মঙ্গলবার, ২০ আগস্ট, ২০২৪ ০০:০০ টা

আবাসন খাতে অস্থিরতা ঝুঁকিতে কোটি মানুষ

♦ ২ লাখ কোটি টাকার বিনিয়োগ হুমকিতে, ড্যাপ প্রত্যাহারের দাবি রিহ্যাবের ♦ নির্মাণসামগ্রীর উচ্চমূল্য কমেছে ফ্ল্যাট বিক্রি

রাশেদ হোসাইন

আবাসন খাতে অস্থিরতা ঝুঁকিতে কোটি মানুষ

দেশের আবাসন খাতে চলছে ভয়াবহ অস্থিরতা। এ খাতের সঙ্গে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে জড়িত কোটি মানুষ বেকার হওয়ার বড় রকম ঝুঁকিতে পড়েছেন। হুমকিতে পড়েছে ব্যবসায়ীদের ২ লাখ কোটি টাকার বিনিয়োগ। সংকট উত্তরণে আবাসন খাতের ব্যবসায়ীরা ত্রুটিপূর্ণ বিশদ অঞ্চল পরিকল্পনা বা ড্যাপ প্রত্যাহারের দাবি জানিয়েছেন।

ব্যবসায়ীরা জানিয়েছেন, আবাসন খাতে সরাসরি ৪০ লাখ লোকের কর্মসংস্থান হয়েছে। ব্যাকওয়ার্ড শিল্পসহ এ খাতে প্রায় ১ কোটির বেশি মানুষ জড়িত। নির্মাণসামগ্রীর উচ্চমূল্য, ব্যাংক ঋণ দু®প্রাপ্যতা, মূল্যস্ফীতি, ডলারের দাম বৃদ্ধিসহ নানা কারণে সংকটে পড়েছে দেশের আবাসন শিল্প। ত্রুটিপূর্ণ বিশদ অঞ্চল পরিকল্পনা (ড্যাপ)-এর ফলে জমি অনুযায়ী ভবনের উচ্চতা-আকারে এসেছে ব্যাপক পরিবর্তন। ফলে কমেছে ফ্ল্যাট বিক্রি, বেড়েছে ফ্ল্যাটের দাম। এতে ঝুঁকিতে পড়েছে কোটি মানুষের কর্মসংস্থান নিশ্চিত করা এ খাতটি।

রিহ্যাবের সিনিয়র সহসভাপতি লিয়াকত আলী ভূঁইয়া মিলন গতকাল বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, এক মাস ধরে অস্থিরতায় এ খাতের ব্যবস্যার অবস্থা আরও খারাপ হয়েছে। আমরা এখন চেষ্টা করছি এখান থেকে উত্তরণের। এখন সে রকম কেনাবেচা হচ্ছে না। বর্তমানে আমাদের প্রধান যে সমস্যা তা হলো ড্যাপ। ড্যাপের কারণে মৌলিক চাহিদার অন্যতম আবাসনের স্বপ্ন মধ্যবিত্তের নাগালের বাইরে চলে যাচ্ছে। সবার জন্য মানসম্মত আবাসন আরও কঠিন হয়ে পড়ছে। পরিকল্পিত নগরায়ণের অন্তরায় ‘ফার’ বা ‘ড্যাপ’ কোনোটাই যাতে না হয় এ নিয়ে আমরা কাজ করছি। আমরা এ বৈষম্যমূলক ও ক্রটিপূর্ণ ড্যাপ সংশোধনের জন্য রাজউক এবং গৃহায়ন ও গণপূর্ত উপদেষ্টার সঙ্গে দেখা করব।

