শনিবার, ১৪ সেপ্টেম্বর, ২০২৪ ০০:০০ টা

মামলা নিষ্পত্তিতে গুরুত্ব বিএনপির

শফিকুল ইসলাম সোহাগ

মামলা নিষ্পত্তিতে গুরুত্ব বিএনপির

ছাত্র-জনতার আন্দোলনের আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর ২০০৭ সাল থেকে ৫ আগস্ট-২০২৪ পর্যন্ত বিএনপি এবং এর অঙ্গসহযোগী সংগঠনের নেতা-কর্মীদের বিরুদ্ধে পাইকারি হারে দায়ের হওয়া মামলা নিষ্পত্তিতে গুরুত্ব দিয়েছে বিএনপি। এ ছাড়া ৫ আগস্টের পর দলীয় নেতা-কর্মীদের বিরুদ্ধে চাঁদাবাজি, দখলদারি ও নৈরাজ্যের বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থানে রয়েছে দলটি। মূলত বর্তমান সময়ে এই দুটি বিষয়ের প্রতিই দলটি জোর দিয়েছে।

দলীয় সূত্র জানায়, পরিবর্তিত রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে বিগত দিনের রাজনৈতিক মিথ্যা মামলা দ্রুত প্রত্যাহার করানোর বিষয়টি বিএনপিতে সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব পাচ্ছে। এ লক্ষ্যে সাত দিনের সময় বেঁধে দিয়ে সংশ্লিষ্টদের তথ্য দেওয়ার জন্য বার্তাও দেওয়া হয়েছে। বিএনপির দপ্তর সূত্র জানায়, মামলার তথ্য পাঠাতে কেন্দ্র থেকে দলের জেলা ও মহানগর শাখার নেতাদের কাছে চিঠি দেওয়া হয়েছে। বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভীর স্বাক্ষরে এই চিঠি পাঠানো হয়। চিঠির সঙ্গে মামলার বিবরণের একটি ছকও পাঠানো হয়েছে, যেখানে পাঁচটি তথ্য চাওয়া হয়েছে। নেতা-কর্মীদের নিজ নিজ জেলা আইনজীবী ফোরামের সদস্যদের সঙ্গে যোগাযোগ করে নির্দিষ্ট ছকে মামলার সংগৃহীত তথ্য দলের কেন্দ্রীয় দপ্তরে পাঠাতে হবে। মামলার বিষয়ে বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান শামসুজ্জামান দুদু বলেন, দলের চেয়ারম্যান বেগম খালেদা জিয়ার মামলাও প্রত্যাহার করা দরকার। দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান এখনো নির্বাসিত জীবনযাপন করছেন। তারও সব মামলা প্রত্যাহার করতে হবে।

বিএনপির মহাসচিবসহ বিরোধী দলগুলোর নেতা-কর্মী যারা গণতন্ত্রের জন্য লড়াই করেছে- তাদের মামলা এখনো প্রত্যাহার করা হয়নি। ৬০ লাখ আসামি আড়াই লাখ মামলায়। এই মামলাগুলো যতক্ষণ না প্রত্যাহার করা হবে, ততক্ষণ প্রশ্ন থেকেই যাবে যে- এই সরকার গণতন্ত্রের পক্ষে কাজ শুরু করেছে কিনা?

এদিকে দলীয় শৃঙ্খলা ভঙ্গের অভিযোগে পিরোজপুরের মঠবাড়িয়া উপজেলা বিএনপির আহ্বায়ক রুহুল আমিন দুলালকে বহিষ্কার করেছে কেন্দ্রীয় কমিটি। ওই বহিষ্কারাদেশ প্রত্যাহারের দাবিতে গতকাল স্থানীয় শহীদ মিনারের সামনের সড়কে শতাধিক নেতা-কর্মী নিয়ে মানববন্ধনে করা হয়েছে। স্থানীয় নেতারা অভিযোগ করেছেন, দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের সিদ্ধান্তের বাইরে গিয়ে রুহুল আমিন দুলাল এ মানববন্ধন করিয়েছেন। এ মানববন্ধন পেছন থেকে সংগঠিত করেছেন মঠবাড়িয়া উপজেলা বিএনপির যুগ্ম আহ্বায়ক জসিম ফরাজী। বহিষ্কারের পর মঠবাড়িয়া শহরের জসিম ফরাজির নেতৃত্বে বিক্ষোভ মিছিল করেন কিছু নেতা-কর্মী। তারা এই সিদ্ধান্তকে ষড়যন্ত্র বলে দাবি করেন।

