্যাগুলো আছে সেগুলো ধাপে ধাপে সমাধান করতে হবে।’

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর