সুনামগঞ্জ চিফ জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে কর্মচারী নিয়োগের ক্ষেত্রে ৩৩টি পদের সব নিয়োগ-সংশ্লিষ্ট মন্ত্রী-আমলা-বিচারকরা মিলেমিশে ভাগবাঁটোয়রা করে নেওয়ার চাঞ্চল্যকর তথ্য বেরিয়ে এসেছে। নিয়োগপ্রাপ্তদের বেশির ভাগই আওয়ামী লীগ সরকারের তৎকালীন আইনমন্ত্রী, আইন মন্ত্রণালয়ের সচিব ও সুনামগঞ্জ চিফ জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেটের হয় আত্মীয়-স্বজন, না হয় তাদের এলাকার বাসিন্দা। এই ভাগাভাগি করতে গিয়ে নিয়োগ-সংক্রান্ত বিধিবিধান পদে পদে লঙ্ঘন করেছেন খোদ ‘আইনের রক্ষকরাই’।
সে সময় নিম্ন আদালতে তৃতীয় ও চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারী নিয়োগের ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট জেলায় স্থায়ীভাবে বসবাসকারী প্রার্থীদের অগ্রাধিকার প্রদানের বাধ্যবাধকতা ছিল। এই মর্মে সুপ্রিম কোর্ট থেকে যে সার্কুলার জারি করা হয়, নিয়োগের ক্ষেত্রে সেই আদেশও প্রতিপালন করা হয়নি। অভিযোগ রয়েছে, ভাগাভাগির এই নিয়োগে সংশ্লিষ্টদের স্বজনপ্রীতির পাশাপাশি মোটা অঙ্কের ঘুষের বিনিময়ে অযোগ্যদের চাকরি দেওয়া হয়েছে। বঞ্চিত করা হয়েছে নিয়োগ পরীক্ষায় অংশ নেওয়া প্রকৃত চাকরিপ্রত্যাশীদের। তদন্ত করে বিতর্কিত ত্রুটিপূর্ণ এই নিয়োগ বাতিল করে নতুন করে নিয়োগ পরীক্ষা গ্রহণের দাবি তাদের।
নিয়োগের নথিপত্র পর্যালোচনা করে দেখা যায়, ২০১৬ সালের ৭ জুন সুনামগঞ্জ চিফ জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে তৃতীয় ও চতুর্থ শ্রেণির ২৮ জন কর্মচারী নিয়োগের জন্য জাতীয় একটি দৈনিকে নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করে সুনামগঞ্জ চিফ জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেটের কার্যালয়। এই নিয়োগের ক্ষেত্রে তৎকালীন জেলা জজ শহীদুল আলম ঝিনুক নিয়োগকারীর দায়িত্বে ছিলেন। চিফ জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট মো. রহিবুল ইসলাম নিয়োগ ও বাছাই কমিটির চেয়ারম্যান এবং সিনিয়র জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট মোহাম্মদ শহীদুল আমিন ও সহকারী জজ মো. খালেদ মিয়া কমিটির সদস্য হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। অনুসন্ধানে দেখা যায়, পত্রিকায় ২৮ জন কর্মচারী নিয়োগের জন্য বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করা হলেও চূড়ান্ত নিয়োগ দেওয়া হয় ৩৩ জনকে। তিনটি পদে ৭ জনকে বিজ্ঞপ্তিবহির্ভূত বেআইনি নিয়োগ প্রদান করা হয়। ২০১৮ সালের ১৮ ফেব্রুয়ারি লাইব্রেরি সহকারী, হিসাবরক্ষক, কম্পিউটার অপারেটর, বেঞ্চ সহকারী, তুলনা সহকারী, অফিস সহকারী, স্টোর কিপার, ডেসপাস সহকারী, প্রসেস সার্ভার, অফিস সহায়ক ও নিরাপত্তা প্রহরী পদে নিয়োগ পান তারা। জানা যায়, ৩৩টি পদের মধ্যে ২২টি পদ ভাগাভাাগি করে নেন তৎকালীন আইনমন্ত্রী, আইন মন্ত্রণালয়ের একজন সচিব, জেলা জজ শহীদুল আলম ও চিফ জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট রহিবুল ইসলাম। মন্ত্রী-আমলা-বিচারকদের ভাগাভাগি জায়েজ করতে বাকিগুলো স্থানীয় প্রভাবশালীদের উপঢৌকন হিসেবে দেওয়া হয় মুখ বন্ধ রাখতে।খোঁজ নিয়ে জানা যায়, বেঞ্চ সহকারী রুবেল মিয়া, আরিফুল ইসলাম ভূঁইয়া, আরিফুল ইসলাম ভূঁইয়া, প্রসেস সার্ভার ইকবাল হোসেন, জাকির হোসেন ও কিরণ মিয়া তৎকালীন আইনমন্ত্রী আনিসুল হকের নির্বাচনি এলাকা কসবা ও পার্শ্ববর্তী কুমিল্লার বাসিন্দা। সংশ্লিষ্ট সূত্র মতে, এই পাঁচজন কর্মচারীকে মন্ত্রীর নির্দেশে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। তাদের কাছ থেকে ৬ থেকে ৭ লাখ টাকা করে ঘুষ নেওয়া হয়েছে।
