শনিবার, ৭ সেপ্টেম্বর, ২০২৪ ০০:০০ টা
ড. তোফায়েল আহমেদ

অখ্যাত-অজ্ঞাত লোক দিলে হবে না

অখ্যাত-অজ্ঞাত লোক দিলে হবে না

নির্বাচন বিশ্লেষক ও সুজনের নির্বাহী সদস্য ড. তোফায়েল আহমেদ বলেছেন, নির্বাচন কমিশন একটা সাংবিধানিক সংস্থা। এখন পর্যন্ত যে আইন-কানুন আছে তা দিয়ে ভালো নির্বাচন করতে কোনো অসুবিধা নেই। নির্বাচন আরও ভালো করার জন্য আইন করা যেতে পারে। ভালো নির্বাচন, নির্বাচন কমিশনের ওপর  নির্ভর করে না। ইসি নির্বাচন ব্যবস্থাপনা করে। ইসিতে দরকার হয় সাহসী, নির্ভীক, প্রাজ্ঞ ও মানুষের আস্থা আছে, জাতীয়ভাবে সবাই চেনে এমন লোক। কমিশনে অখ্যাত-অজ্ঞাত লোক দিলে হবে না। নির্বাচন কমিশনের সংস্কার ও নতুন ইসি নিয়োগ নিয়ে গতকাল বাংলাদেশ প্রতিদিনের সঙ্গে আলাপকালে তিনি এসব কথা বলেন। এ নির্বাচন বিশ্লেষক বলেন, সারা দেশের মানুষের আস্থা-বিশ্বাস আছে, সাহসী, নির্ভীক এবং সময়মতো পদক্ষেপ নিতে পারবেন এমন লোক কমিশনে নিয়োগ করুন। বর্তমানে যেহেতু সরকার নিরপেক্ষ তাই যে আইন-কানুন আছে তা দিয়ে ভালো নির্বাচন না হওয়ার কোনো কারণ নেই। ভবিষ্যতে সত্যিকারার্থে একটা ভালো নির্বাচন কমিশন গঠন করার জন্য একটা নতুন আইন দরকার আছে। আরপিওতে কিছু সংস্কার দরকার আছে, সেগুলো করলেই চলবে। তিনি বলেন, বিগত নির্বাচন কমিশন যে কাজগুলো করেনি। এজন্য হয়তো তাদের কিছু বাধা ছিল, অথবা তাদের করা ইচ্ছা ছিল না, অথবা সাহস ছিল না, অথবা সরকার বাধা দিয়েছে। ইসির একটা কাজ ছিল আমাদের যারা অনুপস্থিত ভোটার তথা নারী, বয়স্ক, অন্যত্র বসবাস করেন বা চাকরি করেন, তাদের ভোটটা কীভাবে নেবেন সেই ব্যবস্থা করা। এ ছাড়া বিপুল সংখ্যক মানুষ আমাদের বিদেশে থাকেন, তারাও ভোটার। তারা ভোট দিতে আগ্রহী। কিন্তু আমরা তাদের ভোটাধিকার দিতে চাই না কেন? তাদের ভোটাধিকার কীভাবে দেবেন, সেই ব্যবস্থা করেন। পোস্টাল ব্যালটে নেওয়ার ব্যবস্থা করেন। তবে এই ভোট অনলাইনে হতে পারে, এসএমএসে হতে পারে। ত্রুটি মুক্ত একটা পদ্ধতি তৈরি করে তাদের ভোটগুলো নেওয়ার ব্যবস্থা করার পরামর্শ দেন তিনি। তিনি বলেন, এ জন্য আইনি কাঠামো সামান্য পরিবর্তন করলেই চলবে। যারা নির্বাচনে দায়িত্বপালন করবেন তাদের এবং আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর জন্য পোস্টাল ব্যালটে ভোট দেওয়ার বিধান এখনো রয়েছে। এই বিধান উন্মুক্ত করে দিলেই হবে। শুধু অতিরিক্ত কাজ হবে যারা পোস্টাল ব্যালটে ভোট দিতে চান তাদের জন্য রেজিস্ট্রেশন করতে হবে। পরে সেই রেজিস্ট্রেশন নম্বর অনুযায়ী কীভাবে সঠিকভাবে ভোট দেবে, কীভাবে গণনা হবে সেই সিস্টেমগুলো ঠিক করতে হবে। এটা