রবিবার, ১৮ আগস্ট, ২০২৪ ০০:০০ টা
সরেজমিন জাতীয় চক্ষু বিজ্ঞান ইনস্টিটিউট হাসপাতাল

গুলিতে ঝাঁজরা চোখ

তিন দিনেই গুরুতর আঘাত নিয়ে এসেছিলেন ২৬১ জন, নিভে যাচ্ছে অসংখ্য চোখের আলো

জয়শ্রী ভাদুড়ী

গুলিতে ঝাঁজরা চোখ

জাতীয় চক্ষু বিজ্ঞান ইনস্টিটিউট হাসপাতালে চোখে গুরুতর আঘাত নিয়ে ভর্তি আহতরা -বাংলাদেশ প্রতিদিন

সিটিস্ক্যান রিপোর্ট হাতে মলিন মুখে বসে আছেন নূরজাহান বেগম। তার স্বামী মিজানুর রহমান বাদলের (৪০) চোখে চারটা গুলি বিঁধে আছে। নূরজাহান বলেন, ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থায় রয়েছে গুলিগুলো। এক চোখে একেবারেই দেখতে পাচ্ছেন না, আরেক চোখে একেবারে ঝাপসা। কিন্তু এই মুহূর্তে অপারেশন করতে গেলে চোখ একেবারে অন্ধ হওয়ার ঝুঁকির কথা বলেছেন ডাক্তাররা। মুখ মাথা মিলিয়ে প্রায় ২৫টা রাবার বুলেট বিঁধে আছে। বলতে বলতে চোখ মুছছিলেন তিনি। সেদিনের বর্ণনা দিয়ে মিজানুর রহমান বাদল বলেন, আমি প্রাইভেট কার চালাই, মিরপুর এলাকাতেই থাকতাম। স্ত্রী ও দুই মেয়ে লালমনিরহাটে গ্রামের বাড়িতে থাকে। আন্দোলনের মধ্য দিয়ে ৫ আগস্ট শেখ হাসিনা সরকার পতন হলে দুপুরে আমিও সবার সঙ্গে আনন্দ মিছিলে বের হই। মিরপুর মডেল থানার সামনে আসতেই হঠাৎ থানার ছাদের ওপর থেকে গুলি শুরু হয়। গুলি থেকে বাঁচতে পূর্ণিমা হোটেলের পাশে এক মেহগনি গাছের পেছনে দাঁড়িয়ে বাঁচার চেষ্টা করছিলাম। কিন্তু কিছু বুঝে ওঠার আগেই একঝাঁক রাবার বুলেট এসে আমার চোখে মুখে মাথায় লাগে। আমার চোখ দিয়ে পানির মতো রক্ত পড়তে থাকে। আমি চোখে কিছুই দেখতে পাচ্ছিলাম না, যেদিকেই যাচ্ছি ধাক্কা খাচ্ছি। ওখান থেকে দুজন আমাকে একটা বেসরকারি হাসপাতালে নিয়ে যায়, সেখান থেকে ওইদিন সন্ধ্যায় এ হাসপাতালে এনে ভর্তি করা হয় আমাকে। তিনি আরও বলেন, ‘আমি চেয়েছিলাম মানুষ যেন সুন্দরভাবে নিজের অধিকার নিয়ে বাঁচতে পারে। কেউ কাউকে শোষণ যেন না করে। জানি না এই নতুন বাংলাদেশ আমি আর দেখতে পাব কি না। গ্রামে ছোট্ট একটা ঘর ছাড়া জমি বা সম্পত্তি কিছুই নেই। আমার আয়েই সংসার চলত। দুই মেয়েকে নিয়েই এখন দুশ্চিন্তা।’ বাবার কোলঘেঁষেই বসে ছিল বাদলের ছোট্ট মেয়ে মারিয়া। বাবার কিছু প্রয়োজন হলেই দৌড়ে এগিয়ে আসছিল।