মানববন্ধনে বিএনপি নেতা আবুল কালাম আজাদ সাবু জমাদ্দার সভাপতির বক্তব্যে বলেন, কী কারণে আমাদের ভাইকে অব্যাহতি দিয়েছেন তা জানতে চাই। এই বহিষ্কারাদেশ নিয়ে মঠবাড়িয়ার মানুষের আপত্তি আছে। সাবেক ছাত্রদল সভাপতি রিয়াজুল ইসলাম বলেন, একটি চক্র আওয়ামী লীগের সঙ্গে আঁতাত করে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যানকে ভুলভাল বুঝিয়েছেন। অনতিবিলম্বে বহিষ্কারাদেশ প্রত্যাহার না করলে কঠোর কর্মসূচি দেওয়া হবে বলেও হুমকি দেন তিনি। বক্তব্য দেন পিরোজপুর জেলা স্বেচ্ছাসেবক দলের সহসভাপতি ইসমাইল হোসেন ঘরামী, সাবেক ছাত্রদল নেতা মাহবুবুল ইসলাম নান্না, খলিলুর রহমান খন্দকার, দুলাল সরদার, রিপন মাতুব্বরসহ ইউনিয়ন বিএনপির বিভিন্ন পর্যায়ের নেতৃবৃন্দ।   

স্থানীয় নেতারা বলেন, দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যানের সিদ্ধান্ত চ্যালেঞ্জ করা হলে দলে শৃঙ্খলা ধরে রাখা কঠিন হবে।

এদিকে ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে আওয়ামী লীগ সরকার পতনের পর পরিবর্তিত রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে চাঁদাবাজি, দখলদারি ও নৈরাজ্যের বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থান নিয়েছেন বিএনপির হাইকমান্ড। কিন্তু এর পরও থেমে নেই বিএনপির কিছু নেতার নানা অপকর্ম। দলটির দপ্তর সূত্র জানায়, গত এক মাসে ৫ শতাধিক নেতার বিরুদ্ধে বিভিন্ন অভিযোগে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নিয়েছে বিএনপি। শৃঙ্খলা রক্ষায় জিরো টলারেন্স নীতি ঘোষণায়ও টনক নড়েনি অনেক নেতার। জানা গেছে, কুমিল্লার মুরাদনগরে মাদক, সন্ত্রাস, চাঁদাবাজ, ভূমিদস্যু ও লুটপাটকারীদের বিরুদ্ধে জনসাধারণের সচেতনতা বৃদ্ধিতে মাইকিং করেছে মুরাদনগর উপজেলা বিএনপি। গত বৃহস্পতিবার দিনব্যাপী উপজেলার ২২টি ইউনিয়নে কুমিল্লা-৩ আসনের সাবেক এমপি ও বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান কাজী শাহ মোফাজ্জল হোসেন কায়কোবাদের নির্দেশনায় মাইকিং করে বিএনপির বিভিন্ন অঙ্গসংগঠনের নেতা-কর্মীরা।

এ বিষয়ে মুরাদনগর উপজেলা বিএনপির সদস্য সচিব মোল্লা মজিবুল হক বলেন, গত ১৫ বছর আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে মুরাদনগর উপজেলায় যত অপর্কম হয়েছে সেগুলো শুধরে নিয়ে নতুন বাংলাদেশে মুরাদনগরকে নতুনভাবে গড়ে তুলতে গণমানুষের নেতা ও বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান কাজী শাহ মোফাজ্জল হোসেন কায়কোবাদ উপজেলা বিএনপিকে নির্দেশ দিয়েছেন। তাঁর নির্দেশে উপজেলা বিএনপি বিভিন্ন কার্যক্রম শুরু করেছে। তারই অংশ হিসেবে মাদক, সন্ত্রাস, চাঁদাবাজ, ভূমিদস্যু ও দখলবাজদের অপকর্ম বন্ধ, পুলিশকে সহযোগিতা ও জনসাধারণকে সচেতন করতে উপজেলার প্রতিটি গ্রামে গ্রামে মাইকিং ও সভা করা হচ্ছে। নাটোরের বাগাতিপাড়ায় উপজেলা বিএনপির আহ্বায়ক মোশাররফ হোসেনের হুমকিতে শামসুন নাহার সিমা নামে এক অধ্যক্ষ অসুস্থ হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন। বর্তমানে তিনি হাসপাতালে চিকিৎসাধীন রয়েছেন। ৯ সেপ্টেম্বর সকালে অধ্যক্ষ অসুস্থ হয়ে পড়লে তাকে বাগাতিপাড়া উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে ভর্তি করানো হয়। শামসুন নাহার সিমা নাটোর জেলার বাগাতিপাড়া বিএম কলেজের ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ হিসেবে দায়িত্বে রয়েছেন।