একটা বড় সংস্কার। ড. তোফায়েল আহমেদ আরও বলেন, নির্বাচনের অন্যান্য সংস্কারের মধ্যে একটা সংস্কার হচ্ছে ক্লিন ইমেজের প্রার্থী নির্বাচন বাছাই করা। এক্ষেত্রে বিজ্ঞ-পরিচ্ছন্ন প্রার্থী দেওয়ার দায়িত্বটা রাজনৈতিক দলের। তবে প্রার্থী বাছাইয়ের ক্ষেত্রে ইসির একটা ভূমিকা রয়েছে। ইসির কাছে প্রার্থীরা হলফনামায় যে ৮টি তথ্য দিচ্ছে, তা সঠিকভাবে যাচাই করলেই প্রার্থী ক্লিন হয়ে যায়। অনেক মামলা আছে, ঋণ খেলাপি রয়েছেন, তখন সেগুলো বেরিয়ে যাবে। তবে শিক্ষাগত যোগ্যতা হয়তো বেঁধে দিতে পারবেন না। তবে কার কতটুকু যোগ্যতা সেটা পরিষ্কার করে বলে দিতে পারবেন। তিনি আরও বলেন, শিক্ষাগত যোগ্যতা প্রধান নিয়ামক নয়, এটা অন্যতম নিয়ামক। সেজন্য ইসি যে আটটি তথ্য নিচ্ছে তা কোনোদিন যাচাই করেনি। বিগত ১/১১ সরকারের আমলে আমরা মামলা করে এ তথ্যগুলো দেওয়ার ব্যবস্থা করেছিলাম। কিন্তু যে ইমপ্যাক্ট হওয়ার কথা তা হয়নি। তথ্যগুলো সঠিকভাবে প্রকাশ করা হয়নি। আগামীতে যে কমিশন আসবে তার বড় কাজ হবে আগে থেকেই এই আট তথ্য কীভাবে যাচাই করা যায় সেই প্রস্তুতি রাখা। এখানে সরকারের অন্য বিভাগকে যুক্ত করা হবে কি না তা বিবেচনা করতে হবে। এক্ষেত্রে পুলিশ ও এনবিআর যুক্ত হতে পারে। জেলায় জেলায় বাছাই কমিটি গঠন করা যেতে পারে। এতেই পরিচ্ছন্ন প্রার্থী বাছাই সম্ভব হবে। তোফায়েল আহমেদ বলেন, ইসি নির্বাচন পর্যবেক্ষণের জন্য যে সংস্থাগুলোতে নিবন্ধন দিয়েছে সেগুলোর কোনো অভিজ্ঞতা নেই। তারা কখনো নির্বাচন পর্যবেক্ষণও করেনি। এগুলো সবই আইওয়াশ। এখানে অর্থ উপার্যনেরও একটা বিষয় রয়েছে। তাই এসব বন্ধ করতে হবে। একই সঙ্গে ইসির নিজস্ব পর্যবেক্ষকও থাকতে হবে। গুরুত্বপূর্ণ কিছু ভোট কেন্দ্রে সিসি ক্যামেরার ব্যবস্থা রাখতে হবে। এক্ষেত্রে সরকারের পক্ষ থেকে কতটুকু অর্থ বরাদ্দ পাওয়া যায় এসব তার ওপর নির্ভর করবে। সুজনের নির্বাহী সদস্য ড. তোফায়েল আহমেদ বলেন, ইভিএম নিয়ে নতুন চিন্তা করা যেতে পারে। কেননা অনেক ইভিএম কেনা রয়েছে। ইভিএমের অনেক ভালো দিক রয়েছে। নির্বাচনের ঝামেলা ও খরচ কমবে। সামনে অনেক নির্বাচন রয়েছে। সেগুলো ইভিএম দিয়ে করা যাবে। ইভিএম নিয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর আপত্তি ছিল মূলত ভোট কেন্দ্রে ডাকাত ঢুকে পড়া নিয়ে। তথা একজনের ভোট বাটন চেপে আরেকজন দিয়ে দিত। এটা মেশিনের দোষ না, ভোটকেন্দ্র ব্যবস্থাপনার শিথিলতা ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর যথাযথ দায়িত্ব পালন না করা। এখন এগুলো চেক দেওয়া সম্ভব। কেননা নতুন বিপ্লবী সরকার সুষ্ঠু ও ভালো