সরেজমিন পঙ্গু হাসপাতাল - রাস্তার পাশে থাকা পুলিশের একটি গাড়ি হঠাৎ ব্যাক গিয়ার দিয়ে পেছনের দিকে এসে আবার সামনের দিকে চলে যায়। কেউ একজন বেশ কয়েকজনকে ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে দিলেও আমার ডান পা চলে যায় ওই গাড়ির নিচে।
ঢাকা আদমজী ক্যান্টনমেন্ট কলেজের উচ্চমাধ্যমিকের শিক্ষার্থী আবদুল্লাহ আহমেদ। স্বপ্ন দেখতেন, বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর অফিসার হবেন। কিন্তু পায়ের হাড়ের মতোই ভেঙে টুকরা টুকরা হয়ে গেছে তার সেই স্বপ্ন।
গত ৪ আগস্ট রাজধানীর মিরপুরে পুলিশের গাড়িতে চাপা পড়ে আবদুল্লাহর ডান পা। এতে ভেঙে গুঁড়ো হয়ে যায় পায়ের হাড়। গতকাল জাতীয় অর্থোপেডিক হাসপাতালে (পঙ্গু হাসপাতাল) গিয়ে দেখা যায়, ডান পায়ে লোহার পাত প্যাঁচানো অবস্থায় শুয়ে আছেন তিনি। শুধু আবদুল্লাহই নন, তার মতো আরও অনেকেই শরীরের বিভিন্ন অঙ্গ হারিয়ে কাতরাচ্ছেন হাসপাতালের বেডে।
আবদুল্লাহ আহমেদ বলেন, অনেক স্বপ্ন ছিল আর্মি অফিসার হব। পুলিশের গাড়িতে চাপা পড়ে সেই স্বপ্ন ভেঙে গেছে। ডাক্তার বলেছেন, একাধিক অস্ত্রোপচারের পর সুস্থ হয়ে হাঁটাচলা করার সম্ভাবনা থাকলেও আগের মতো পা ভাঁজ করতে পারব না।
সেদিনের ঘটনা বর্ণনা করতে গিয়ে তিনি বলেন, সরকার পতনের আগের দিন (৪ আগস্ট) দুপুরে আমিও অন্যদের সঙ্গে ইসিবি চত্বরে ছিলাম। সেখানে পরিস্থিতি স্বাভাবিক হলে আমরা মিরপুর-১০ নম্বরের দিকে যাই। বিআরটিএ অফিসের সামনে পৌঁছালে মিরপুর-১০ নম্বরের দিক থেকে পুলিশ ও আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীরা আমাদের লক্ষ্য করে গুলি ছোড়ে। এরই মধ্যে রাস্তার পাশে থাকা পুলিশের একটি গাড়ি হঠাৎ ব্যাক গিয়ার দিয়ে পেছনের দিকে এসে আবার সামনের দিকে চলে যায়। কেউ একজন বেশ কয়েকজনকে ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে দিলেও আমার ডান পা চলে যায় ওই গাড়ির নিচে। আমার পায়ের হাড় ভেঙে গুঁেড়া হয়ে যায়। সেদিন থেকেই হাসপাতালের বেডে। কয়েকবার অপারেশন করা হয়েছে। আরও অপারেশন করতে হবে।
গতকাল সরেজমিন পঙ্গু হাসপাতাল ঘুরে দেখা যায়, তৃতীয় তলার বি-ওয়ার্ডে (পুরুষ) মোট ৪৮টি বেড আছে। এটি বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে আহতদের চিকিৎসার জন্য গঠিত বিশেষায়িত ওয়ার্ড। সেই ওয়ার্ডের ৩৫ বেডেই কাতরাচ্ছেন আন্দোলনে আহতরা। কেউ পা হারিয়েছেন, কারও হাতে গুলি লেগেছে, কারোর পায়ে লোহার রিং পরানো, কেউ ব্যথায় নড়াচড়াও করতে পারছে না। সবারই চোখে মুখে বিষণœতার ছাপ। তাদেরই