জাতীয় নাগরিক কমিটির আহ্বায়ক নাসিরউদ্দিন পাটোয়ারী বলেছেন, জুলাই অভ্যুত্থানে শহীদদের নিয়ে রাজনীতি করার চেষ্টা হচ্ছে। এটা ন্যক্কারজনক। শহীদদের নিয়ে রাজনীতি করবেন না। দুই মাস হয়ে গেলেও জুলাই গণহত্যার বিচার শুরু না হওয়া দুঃখজনক জানিয়ে তিনি বলেন, শহীদ পরিবারের পুনর্বাসনের উল্লেখযোগ্য কোনো কার্যক্রমও বাস্তবায়িত হয়নি। আহতরা চিকিৎসার জন্য দ্বারে দ্বারে ঘুরে বেড়াচ্ছেন, কিন্তু যথাযথ চিকিৎসাসেবা পাচ্ছেন না। যাদের কারণে এ আন্দোলন সফলতা পেয়েছে, সেই বেকারদের চাকরি নিয়ে গেজেট এখনো প্রকাশিত হচ্ছে না। বেকারদের পেটে লাথি মারবেন না, নয়তো তারা মাঠে নেমে সমুচিত জবাব দেবে।
গতকাল রাজধানীর শাহবাগে জাতীয় নাগরিক কমিটি আয়োজিত জুলাই হত্যাকান্ডের বিচার, শহীদ পরিবারের পুনর্বাসন ও আহতদের চিকিৎসা, আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির উন্নয়ন এবং দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি নিয়ন্ত্রণের দাবিতে আয়োজিত নাগরিক সমাবেশে তিনি এসব কথা বলেন। সমাবেশে নাগরিক কমিটির সদস্য সচিব আখতার হোসেন, সদস্য আশরাফ মাহাদী, প্রীতম দাস, সংগঠক সানজিদা ইসলাম তুলি, ড. আহাদ প্রমুখ বক্তব্য রাখেন। বিচারের দাবি জানিয়ে বক্তব্য রাখেন জুলাই অভ্যুত্থানে শহীদদের স্বজনরাও। সমাবেশে বক্তারা গণ অভ্যুত্থানের পরও দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি, শ্রমিকের বুকে গুলি চালানো, গণহত্যার বিচার শুরু না হওয়া, শহীদ ও আহতদের পরিবারগুলোর সহায়তায় প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ না নেওয়া হতাশাজনক বলে মন্তব্য করেন। সমাবেশ থেকে জানানো হয়, হত্যাকারীদের বিচার ও মামলা পরিচালনার জন্য নাগরিক কমিটি সাত সদস্যের আইনজীবী প্যানেল গঠন করেছে। কোথাও যদি মামলা নিতে গড়িমসি করে, বা গণ অভ্যুত্থানে ভুক্তভোগী কোনো পরিবারের যদি আইনি সহায়তার প্রয়োজন হয়, নাগরিক কমিটির আইনজীবী প্যানেল সহযোগিতা করবে। নাসিরউদ্দিন পাটোয়ারী বলেন, আন্দোলনে ছাত্রদের সঙ্গে সবজি বিক্রেতা, রিকশা শ্রমিক, প্রান্তিক জনগণও অংশগ্রহণ করেছিল। সাধারণ মানুষের পেটে লাথি মেরে যেসব সিন্ডিকেট বাজার অস্থিতিশীল করতে এখনো সক্রিয়, দ্রুত সেসব সিন্ডিকেট ভেঙে দিতে হবে। আমরা দেখছি, আমাদের জীবনের এখন কোনো নিরাপত্তা নেই, আমাদের বোনদের কোনো নিরাপত্তা নেই, পুলিশ বাহিনী এখনো সক্রিয় ভূমিকা পালন করছে না। সেনাবাহিনীকে মাঠে নামানো হয়েছে। পুলিশের কাছে দায়িত্ব হস্তান্তর করে অবিলম্বে সেনাসদস্যদের ব্যারাকে ফিরিয়ে নেওয়া হোক। শিক্ষার্থীদেরও দ্রুত পড়াশোনায় ফিরিয়ে নিতে হবে। নাগরিক কমিটির