অপরদিকে, নিয়োগ কমিটির চেয়ারম্যান ও তৎকালীন চিফ জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট রহিবুল ইসলামের অন্তত ৯ জন আত্মীয় ও নিজ এলাকার ব্যক্তিকে বিভিন্ন পদে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। তাদের মধ্যে লাইব্রেরি সহকারী মোছা. ফারজানা ইয়াসমিন, স্টেনো স্টাইপিস্ট ইমরান হোসেন, তুলনা সহকারী বেগম লাভনী খাতুন, অফিস সহকারী বেগম শামীমা ইসলাম, স্টোর কিপার সুমি আক্তার রিতু, ডেসপাস সহকারী সোহেল আহম্মেদ, প্রসেস সার্ভার শাহাবুদ্দিন, শহিদুল ইসলাম ও অফিস সহায়ক আলিম হোসেন চিফ জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট রহিবুল ইসলামের নিকটাত্মীয় ও এলাকার বাসিন্দা। তাদের মধ্যে রহিবুলের আত্মীয় সুমি আক্তার রিতু নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি প্রকাশের এক বছর পর উচ্চমাধ্যমিক পাস করেছেন।
স্টেনো স্টাইপিস্ট ইমরান হোসেন নিয়োগ কমিটির চেয়ারম্যান রহিবুল ইসলামের আত্মীয় হওয়ার বিষয়টি অস্বীকার করে নিয়োগ নিয়ে কোনো কথা বলতে অস্বীকৃতি জানান। এদিকে, নিয়োগে আইন মন্ত্রণালয়ের তৎকালীন এক সচিবের সুপারিশে বিভিন্ন পদে নিয়োগ পেয়েছেন একই গ্রামের চার ব্যক্তি। তারা হলেন হিসাবরক্ষক দুলাল মিয়া, প্রসেস সার্ভার গোলাম সামদানী, অফিস সহায়ক রাশেদুল ইসলাম ও দোলোয়ার হোসেন। এই চারজনের বাড়ি ময়মনসিংহ জেলার সদর উপজেলার দাপুনিয়া গ্রামে।
এ ছাড়া বিতর্কিত ওই নিয়োগে চাকরি পেয়েছেন তৎকালীন জেলা জজ ও নিয়োগকারী শহীদুল আলাম ঝিনুকের ভাতিজাসহ চার আত্মীয়। তারা হলেন বেঞ্চ সহকারী মুজাহিদুল আলম, প্রসেস সার্ভার তারেক আহম্মদ তুহিন, অফিস সহায়ক শাহেদুল ইসলাম ও সোলাইমান হোসেন বাবু। তাদের সবার বাড়ি জেলা জজের এলাকা চট্টগ্রামে। তাদের মধ্যে বেঞ্চ সহকারী মুজাহিদুল আলম তৎকালীন জেলা জজ ও নিয়োগকারী শহীদুল আলম ঝিনুকের আপন বড় ভাইয়ের ছেলে। যোগাযোগ করা হলে মুজাহিদুল আলম বলেন, শহীদুল আলম আমার আপন চাচা। তবে নিয়োগের ক্ষেত্রে কোনো অনিয়ম হয়নি বলে দাবি করেন তিনি। সুনামগঞ্জ চিফ জুডিশিয়াল আদালতের একজন প্রসিকিউটর নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, এই নিয়োগের সংশ্লিষ্ট মন্ত্রী-আমলা-বিচারকরা মিলেমিশে নজিরবিহীন দুর্নীতি করেছেন। অর্ধেক পোস্ট নিজেদের মধ্যে ভাগবাটোয়রা করে নেওয়ার পর বাকিগুলো আদালত সংশ্লিষ্ট প্রভাবশালীদের দেওয়া হয়ছে মুখ বন্ধ রাখতে। নাজিরের সুপারিশে চাকরি পেয়েছেন কেউ কেউ। নিয়োগ কমিটির চেয়ারম্যান ও তৎকালীন চিফ জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট মো. রহিবুল ইসলাম অভিযোগের ব্যাপারে বলেন, আমরা স্বচ্ছতার সঙ্গে এই নিয়োগ দিয়েছি। এই নিয়োগ নিয়ে হাই কোর্টে একটি রিটও চলমান আছে। আমার কোনো আত্মীয়-স্বজন নিয়োগ দিইনি। যারা নিয়োগ পেয়েছেন তারা মেধার ভিত্তিতে পেয়েছেন। বদলিজনিত কারণে অভিযুক্ত সচিব ও সাবেক জেলা জজের বক্তব্য সংযুক্ত করা সম্ভব হয়নি।