ইরান ও ইসরায়েল পরস্পরকে আঘাত হানতে সর্বাত্মকভাবে প্রস্তুতি নিয়েছে। উভয়পক্ষের সেনারাই নির্দেশের জন্য অপেক্ষা করছে। তবে কোনো পদক্ষেপ নেওয়ার আগে এরই মধ্যে ইসরায়েলি প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু তার মিত্র যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের সঙ্গে টেলিফোনে প্রায় আধা ঘণ্টা কথা বলেছেন। এই আলাপের ফলাফল সম্পর্কে তাৎক্ষণিকভাবে কিছু জানা যায়নি। এদিকে যুদ্ধ নিয়ে গোটা মধ্যপ্রাচ্যজুড়ে টানটান উত্তেজনা বিরাজ করছে। সূত্র : রয়টার্স, বিবিসি, এএফপি, আল জাজিরা।
একটি খবর থেকে জানা গেছে, ইসরায়লের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহুর সঙ্গে টেলিফোনে আলাপ করেছেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন। ইরানের সঙ্গে চলমান উত্তেজনার মধ্যেই স্থানীয় সময় বুধবার এই ফোনালাপ অনুষ্ঠিত হয়। ধারণা করা হচ্ছে, ইরানে হামলার পরিকল্পনা নিয়ে এই দুই নেতার মধ্যে আলাপ হয়। এ বিষয়ে একটি সূত্র বলছে, গত আগস্টের পর বাইডেন ও নেতানিয়াহুর মধ্যে প্রথম প্রকাশিত ফোনালাপ এটি। আলাপে গাজা ও লেবাননভিত্তিক সশস্ত্র সংগঠন হিজবুল্লাহর সঙ্গে ইসরায়েলের সহিংসতা বৃদ্ধির মধ্যেই ইসরায়েলকে অটুট সমর্থনের প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন বাইডেন। হোয়াইট হাউসের এক বিবৃতিতে বলা হয়েছে, ইসরায়েলের নিরাপত্তার প্রতি প্রেসিডেন্ট বাইডেন তার দৃঢ় প্রতিশ্রুতির কথা নিশ্চিত করেছেন। গত ১ অক্টোবর ইসরায়েলে ইরানের ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র হামলার ঘটনায় তিনি দ্ব্যর্থহীনভাবে নিন্দা জানিয়েছেন। হোয়াইট হাউসের মুখপাত্র কারিন জাঁ-পিয়েরে তাদের ৩০ মিনিটের এই ফোনালাপকে প্রত্যক্ষ ও ফলপ্রসূ বলে উল্লেখ করেছেন। তিনি বলেন, বাইডেন ও নেতানিয়াহু ইরানের সঙ্গে সংঘাত নিয়ে আলোচনা করেছেন। তবে এ বিষয়ে আর বিস্তারিত কোনো তথ্য দেননি তিনি। তবে অন্য একটি সূত্র জানায়, এই মুহূর্তে ইরানের ওপর ইসরায়েলি হামলাকে সমর্থন দেননি বাইডেন। তিনি নেতানিয়াহুকে আরও কিছুদিন বিশেষ করে ৫ নভেম্বর মার্কিন প্রেসিডেন্ট নির্বাচন পর্যন্ত অপেক্ষা করার জন্য অনুরোধ করেছেন। তাছাড়া তিনি এই মুহূর্তে যুদ্ধকে যুক্তরাষ্ট্রের জন্য অর্থনৈতিক বিপর্যয়ের কারণ হতে পারে বলেও সতর্ক করেছেন। পাশাপাশি তিনি পরিস্থিতির মুখে ইরানের ওপর প্রতিশোধমূলক হামলা হলে ইসরায়েলকে রক্ষায় যুক্তরাষ্ট্র কাজ করবে বলেও অঙ্গীকার করেন। এদিকে বাইডেন-নেতানিয়াহুর ফোনালাপের পর ইসরায়েলের প্রতিরক্ষামন্ত্রী ইয়োভ গ্যালান্ট এক ভিডিওবার্তায় বলেন, ‘যে আমাদের আক্রমণ করেছে সে আঘাত পাবে এবং তাদেরকে তার মূল্য দিতে হবে।’ তিনি বলেন, ‘আমাদের আক্রমণ হবে মারাত্মক, সুনির্দিষ্ট এবং সর্বোপরি আশ্চর্যজনক। তারা (ইরান) বুঝতে পারবে না কী ঘটেছে এবং কীভাবে ঘটেছে, তারা শুধু ফলাফল দেখতে পাবে।’ অন্যদিকে তেহরান জানিয়েছে, যে কোনো প্রতিহিংসামূলক পদক্ষেপ কেবল ‘ব্যাপক ধ্বংসযজ্ঞ’ ডেকে আনবে।