এমন পরিস্থিতিতে ড্যাপ প্রত্যাহারের দাবি জানিয়ে গৃহায়ন ও গণপূর্ত উপদেষ্টা আদিলুর রহমান খানকে চিঠি দিয়েছে আবাসন ব্যবসায়ীদের সংগঠন রিয়েল এস্টেট অ্যান্ড হাউজিং অ্যাসোসিয়েশন-রিহ্যাব। সংগঠনের সভাপতি মো. ওয়াহিদুজ্জামানের দেওয়া চিঠিতে বলা হয়- ঢাকা শহরকে বাসযোগ্য ও পরিবেশসম্মত নগরী হিসেবে গড়ে তোলার লক্ষ্যে বিগত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে এই সেক্টরের বিশেষজ্ঞরা অনেক যাচাইবাছাই সাপেক্ষে ইমারত নির্মাণ বিধিমালা-২০০৮ প্রকাশ করেন। পরবর্তীতে খাল-বিল নদী-নালা, জলাশয়, ধানি জমি, শিল্পাঞ্চল, রাস্তাঘাট প্রশস্তকরণ ও আবাসিক এরিয়া সংরক্ষণের তাগিদে ২০১০ সালে মাস্টারপ্ল্যান-২০১০, এসআরও নম্বর- ২৩২ আইন/২০১০ বিধি আকারে প্রকাশ করেন। যার ভিত্তিতে ঢাকা শহরের রাস্তাঘাট প্রশস্ত ও পরিবশেসম্মত ভবন নির্মাণ হয়ে আসছিল। কিন্তু অত্যন্ত পরিতাপের বিষয়, একটি সুন্দর ও সময়োপযোগী ইমারত নির্মাণ বিধিমালা-২০০৮ ও মাস্টারপ্ল্যান-২০১০-কে রহিত করে আবাসন খাতকে কুক্ষিগত করার লক্ষ্যে বিগত স্বৈরাচারী সরকারের মদতপুষ্ট একটি স্বার্থান্বেষী মহলকে খুশি করতে কতিপয় অসাধু কর্মকর্তা কভিড-১৯ মহামারি চলাকালীন তড়িঘড়ি করে নামমাত্র গণশুনানি দেখিয়ে মানুষের মতামতকে আমলে না নিয়ে ২২ আগস্ট ২০২২ তারিখে বৈষম্যমূলক ও ত্রুটিপূর্ণ বিশদ অঞ্চল পরিকল্পনা ২০২২-২০৩৫ প্রকাশ করেন। যার ফলে ঢাকা শহরের উন্নয়ন একেবারেই স্থবির হয়ে পড়ছে। বর্তমান এই বৈষম্যমূলক বিশদ অঞ্চল পরিকল্পনা ২০২২-২০৩৫ অনুসারে ঢাকা শহরের বেশির ভাগ এরিয়ার পূর্বে যা ভবনের আয়তন পাওয়া যেত এখন তার প্রায় অর্ধেক পাওয়া যায় এবং এর ফলে খাল-বিল, জলাশয় ও কৃষিজমি দ্রুতগতিতে হ্রাস পাচ্ছে, যা ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য ক্ষতিকর হবে। ফলশ্রুতিতে আবাসন শিল্পের সঙ্গে জড়িত প্রায় ৪০ লাখ মানুষ বেকার হয়ে পড়বে এবং জনগণ বিশাল ক্ষতির সম্মুখীন হচ্ছেন। পক্ষান্তরে সরকারের বিপুল পরিমাণ রাজস্ব আয় ও বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন কমে যাবে।

ওই পত্রে রিহ্যাব আরও বলেছে- আবাসন শিল্পে বৈষম্য দূরীকরণের লক্ষ্যে বৈষম্যমূলক ও ত্রুটিপূর্ণ বিশদ অঞ্চল পরিকল্পনা-২০২২-২০৩৫ স্থগিত পূর্বক, ঢাকা মহানগর ইমারত নির্মাণ বিধিমালা-২০০৮ ও মাস্টারপ্ল্যান-২০১০ এসআরও নম্বর- ২৩২ আইন/২০১০ এর বিধি অনুসারে ভবনের নকশা অনুমোদনের আদেশ প্রদান করতে হবে। আবাসন খাতের উদ্যোক্তারা বলছেন, বিশ্বের বিভিন্ন সুউচ্চ ইমারত দেখে মানুষ মুগ্ধ হয়। সেখানে ঘুরতে যায়। আমেরিকা, দুবাই, মালেশিয়াসহ বিভিন্ন দেশে উঁচু বিল্ডিং মানুষকে মুগ্ধ করে। আর আমাদের দেশে পর্যাপ্ত পরিমাণ জায়গা নেই। এরপর আবার ত্রুটিপূর্ণ বিশদ অঞ্চল পরিকল্পনার (ড্যাপ) ফলে বিল্ডিংয়ের উচ্চতা কমছে। ফ্ল্যাটের আকার কমেছে। এর ফলে জমির মালিকরা সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন। নতুন ২০২২-এর ড্যাপের তুলনায় উদ্যোক্তারা ২০০৮ সালের ড্যাপে ফেরত যেতে চান। বর্তমান এ সময়ে জমিই ক্রয় করছে না কেউ। প্ল্যান পাস তো পরের কথা। এ ছাড়া নির্মাণসামগ্রীর দাম প্রায় ৫০ শতাংশের বেশি বেড়েছে। এখন থেকে যদি স্থির পরিবেশে না যাওয়া যায় তাহলে পুরো খাত ঝুঁকিতে পড়বে। ব্যবসায়ীরা বলেন- আগে ঢাকা শহরের গ্রিনরোড এরিয়াতে ১০ কাঠা জায়গায় ৩২টা ফ্ল্যাট পাওয়া যেত। আর এখন সেই ১০ কাঠা জায়গায় ফ্ল্যাট দিচ্ছে ১৩/১৪টা। আগে যে বিল্ডিংয়ের উচ্চতা দিত ১০ তলা, এখন সেই বিল্ডিংয়ের উচ্চতা দিচ্ছে ৬ তলা। ফ্ল্যাটের সংখ্যা কমিয়ে দিচ্ছে। ফলে পুরো ব্যবসা স্থবির হয়ে আছে। এর পেছনে মূলত ড্যাপ।

