বৃহস্পতিবার, ২৯ আগস্ট, ২০২৪ ০০:০০ টা

আকাশসম দেনায় বিদ্যুৎ-জ্বালানি খাত

♦ পিডিবির বিদ্যুৎ বিল বকেয়া ৫০ হাজার কোটি টাকার বেশি ♦ ভারত থেকে বিদ্যুৎ আমদানির বকেয়া ৫ হাজার ২৯৭ কোটি টাকা ♦ বিশ্বব্যাংকের কাছে ১ বিলিয়ন ডলার বাজেট সহায়তা চেয়েছেন জ্বালানি উপদেষ্টা

জিন্নাতুন নূর

আকাশসম দেনায় বিদ্যুৎ-জ্বালানি খাত

বিভিন্ন দেশি-বিদেশি বিদ্যুৎ ও জ্বালানি সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠানের কাছে বাংলাদেশের বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতের দেনা তথা বকেয়ার যে পরিমাণ দাঁড়িয়েছে তা আকাশসম। আর এরই মধ্যে এ বিপুল পরিমাণ পাওনা আদায়ে চাপ দিচ্ছে এসব বিদ্যুৎ ও জ্বালানি সরবরাহকারীরা। অনেকেই বিল পরিশোধ না করলে বিদ্যুৎ ও জ্বালানি সরবরাহ করবে না বলে সাফ জানিয়ে দিয়েছে। এ অবস্থায় অন্তর্বর্তী সরকারের বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ উপদেষ্টা মুহাম্মদ ফাওজুল কবির খান ২১ আগস্ট বিদ্যুৎ ও জ্বালানি আমদানির বকেয়া দ্রুত পরিশোধ করতে এ খাতে বাজেট সহায়তা বাবদ বিশ্বব্যাংকের কাছে ১ বিলিয়ন মার্কিন ডলার চেয়েছেন। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতে এ বিপুল পরিমাণ বকেয়া ও ঋণ দ্রুত পরিশোধ না করলে শিগগিরই বাংলাদেশ জ্বালানি সংকটে পড়বে। এতে বিদ্যুৎ উৎপাদন বাধাগ্রস্ত হবে। থমকে যাবে শিল্পোৎপাদন, বিপর্যয়ে পড়বে গোটা অর্থনীতি।

বিদ্যুৎ খাতে বকেয়া : বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতে সরকারের বকেয়া গত বছরের ডিসেম্বরে দাঁড়িয়েছিল প্রায় ৫ বিলিয়ন ডলার। এর বড় অংশই ছিল বিদ্যুৎ খাতের। বিশেষ বন্ড ইস্যুর মাধ্যমে কিছু বকেয়া কমানো হলেও এখন তা আবারও বেড়ে গেছে। ভর্তুকির মাধ্যমে এ বকেয়া পরিশোধ করতে গিয়ে অর্থ সংকটে পড়তে হচ্ছে সরকারকে। গত মে মাসে সংসদে বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয়ের দেওয়া এক হিসাবে বলা হয়, চলতি বছরের ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড (পিডিবি)-এর বিদ্যুৎ ক্রয় বাবদ বকেয়া ছিল ৩৩ হাজার ১০৯ কোটি। এর মধ্যে সরকারি বিদ্যুৎ উৎপাদন কোম্পানি ও সঞ্চালন সংস্থা পাওয়ার গ্রিড কোম্পানি অব বাংলাদেশ (পিজিসিবি)-এর পাওনা মোট বকেয়া ১০ হাজার ৩৯১ কোটি টাকা। বেসরকারি বিদ্যুৎ উৎপাদন কোম্পানিগুলো পাবে ১৫ হাজার কোটি টাকা। ভারত থেকে আমদানি করা বিদ্যুৎ বিল বাবদ বকেয়া ৫ হাজার ২৯৭ কোটি টাকা। এর বাইরে যৌথ উদ্যোগে নির্মিত বিদ্যুৎ কেন্দ্রের (পায়রা ও রামপাল তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্র) বিল বকেয়া ২ হাজার ৪১৮ কোটি টাকা। এ হিসাবের বাইরে এরই মধ্যে মার্চ ও এপ্রিলের বিলও বকেয়া পড়েছে। প্রতি মাসে পিডিবির গড় বিল আসছে ৬ হাজার কোটি টাকার বেশি। সে হিসেবে দুই মাসে অন্তত ১২ হাজার কোটি টাকার বিল এসেছে। সব মিলিয়ে বিদ্যুৎ খাতে বকেয়ার পরিমাণ দাঁড়ায় ৪৫ হাজার ১০৯ কোটি টাকা। আর মে মাসের বিল জমা পড়লে এটি ৫০ হাজার কোটি টাকা ছাড়িয়ে যাবে। এ ছাড়া সরকারের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের কাছে বকেয়া বিদ্যুৎ বিলের পরিমাণ প্রায় ২০ হাজার কোটি টাকা। সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলো দীর্ঘ সময় বিল না দেওয়ায় এ বিপুল পরিমাণ টাকা বকেয়া পড়েছে। মার্কিন জ্বালানি বাজার বিশ্লেষক ও পর্যবেক্ষক প্রতিষ্ঠান ইনস্টিটিউট ফর এনার্জি ইকোনমিকস অ্যান্ড ফাইন্যান্সিয়াল অ্যানালাইসিস (আইইইএফএ)-এর চলতি বছরের এপ্রিলে প্রকাশিত প্রতিবেদনে বলা হয়, বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতে ৫ বিলিয়ন ডলার বকেয়া পরিশোধ করতে গিয়ে বাংলাদেশ হিমশিম খাচ্ছে। এতে আরও বলা হয়, ২০২১ থেকে ২০২৩ সাল পর্যন্ত দেশটিতে ডলারের বিপরীতে টাকার অবমূল্যায়ন হয়েছে ২৮ দশমিক ৮ শতাংশ; যা বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতের বিল পরিশোধে প্রতিকূল পরিস্থিতি তৈরি করেছে। এদিকে ভারতের বিদ্যুৎ খাতের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট নির্বাহীদের বরাত দিয়ে দেশটির সংবাদমাধ্যম টাইমস অব ইন্ডিয়ার প্রতিবেদনে সম্প্রতি বলা হয়, ভারতীয় বিদ্যুৎ কোম্পানিগুলো বাংলাদেশের কাছে ১ বিলিয়ন মার্কিন ডলার পায়। এ নির্বাহীরা বলেছেন, কোম্পানিগুলো বকেয়া থাকা সত্ত্বেও বাংলাদেশে বিদ্যুৎ সরবরাহ অব্যাহত রেখেছে। তবে কোম্পানিগুলো তাদের অংশীদারদের কাছে দায়বদ্ধ থাকায় এ পরিস্থিতি অনির্দিষ্টকাল চলতে পারে না বলেও সতর্ক   করে দিয়েছেন।