নির্বাচনের চেষ্টা করবে। এখন আমরা এই মেশিনকে ব্যবহার করতে পারি। ইভিএমে ভোটগ্রহণ হলে ভোটার শনাক্ত ৮০ শতাংশ নির্ভুল ও সহজ হবে। ২০ শতাংশের ক্ষেত্রে হয়তো আঙুলের ছাপ মিলবে না, সেক্ষেত্রে হয়তো এজেন্টরা ভোটার শনাক্ত করবেন। এ ছাড়া ভোট গণনাও সহজ, নির্ভুল ও সময় কম লাগবে। এক্ষেত্রে নির্বাচন কমিশন ইভিএমে ভোটার ভেরিয়েবল পেপার অডিট ট্রেইল বা ভিভিপিএটি যুক্ত করতে পারে। কেউ গণনা চ্যালেঞ্জ করলে সহজে পুনঃগণনা করা যাবে। তিনি বলেন, বর্তমানে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর মধ্যে বিশৃঙ্খলা রয়েছে। পুলিশ ফোর্স সঠিকভাবে আসেনি। সামনের নির্বাচনে হয়তো সেনাবাহিনী নিয়োজিত করতে হবে। বিগত সময়ে সেনাবাহিনী নিয়োগে সরকারের রিজার্ভেশন ছিল। এখন হয়তো তা হবে না। তিনি বলেন, আগামীতে যে জাতীয় বা স্থানীয় নির্বাচন আসবে তা প্রভাবিত হওয়ার কোনো কারণ নেই। এখন যে অন্তর্বর্তী সরকার আছে তাদের নির্বাচন প্রভাবিত করার কোনো আগ্রহ নেই। ভ্যানগার্ড হিসেবে আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীরাও কাজ করবে। এ ছাড়াও রাজনৈতিক দলগুলো এই উত্থান-পতন থেকে শিক্ষা নিতে হবে। ভোট প্রভাবিত করার মানসিকতা বাদ দিতে হবে। মানুষের কাছে গিয়ে তাদের কনভিন্স করে ভোট নিতে হবে। নির্বাচনের আগে রাজনৈতিক দলগুলোতে সুগঠিত হতে হবে। রাজনৈতিক দলগুলোর সদস্যদের কোনো তালিকা নেই। সব দলকে সদস্যদের তালিকা তৈরি করতে হবে। সদস্যরা দলকে সদস্য ফি ও চাঁদা দেবে। সেই তহবিল দিয়ে দল নির্বাচনি খরচ পরিচালনা করবে। কেউ অতিরিক্ত অর্থ দিতে চাইলে তা দিতে পারবে। তবে ইসি হয়তো তার পরিমাণ নির্ধারণ করে দেবে। একটা দলের কতজন তালিকাভুক্ত সদস্য আছে ও তাদের ফান্ডে কত টাকা আছে তা জনগণকে জানাতে হবে। এগুলো ইসির এখতিয়ারভুক্ত কাজ। ইসি এগুলো রাজনৈতিক দলগুলোর ওপর ইমপোজ করতে পারে। এসব বিষয়ও সুষ্ঠু নির্বাচনে ভূমিকা রাখবে। তিনি আরও বলেন, ভোট ব্যবস্থাপনায় ভোটারদের যুক্ত করা। এক্ষেত্রে ভোটার ক্লাব করা যেতে পারে। তবে তা কতটুকু সম্ভব হবে তা দেখা যেতে পারে। নতুন নির্বাচন কমিশন নিয়োগের বিষয়ে তিনি বলেন, আমি মনে করি না দ্রুত নির্বাচন কমিশন নিয়োগ দেওয়া উচিত। এখন এমন কোনো প্রয়োজনীতা নেই যে, এক মাসের মধ্যে নির্বাচন কমিশন নিয়োগ না দিলে বড় ক্ষতি হয়ে যাবে। যখন সরকার আইনকানুন নিয়ে প্রস্তুত হবে, তখন নির্বাচন কমিশন গঠন করবে। এখন ইসির শূন্যতা সাংবিধানিকভাবে কোনো ক্ষতি করছে না। এখন হয়তো সরকার সময় নিয়ে, সঠিকভাবে সঠিক, লোক বাছাই করে ইসি গঠন করতে পারে বলে মন্তব্য   করেন তিনি।

সর্বশেষ খবর