অধ্যক্ষ শামসুন নাহার সিমা জানান, কয়েকদিন থেকেই উপজেলা বিএনপির আহ্বায়ক মোশাররফ হোসেন তাকে ফোন দিয়ে কলেজের পরিচালনা কমিটিতে তার দেওয়া ব্যক্তিদের নেওয়ার জন্য চাপ দেন। এর পর তার সঙ্গে দেখা করার নির্দেশ দেন। এর পর মোশাররফ হোসেন তার প্রতিষ্ঠানে রেজাউল নামের এক ব্যক্তিকে পাঠান। পরে ৮ সেপ্টেম্বর উপজেলার মালঞ্চি বাজার রেল গেট এলাকায় মোশাররফের অফিসে ওই নেতা তাকে ডেকে পাঠান। ওই দিন দুপুরে অধ্যক্ষ মোশাররফ হোসেনের অফিসে গেলে তিনি কড়া ভাষায় প্রতিষ্ঠানের আগের সব হিসাব-নিকাশ দাখিল করতে বলেন, এবং আপাতত তার লোক রেজাউলকে প্রতিষ্ঠানের কমিটিতে রাখার জন্য নির্দেশ দেন। পরবর্তীতে পূর্ণাঙ্গ কমিটিতে তার সঙ্গে আলোচনা করে তার মনোনীত লোক দিয়ে কমিটি করার নির্দেশ দেন। এতে ক্রমাগত মানসিক প্রেসারে তিনি অসুস্থ হয়ে পড়েন। বিএনপির দাবি, গত ১৬ বছরে দেড় লাখের বেশি মামলায় ৬০ লাখেরও বেশি নেতা-কর্মীকে আসামি করা হয়েছে। এর মধ্যে বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া, ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানসহ দলের কেন্দ্র থেকে তৃণমূলের নেতা-কর্মীরা রয়েছেন। এসব মামলা মিথ্যা, গায়েবি ও রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত। দলটির অভিযোগ, বিএনপিকে দমন করতে মামলাকে রাজনৈতিক হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করেছিল বিগত আওয়ামী লীগ সরকার।

এদিকে আওয়ামী লীগ সরকারের পতন হলেও মামলা নিষ্পত্তি না হওয়ায় বিএনপির সারা দেশের নেতা-কর্মীদের এখনো আদালতের বারান্দায় ঘুরতে হচ্ছে, দিতে হচ্ছে বিভিন্ন মামলায় হাজিরা। এসব মামলায় এরই মধ্যে অনেকের সাজাও হয়েছে। দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনের আগে মামলাগুলোয় দ্রুত রায় হতে থাকে। বিভিন্ন মামলায় তখন দেড় হাজারের অধিক নেতা-কর্মীর সাজা হয়। অবশ্য নির্বাচনের পর আইনি প্রক্রিয়ায় অধিকাংশ নেতা কারামুক্তও হন। এসব ‘রাজনৈতিক ও মিথ্যা’ মামলা প্রত্যাহার চান নেতারা।

দলীয় সূত্রে জানা গেছে, সারা দেশের নেতা-কর্মীদের মামলার তথ্য বিবরণী পাওয়ার পর প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করবে বিএনপি। দলের কেন্দ্রীয় দপ্তরে মামলার এই হালনাগাদ তথ্য সংরক্ষণের পাশাপাশি এসব মামলা নিষ্পত্তির লক্ষ্যে তা অন্তর্বর্তী সরকারকেও দেওয়া হবে। বিএনপি মনে করে, দেশে ন্যায় প্রতিষ্ঠার জন্য নেতা-কর্মীদের মিথ্যা মামলা প্রত্যাহার হওয়া প্রয়োজন। বিএনপির সহ-দপ্তর সম্পাদক তাইফুল ইসলাম টিপু বলেন, ২০১৪ সাল থেকে ২০২৪ সালের মাঝামাঝি পর্যন্ত বিএনপি ও অঙ্গসহযোগী সংগঠনের নেতা-কর্মীদের বিরুদ্ধে পাইকারি হারে মিথ্যা মামলা দেওয়া হয়েছে। এসব মামলার হালনাগাদ তথ্য সংগ্রহে গত ২ সেপ্টেম্বর দলের কেন্দ্রীয় দপ্তর থেকে জেলা ও মহানগর শাখায় চিঠি দেওয়া হয়েছে। সারা দেশের নেতা-কর্মীদের মামলার সর্বশেষ তথ্য সংগ্রহের পর দল পরবর্তী করণীয় নির্ধারণ করবে।

সর্বশেষ খবর