এ অবস্থায় বিদ্যুৎ ও জ্বালানি আমদানির বকেয়া দ্রুত পরিশোধের জন্য এ খাতে বাজেট সহায়তা বাবদ বিশ্বব্যাংকের কাছে ১ বিলিয়ন ডলার সহায়তা চেয়েছেন মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা মুহাম্মদ ফাওজুল কবির খান। তিনি বিশ্বব্যাংকের কান্ট্র্ িডিরেক্টর আবদৌলায়ে সেকের নেতৃত্বে চার সদস্যের একটি প্রতিনিধি দলের সঙ্গে সাক্ষাতে জানান, বিদ্যুৎ ও জ্বালানি আমদানিতে বৈদেশিক মূল্য পরিশোধের দায় প্রায় ২ দশমিক ২ বিলিয়ন ডলার।

জ্বালানি তেলে বকেয়া ৪৮ কোটি ডলার : আড়াই বছর ধরে ডলার সংকটে বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম করপোরেশন (বিপিসি) যথাসময়ে আমদানিকৃত জ্বালানি তেলের বিল পরিশোধ করতে পারছে না। এরই মধ্যে পাওনা আদায়ে চাপ দিচ্ছে জ্বালানি তেল সরবরাহকারীরা। বিল পরিশোধে হিমশিম খাচ্ছে বিপিসি। ব্যাংক থেকে বৈদেশিক মুদ্রা ডলার পাওয়া যাচ্ছে না। বকেয়া বাড়তে থাকায় তেলের জাহাজ পাঠাতে চাইছে না কোনো প্রতিষ্ঠানও। বিপিসিসূত্র বলছেন, ২২ আগস্ট পর্যন্ত মোট প্রায় ৪৮ কোটি ডলার (৫ হাজার ৭৩৪ কোটি ৯৮ লাখ ৭২ হাজার টাকা) বকেয়া জমা পড়েছে বিপিসির। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি বকেয়া সিঙ্গাপুরভিত্তিক কোম্পানি ভিটলের, তারা পাবে ১৮ কোটি ৫৬ লাখ ডলার। চীনের কোম্পানি ইউনিপেক পাবে প্রায় ৫ কোটি ৮৬ লাখ ডলার। আরব আমিরাতের ইনক পাবে ৫ কোটি ৭১ লাখ ডলার। ইন্দোনেশিয়ার বিএসপি পাবে ৪ কোটি ৬৯ লাখ ডলার। মালয়েশিয়ার পিটিএলসিএল পাবে ২ কোটি ১৮ লাখ ডলার। আর ভারতের আইওসিএল পাবে আড়াই কোটি ডলার। এর বাইরে বকেয়া কিস্তি জমেছে বিদেশি আর্থিক প্রতিষ্ঠানের। জ্বালানি তেলের আমদানি মূল্য পরিশোধে বিপিসিকে নিয়মিত ঋণসহায়তা দেয় ইন্টারন্যাশনাল ইসলামিক ট্রেড ফাইন্যান্স করপোরেশন (আইটিএফসি)। তারা পাবে ৮ কোটি ডলারের বেশি। এ অবস্থায় দেশে যে পরিমাণ আমদানিকৃত তেলের মজুদ আছে তা দিয়ে এক মাস চাহিদা পূরণ করা যাবে। এরপর সরবরাহকারীরা তেল দিতে রাজি না হলে জ্বালানি সংকটে পড়বে দেশ। এ ছাড়া দীর্ঘমেয়াদি চুক্তির আওতায় ও স্পট মার্কেট থেকে এলএনজি আমদানি এবং দেশে গ্যাস উত্তোলনকারী বিদেশি প্রতিষ্ঠানগুলোর (আইওসি) পাওনা চলতি মাসে ৮ হাজার ৩৪৫ কোটি ৩০ লাখ টাকায় পৌঁছেছে।

এই বিভাগের আরও খবর

সর্বশেষ খবর