জাতীয় চক্ষুবিজ্ঞান ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালের ৪১৫, ৪১৬, ৪২৯, ৪৩০ নম্বর ওয়ার্ডে বাদলের মতো আরও প্রায় ৪০ জন রোগীর চোখের আলো নিবু নিবু করছে গুলির আঘাতে। গতকাল রাজধানীর আগারগাঁওয়ের চক্ষুবিজ্ঞান ইনস্টিটিউট হাসপাতাল ঘুরে দেখা যায়, এই রোগীদের মধ্যে চারজনের দৃষ্টিশক্তি ফিরে আসার সম্ভাবনা প্রায় নেই। সিরাজগঞ্জের এনায়েতপুরে ব্যাটারিচালিত অটোরিকশা চালাতেন মো. নাজমুল (১৫)। পাঁচ বছর বয়সে মা মারা যাওয়ায় পড়াশোনার গন্ডি প্রাথমিক পেরোয়নি তার। বাবা মো. হাবিবুল্লাহ বলেন, সরকার পতনের আন্দোলন শুরু হলে নাজমুল প্রতিদিনই মিছিলে যেত। গত ৪ আগস্ট বেলা ১১টার দিকে হাটখোলা বাজারে আন্দোলনকারীদের ওপর পুলিশ গুলি ছুড়লে নাজমুলের দুই চোখে রাবার বুলেট লাগে। চোখ, মুখ মাথায় ১৬টা গুলি লেগেছে। এনায়েতপুরে বেসরকারি হাসপাতালে প্রথমে নিয়েছিলাম। এরপর ৫ আগস্ট এ হাসপাতালে নিয়ে আসি। অপারেশন করে বেশ কিছু গুলি বের করা হয়েছে। কিন্তু এখনো অনেকগুলো রয়ে গেছে। আরও বেশি দুশ্চিন্তায় পড়ে গেছি, কারণ আজ ডাক্তার যে কোনো কিছু দেখতে বললেই নাজমুল বলছে বাম চোখে কিছুই দেখছি না।  জাতীয় চক্ষুবিজ্ঞান ইনস্টিটিউট ও হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের হিসাবে, সরকারের পদত্যাগের এক দফার দাবির আন্দোলন ও পরবর্তী সহিংসতায় ৪, ৫ ও ৬ আগস্ট সারা দেশ থেকে চোখে গুরুতর আঘাত নিয়ে ২৬১ জন এই হাসপাতালে এসেছিলেন। তাদের মধ্যে ভর্তি করা হয় ২৩৪ জনকে। আর চোখে অস্ত্রোপচার করা হয় ১৮১ জনের। বগুড়ার সাতমাথা এলাকায় আন্দোলনে গিয়ে চোখে রাবার বুলেট বিদ্ধ হয়েছিলেন অটোরিকশা চালক জুয়েল মন্ডল (২৫)। দুই চোখে, মুখে, মাথায়, বুকে অজস্র রাবার বুলেট বিঁধেছে। জুয়েলের স্ত্রী ফরিদা বলেন, ৪ আগস্ট আন্দোলনে গিয়ে গুলিবিদ্ধ হয় সে। ওখানে সরকারি হাসপাতালে পাঁচ দিন চিকিৎসার পর ১০ আগস্ট চক্ষুবিজ্ঞান ইনস্টিটিউট হাসপাতালে নিয়ে আসে তাকে। চোখ, মাথা থেকে কোনো গুলিই বের করা যাচ্ছে না। ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থায় আছে। বাম চোখে একেবারেই দেখতে পাচ্ছে না, ডান চোখেও খুব ঝাপসা দেখছে। বাড়িতে আমাদের চার বছরের ছেলে, শাশুড়ি, ছোট দেবর নিয়ে আমাদের পাঁচজনের সংসার। আমার স্বামীই একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তি। আমাদের এমনিতেই নুন আনতে পান্তা ফুরায়। সে দেখতে না পেলে আমাদের আর বিপদের সীমা থাকবে না। এ সময় জুয়েল বলেন, দেশের ভবিষ্যৎ গড়তে আন্দোলনে নেমেছিলাম। আমার পরিবারের ভবিষ্যৎ অন্ধকার হবে কি না তা তো ভাবিনি।

সর্বশেষ খবর