মধ্যপ্রাচ্যজুড়ে টানটান উত্তেজনা : যে কোনো মুহূর্তে ইরান-ইসরায়েল সর্বাত্মক যুদ্ধ শুরু হয়ে যাওয়ার আশঙ্কায় গোটা মধ্যপ্রাচ্যজুড়ে আতঙ্ক ও উত্তেজনা বিরাজ করছে। উভয়পক্ষের সামরিক শক্তির লক্ষ্যবস্তু হিসেবে রয়েছে সামরিক স্থাপনা, তেল ও জ্বালানি ভান্ডার এবং পারমাণবিক কেন্দ্রগুলো। নির্দেশ পাওয়া মাত্র গর্জে উঠবে উভয়পক্ষের অত্যাধুনিক সমরাস্ত্রগুলো। এ সময় ব্যবহার হতে পারে রাসায়নিক ও পারমাণবিক অস্ত্রও। সার্বিক পরিস্থিতির ওপর কড়া নজর রাখছে ভূমধ্যসাগরে অবস্থানরত মার্কিন ও ন্যাটোর যুদ্ধজাহাজ। এই সঙ্গে রাশিয়া এবং চীনও ঘটনার ওপর নজর রাখছে। মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোর আশঙ্কা, যুদ্ধ শুরু হলে তা গোটা অঞ্চলব্যাপী বিস্তৃত হবে। এর প্রভাপ পড়বে গোটা বিশ্বে।ম্যাথিউ মিলারের সতর্কবার্তা : লেবাননে গাজার মতো ধ্বংসযজ্ঞের ব্যাপারে ইসরায়েলকে সতর্ক করেছে মিত্র যুক্তরাষ্ট্র। এক প্রেস ব্রিফিংয়ে মার্কিন পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের ম্যাথিউ মিলার বলেন, ‘লেবাননে এমন কোনো সামরিক অভিযান হওয়া উচিত নয় যা গাজার মতো ফলাফল বয়ে আনে।’ এর আগে লেবাননে হিজবুল্লাহর লক্ষ্যবস্তুতে হামলা চালিয়ে যাওয়ার ঘোষণা দেন ইসরায়েলের সেনাপ্রধান হারজি হালেভি। এমনকি সশস্ত্র গোষ্ঠীটিকে কোনো বিশ্রামের সুযোগ না দিয়ে ক্রমাগত হামলা চালিয়ে যাওয়ার ঘোষণাও দেন তিনি। ইসরায়েলি প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু ও মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের মধ্যে ফোনালাপের পরপরই এমন কথা বলেন ম্যাথিউ মিলার ও হারজি হালেভি।
বিপদে ইসরায়েল : ইসরায়েলি আগ্রাসন শক্ত হাতে রুখে দিচ্ছে লেবাননের সশস্ত্র গোষ্ঠী হিজবুল্লাহ। তাদের সঙ্গে আছে ইরান, হুতি, হামাস। এবার হিজবুল্লাহ জানিয়েছে, তাদের যোদ্ধারা নতুন ধারাবাহিক অভিযান শুরু করেছে। লেবাননের শহরগুলোর দিকে স্থলপথে আগাতে থাকা ইসরায়েলি বাহিনীর বিরুদ্ধেও তীব্র প্রতিরোধ গড়েছে হিজবুল্লাহ। সম্ভাব্য সব পথেই তারা ইসরায়েলকে আটকে দিচ্ছে। বুধবার ইসরায়েলজুড়ে ২২টির বেশি অভিযান চালিয়েছে হিজবুল্লাহ। শতাধিক রকেট ছোড়া হয়েছে ইসরায়েলের নানা স্থাপনাজুড়ে। মাঝ রাতে শুরু হওয়া হামলার ইতি টানা হয় গতকাল সন্ধ্যার দিকে। এই দীর্ঘ সময় ইসরায়েলের নানা স্থাপনা লক্ষ্য করে রকেট, ক্ষেপণাস্ত্র ও কামানের গোলা ছোড়া হয়। ইরানের ইসলামী বিপ্লবী গার্ড জানিয়েছে, ইসরায়েলে তাদের সাম্প্রতিক হামলা ছিল ছক কষা। এখানে তারা ইসরায়েলকে কেবল ট্রেলার দেখিয়েছে। ভবিষ্যতে ইসরায়েল উল্টাপাল্টা করলে তার ফল হবে আরও ভয়াবহ।
এদিকে গাজা, লেবানন, ইসরায়েলে ছড়িয়ে পড়া আগুনের আঁচ লেগেছে লোহিত সাগরেও। গতকাল লোহিত সাগরে ইয়েমেনের হুতি বিদ্রোহীদের সিরিজ হামলার খবর পাওয়া গেছে। লোহিত সাগরের পূর্ব আফ্রিকা এলাকায় একটি জাহাজ ক্ষেপণাস্ত্রের আঘাতে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। জাহাজটিতে অন্তত দুটি ক্ষেপণাস্ত্র আঘাত হেনেছে।
গাজায় ৬৪ ফিলিস্তিনি নিহত : পশ্চিম তীরে গুলি করে কমপক্ষে চার ফিলিস্তিনিকে হত্যা করেছে ইসরায়েল। নাবলুস শহরের গভর্নর এই ঘটনাকে একটি কাপুরুষোচিত এবং ইচ্ছাকৃত হত্যাকান্ড বলে উল্লেখ করেছেন। প্রায় এক বছর ধরে গাজায় হামলা অব্যাহত রেখেছে ইসরায়েল। সেখানে এরই মধ্যেই ৪২ হাজারের বেশি ফিলিস্তিনি নিহত হয়েছেন। গাজার স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, এখন পর্যন্ত কমপক্ষে ৪২ হাজার ১০ ফিলিস্তিনি নিহত হয়েছেন। এ ছাড়া আহত হয়েছেন আরও ৯৭ হাজার ৭২০ জন।