শেখ হাসিনা সরকারের পতনের এক মাস অতিক্রান্ত হতে চললেও পুরোপুরি স্বাভাবিক হয়নি স্কুল-কলেজের শিক্ষা কার্যক্রম। বন্ধ রয়েছে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর ক্লাস-পরীক্ষা। থামেনি অস্থিরতা। প্রতিষ্ঠান প্রধানসহ বিভিন্ন দায়িত্বপ্রাপ্তদের চাপে ফেলে করানো হচ্ছে পদত্যাগ। জোর করে স্বাক্ষর নেওয়া হচ্ছে আগে থেকেই প্রস্তুত করা পদত্যাগ পত্রে। অভিযোগ রয়েছে, বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নাম ভাঙিয়ে দেশের বিভিন্ন স্থানে শিক্ষকদের হেনস্তা, অপমান-অপদস্ত করা হচ্ছে। ভুক্তভোগীরা বলছেন, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের কিছু ছাত্রছাত্রী নিয়ে সুবিধালিপ্সু সাবেক শিক্ষার্থীরা এসব করছেন। এতে ইন্ধন জোগাচ্ছেন একই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের কতিপয় শিক্ষক বা স্থানীয় রাজনীতিক। শিক্ষাবিদরা অবিলম্বে স্কুল কলেজগুলোতে শিক্ষকদের ওপর এই নিপীড়ন বন্ধের দাবি জানিয়েছেন। তারা বলছেন, অন্তর্বর্তী সরকারের শিক্ষা উপদেষ্টা ‘শিক্ষকদের জোর করে পদত্যাগের সুযোগ নেই এবং সমর্থনযোগ্য নয়’ মন্তব্য করলেও মন্ত্রণালয় থেকে কোনো কঠোর নির্দেশনা জারি না করায় আতঙ্ক কাটছে না শিক্ষকদের মধ্যে।
দেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতেও উপাচার্য, উপ উপাচার্য ও কোষাধ্যক্ষের পদত্যাগের দাবিতে বিভিন্ন কর্মসূচি পালন করেছেন ছাত্রছাত্রীরা। বিশ্ববিদ্যালয় কর্তা ব্যক্তিদের গৃহীত বিভিন্ন পদক্ষেপ ছাত্রবান্ধব ছিল না অভিযোগ করে আওয়ামী আমলের নিয়োগ পাওয়া এই ভিসি-প্রোভিসি-ট্রেজারের পদত্যাগ দাবি করা হয়। উদ্ভূত পরিস্থিতিতে বাধ্য হয়ে পদত্যাগও করেছেন অনেকে। দেশের প্রায় ৪৫টি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে এখন শীর্ষ কর্তার পদ শূন্য রয়েছে। এর ফলে ক্লাস শুরু করতে পারেনি দেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলো। উল্লেখ্য, গত জুনের শেষ দিকে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের আন্দোলনে উচ্চ শিক্ষার এসব বিদ্যাপীঠে ক্লাস-পরীক্ষা বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। অন্তর্বর্তী সরকারের শিক্ষা উপদেষ্টা ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদ সম্প্রতি সাংবাদিকদের বলেন, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের বিভিন্ন পদে যারা দায়িত্ব পালন করছেন তাদের কারও বিরুদ্ধে ন্যায়সংগত অভিযোগ থাকলে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। কিন্তু জোরপূর্বক পদত্যাগে বাধ্য করে অস্থিরতা সৃষ্টি করলে প্রশাসন ভেঙে পড়তে পারে। কাউকে বলপূর্বক পদত্যাগের সুযোগ নেই। একটি সফল অভ্যুত্থানের পর সুশৃঙ্খল সমাজে ফিরে যেতে চান উল্লেখ করে ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদ বলেন, শিক্ষাঙ্গনে শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের যে ধরনের সম্পর্ক আশা করা হয়, সেটি ফিরিয়ে আনতে হবে এবং কাউকে ব্যক্তিগতভাবে অপমানিত করা যাবে না। এদিকে শিক্ষক পদত্যাগের নামে সারা দেশে যা হচ্ছে, সেটা সমর্থনযোগ্য না