একজন সাতক্ষীরার আশাশুনি উপজেলার নবম শ্রেণির ছাত্র আলী আহসান। ৫ আগস্ট ঘাতকের ছোঁড়া গুলি কেড়ে নেয় তার ডান পা। এক পা হারিয়ে হাসপাতালের বেডে পড়ে আছেন আলী আহসান। তিনি বলেন, ৫ আগস্ট বিকালে আনন্দ মিছিল শেষে ফেরার পথে স্থানীয় আওয়ামী লীগের সভাপতি শেখ জাকির হোসেন নিজ বাড়ির ছাদ থেকে আমাদের ওপর গুলি চালায়। মিছিলের শুরুর দিকে থাকায় আমার ডান পায়ের হাঁটুতে গুলি লাগে। এর পর আমি পড়ে যাই। তখনো তারা টার্গেট করে গুলি করতে থাকে। এর মধ্যে তিনটা গুলি হাড় ভেঙে বেরিয়ে যায়। চিকিৎসা শুরু হলেও পায়ের মাংসে পচন ধরে। তাই জীবন বাঁচাতে পা কেটে ফেলতে হয়েছে। তবে আমাদের লড়াই সফল হওয়ায় আমার পা হারানোর যন্ত্রণা ভুলে গিয়েছি। সরকারের কাছে দাবি জানিয়ে আলী আহসান বলেন, আহতদের উন্নত চিকিৎসার ব্যবস্থা করতে হবে। হাত-পা, চোখসহ যাদের অঙ্গহানি হয়েছে তাদের পুনর্বাসনের ব্যবস্থা করতে হবে। এ ছাড়া শেখ হাসিনাসহ সব দোষীকে দেশে ফিরিয়ে এনে শাস্তিরও দাবি জানান তিনি। এ ছাড়া আন্দোলনে গিয়ে গুলিবিদ্ধ হন মিরপুর এলাকার স্থানীয় এক দোকানের কর্মচারী মো. শাহিন। গত ১৯ জুলাই বিকালে মিরপুর ১০ নম্বর এলাকায় পুলিশের ছোড়া গুলি বাম হাত ভেদ করে বেরিয়ে যায়। গুলিতে হাতের রগ ছিঁড়ে যাওয়ায় বাম হাতে কোনো অনুভূতি পান না। তিনি বলেন, বয়সের ভারে আমার বাবা কিছু করতে পারেন না। আমি ও আমার ভাই কোনোরকমে সংসার চালাতাম। এখন হাসপাতালে পড়ে আছি। চিকিৎসা করাতে গিয়ে আমার পরিবার ঋণগ্রস্ত হয়ে গেছে। সরকার বলেছে, ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারকে তারা সহায়তা করবে। আমরাও সরকারের প্রতি আশাবাদী। হাসপাতাল সূত্র জানিয়েছে, আন্দোলনের শুরু থেকে গতকাল পর্যন্ত ৮৫০ জন আহত অবস্থায় চিকিৎসা নিয়েছেন। বর্তমানে ৬৮ জন চিকিৎসাধীন আছেন। শুরু থেকে আন্দোলনে আহতদের হাসপাতালের ক্যাজুয়ালিটি-১, ক্যাজুয়ালিটি-২-সহ বিভিন্ন ওয়ার্ডে বিক্ষিপ্তভাবে চিকিৎসা প্রদান করা হয়েছে। তবে বর্তমানে তাদের জন্য তৃতীয় ও চতুর্থ তলায় দুটি বিশেষায়িত ওয়ার্ডের ব্যবস্থা করা হয়েছে। সেখানেই আন্দোলনে আহতদের চিকিৎসা দেওয়া হচ্ছে।
জাতীয় অর্থোপেডিক হাসপাতাল ও পুনর্বাসন প্রতিষ্ঠানের পরিচালক অধ্যাপক ডা. কাজী শামীম উজজামান বলেন, ইতোমধ্যে চীনের চিকিৎসকদের একটি দল হাসপাতাল পরিদর্শন করেছে। তারা বলেছে, যে চিকিৎসা চলমান রয়েছে তা সন্তোষজনক। তবে এখনো হাসপাতালে জটিল কিছু রোগী রয়েছে। তাদের নমুনা নেওয়া হয়েছে। দেশে গিয়ে এক্সপার্ট ডাক্তারদের সঙ্গে তারা এসব নিয়ে কথা বলবেন।