সদস্য সচিব আখতার হোসেন বলেন, যারা জুলাই হত্যাকান্ডের সঙ্গে জড়িত, তারা এখনো বাইরে ঘুরে বেড়াচ্ছে। দ্রব্যমূল্য সাধারণ মানুষের নাগালের বাইরে যাচ্ছে। অন্তর্বর্তী সরকারকে বলতে চাই, শত শহীদের রক্তের ওপর দাঁড়িয়ে আছে এই বাংলাদেশ। শহীদের রক্তের সঙ্গে বেইমানি করবেন না। সমাবেশে শহীদ মোমিনুল ইসলামের বাবা সাইফুল ইসলাম বলেন, আমার ছেলে গত ১৯ জুলাই গুলশানে পুলিশের গুলিতে নিহত হয়। সে দেশের জন্য শহীদ হয়েছে। ছেলের জন্য আমি গর্ববোধ করি। কিন্তু দুঃখের বিষয়, আমার ছেলের হত্যাকারীদের এখনো বিচার হয়নি। আমি অন্তর্বর্তী সরকারকে বলতে চাই, আমি যেন হত্যাকারীদের বিচার দেখে মরতে পারি।
শহীদ মারুফ হোসেনের বাবা বলেন, গত ১৯ জুলাই বাড্ডায় পুলিশের গুলিতে আমার ছেলে আহত হয়। গুলিবিদ্ধ অবস্থায় তাকে ঢাকা মেডিকেলে নিয়ে যেতেও বাধা দেয় পুলিশ। অনেক অনুরোধ করে হাসপাতালে নিতে পারলেও চিকিৎসক মৃত ঘোষণা করেন। ২৬ জুলাই রাত ২টায় আমার বাসায় ১২ জন ডিবি পুলিশ যায়। আমাকে জামায়াত-শিবির বলে ট্যাগ দেওয়ার চেষ্টা করে। আমাকে নিয়ে যেতে চায়। তখন মারুফের আম্মা চিৎকার করে ঘরে আগুন ধরিয়ে দেওয়ার হুমকি দিলে পুলিশ চলে যায়। ৫ আগস্ট না এলে আমাকেও আয়নাঘরে থাকতে হতো। তিনি বলেন, ছেলেকে হত্যার ঘটনায় বাড্ডা থানায় গিয়ে মামলা দিতে পারিনি। পরে ১৫ তারিখ আন্তর্জাতিক ট্রাইব্যুনালে মামলা করি। শহীদ খালিদ হাসান সাইফুল্লাহর বাবা কামরুল হাসান বলেন, আমার ছেলের বুকে ৭১টি গুলি করা হয়েছে। একজন নিরস্ত্র আন্দোলনকারীকে মারতে কয়টা গুলির প্রয়োজন হয়? আমাদের টাকায় গুলি, আমাদের টাকায় অস্ত্র, আমাদের টাকায় বেতন খেয়ে স্বৈরাচার শেখ হাসিনার নির্দেশে নির্মমভাবে হত্যা করা হয় আমার ছেলেকে। সংগঠক সানজিদা ইসলাম তুলি বলেন, ৫ আগস্টের পর দুই মাস পার হয়ে গেছে। অথচ, যে বিচারগুলোর ব্যবস্থা করা ছিল অন্তর্বর্তী সরকারের প্রথম ও প্রধান দায়িত্ব, সেখানে একটা ট্রাইব্যুনাল হয়েছে, যেখানে এখনো কোনো বিচারপতি নিয়োগ দেওয়া হয়নি। যেখানে দেড় হাজারের বেশি শহীদের তালিকা আছে, সেখানে এখনো কোনো গণতদন্ত কমিটি গঠন করা হয়নি। প্রীতম দাস বলেন, জুলাই-আগস্ট অভ্যুত্থানে ছাত্রদের সঙ্গে শ্রমিকরা কাঁধে কাঁধ রেখে আন্দোলনে নেমেছে। তারাও বুকের রক্ত দিয়েছে। কিন্তু দুঃখের সঙ্গে দেখছি, এই গণ অভ্যুত্থানের পর আশুলিয়ায় গার্মেন্টশ্রমিক ভাইদের ওপর গুলি চালানো হয়েছে। একজন গার্মেন্টশ্রমিক নিহত হয়েছেন। ৩০ জন আহত হয়েছেন। আজ গণ অভ্যুত্থানের পর যখন শ্রমিকদের বুকে গুলি চলে, তখন এই অভ্যুত্থানে যারা রক্ত দিয়েছেন, যারা জীবন দিয়েছেন, তাদের পরিবার শঙ্কিত হয়।