ব্যবসায়ীরা জানান, বাংলাদেশে আবাসন খাতের লিঙ্কেজসহ ইন্ডাস্ট্রি রয়েছে ১২০ থেকে ১৩০টা। এর মধ্যে রড, সিমেন্ট, তার, স্যানিটারি, তালা, চাবি, বোর্ড, দরজা অন্যতম। এ হিসাবে হিসাব করলে জিডিপিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে আবাসন খাত। এ ছাড়া ব্যাকওয়ার্ড ইন্ডাস্ট্রিসহ এ শিল্পে কোটির ওপর মানুষ জড়িত। নির্মাণসামগ্রীর দাম কমলে মানুষ আবার এ খাতে বিনিয়োগে আসতে পারে। এ ছাড়া ড্যাপ সংশোধন করে উচ্চতা বাড়াতে হবে।

রিহ্যাব জানায়, মধ্যবিত্ত শ্রেণির মানুষের আবাসন সুবিধা সহজলভ্য করার জন্য সরকারের পক্ষ থেকে সিঙ্গেল ডিজিট সুদে ব্যাংক ঋণের ব্যবস্থা চালু করার প্রস্তাব করা হয়েছে। সরকার একসময় এই সিঙ্গেল ডিজিট সুদের ঋণ প্রদান ব্যবস্থা চালু করেছিল। তখন অনেক মধ্যবিত্ত সিঙ্গেল ডিজিট সুদের ঋণ নিয়ে ফ্ল্যাটের মালিক হয়েছেন। মধ্যবিত্তের আবাসনের স্বপ্ন পূরণ করতে এবং আবাসন খাতে গতিশীলতা ফিরিয়ে আনতে একই ধরনের ব্যবস্থা গ্রহণ করা প্রয়োজন। নিবন্ধন ব্যয় সার্কভুক্ত দেশ এমনকি বিশ্বের মধ্যেও সবচেয়ে বেশি। রেজিস্ট্রেশন ব্যয় কম হলে ক্রেতারা জমির সঠিক মূল্য দেখাতে উৎসাহিত হবেন। রিহ্যাব পরিচালক মোহাম্মদ লাবিব বিল্লাহ বলেন, এ সময়ে আবাসন খাত স্থবির হয়ে আছে। আমরা আশাবাদী বর্তমান সরকার এ খাতকে এগিয়ে নিয়ে যাবে। এ ছাড়া ডলারের মূল্যবৃদ্ধিতে এ খাত অস্থিরতায় পড়েছে। আমাদের আবাসন শিল্পে ৪০ লাখ মানুষ কাজ করছে। অন্যান্য লিঙ্কেজ নিয়ে এ খাতে আরও বেশি মানুষ কাজ করছে। রিহ্যাব সূত্র বলছে, ২০১০-২০১২ সাল পর্যন্ত প্রতি বছর গড়ে ১৫ হাজারের কাছাকাছি ফ্ল্যাট-অ্যাপার্টমেন্ট বিক্রি হয়েছে। ২০১৩-২০১৬ পর্যন্ত প্রতি বছর গড়ে বিক্রি হয় ১২ হাজারের বেশি ফ্ল্যাট। ২০১৭-২০২০ পর্যন্ত প্রতি বছর গড়ে ১৩-১৪ হাজার ফ্ল্যাট বিক্রি হয়। ২০২০ সালের জুলাই-২০২২ সালের জুন পর্যন্ত প্রতি বছর ১৫ হাজারের কাছাকাছি ফ্ল্যাট বিক্রি হয়েছে। এরপর ড্যাপ বাস্তবায়ন আর নির্মাণ উপকরণের মূল্যবৃদ্ধিতে বিক্রি কমে আসে ফ্ল্যাটের। ২০২২-২৩ অর্থবছরে বিক্রি হয় ১০ হাজারের কাছাকাছি। সদ্য বিদায়ী ২০২৩-২৪ অর্থবছরে আরও কমে সেটি ১০ হাজারের নিচে অবস্থান করছে। এতে দেখা যায় ফ্ল্যাটের চাহিদা দিন দিন কমেছে।

 

 

এই বিভাগের আরও খবর

সর্বশেষ খবর