বলে জানিয়েছেন বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের অন্যতম সমন্বয়ক সারজিস আলম। সম্প্রতি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে এ কথা বলেন তিনি। সারজিস বলেন, শিক্ষক পদত্যাগের নামে সারা দেশে যা হচ্ছে, যে প্রক্রিয়ায় হচ্ছে সেটা সমর্থনযোগ্য নয়। তিনি বলেন, শিক্ষক-শিক্ষার্থীর যে শ্রদ্ধা ও স্নেহের সম্পর্ক আমাদের শিক্ষার পরিবেশকে সুন্দর করে তুলতে পারে সেই সম্পর্ক যেন তিক্ততার না হয়, দূরত্বের না হয়, ভীতির না হয়। শিক্ষক-কর্মচারী নিয়োগে অনিয়ম ও স্বেচ্ছাচারিতার অভিযোগ এনে নওগাঁর হাঁপানিয়া স্কুল অ্যান্ড কলেজের অধ্যক্ষ নুরুল ইসলামের পদত্যাগের দাবিতে গত ২৫ আগস্ট থেকেই দাবি জানিয়ে আসছিলেন একদল শিক্ষার্থী। পরে স্কুল ব্যবস্থাপনা কমিটির প্রধান ও উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার নেতৃত্বে দুই পক্ষের মধ্যে বৈঠকে সমঝোতাও হয়। কিন্তু সেই সমঝোতার পরদিন আবার একদল শিক্ষার্থী অধ্যক্ষকে অবরুদ্ধ করে তার কার্যালয়ে। সেখানে বহিরাগতরা অধ্যক্ষকে শারীরিকভাবে লাঞ্ছিত করে। শিক্ষার্থী ও বহিরাগতদের কটূক্তি ও চাপের মধ্যে এক পর্যায়ে অধ্যক্ষকে পদত্যাগপত্রে সই করতে দেখা যায়। এ সময় হঠাৎ করেই জ্ঞান হারিয়ে ফেলেন এই অধ্যক্ষ। রাজধানীর ভিকারুননিসা নূন স্কুল অ্যান্ড কলেজেও একদল ছাত্রীর চাপের মুখে পদত্যাগপত্রে স্বাক্ষর করতে বাধ্য হয়েছেন ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ কেকা রায়। তাকে রুমে আটকে রেখে জোর করে পদত্যাগপত্রে স্বাক্ষর করতে বাধ্য করা হয়। রাজধানীর শীর্ষস্থানীয় একটি কলেজের অধ্যক্ষ নাম প্রকাশ না করার শর্তে বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, সরকার পতনের পর তার প্রতিষ্ঠানের কয়েক ছাত্রকে প্রভাবিত করছে বহিরাগত উচ্ছৃঙ্খলরা। তার দাবি, আওয়ামী লীগ আমলে যারা ছাত্রলীগের শেল্টারে থেকে বিভিন্ন সুযোগ-সুবিধা নিয়েছেন সরকার পতনের পর তারাই ছাত্রদলের ছায়াতলে থেকে তাকে পদত্যাগ করাতে চাপ দিচ্ছেন। নাম প্রকাশ না করে আরেক অধ্যক্ষ বলেন, ছাত্রছাত্রীরা আমার কাছে বিভিন্ন দাবি নিয়ে এসেছিল। আমি তাদের যৌক্তিক সব দাবি মেনে নিয়েছি। তাদের আর কোনো দাবি না থাকায় এখন আমার পদত্যাগ দাবি করছে। বরিশালের বাকেরগঞ্জ সরকারি কলেজের অধ্যক্ষ শুকলা রানি হালদার সম্প্রতি শিক্ষার্থীদের তোপের মুখে পদত্যাগপত্রে স্বাক্ষর করেন। এ সময় শুকলা রানি হালদার সাংবাদিকদের বলেন, দেশের বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান প্রধানদের সাধারণ শিক্ষার্থীদের নামে বিভিন্ন সরকারি-বেসরকারি স্কুল-কলেজ প্রধানদের যেভাবে পদত্যাগ করানো হয়েছে, আমার ক্ষেত্রেও একই পন্থা অবলম্বন করেছে। শেষ বয়সে এসে ছেলে-মেয়ে সমতুল্য শিক্ষার্থীদের হাতে অপদস্ত হতে চাইনি। জামালপুরের সরিষাবাড়ী উপজেলার সালেমা খাতুন বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষিকার কক্ষে ঢুকে তাকে চেয়ার থেকে নামাতে ও পদত্যাগপত্রে স্বাক্ষর করাতে জোরাজুরি করেছেন একদল শিক্ষার্থী। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে দেখা গেছে এ দৃশ্য।